somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হুমায়ুন আ্জাদের প্রবচনগুচ্ছ (পর্ব ৩)

০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১০ বিকাল ৪:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১০০
সব ধরনের অভিনয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে রাজনীতি;
রাজনীতিকেরা অভিনয় করে সবচেয়ে বড় মঞ্চে ও পর্দায়।

১০১
সক্রেটিস বলেছেন তিনি দশ সহস্র
গর্দভ দ্বারা পরিবৃত। এখন থাকলে তিনি ওই সংখ্যার ডানে
কটি শূন্য যোগ করতেন?

১০২
বাঙালি মুসলমান জীবিত প্রতিভাকে
লাশে পরিনত করে, আর মৃত প্রতিভার কবরে আগরবাতি
জ্বালে।

১০৩
নজরুলসাহিত্যের আলোচকেরা
সমালোচক নন, তাঁরা নজরুলের মাজারের খাদেম।

১০৪
ভ্রষ্ট বাঙালিকে ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ
উপায় তার গালে শক্ত ক’রে একটি চড় কষিয়ে দেয়া।

১০৫
ভিখিরির জীবন মহৎ উপন্যাসের
বিষয় হ'তে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধানদের জীবন সুখপাঠ্য
গুজবনামারও অযোগ্য।

১০৬
বাঙালির জাতিগত আলস্য ধরা পড়ে ভাষায়। বাঙালি ‘দেরি
করে’, ‘চুরি করে’,
'আশা করে', এমনকি ‘বিশ্রাম করে’। বিশ্রামও বাঙালির
কাছে কাজ।

১০৭
বাঙালি অভদ্র, তার পরিচয় রয়েছে
বাঙালির ভাষায়। কেউ এলে বাঙালি জিজ্ঞেস করে, ‘কী
চাই?’ বাঙালির কাছে আগন্তুকমাত্রই ভিক্ষুক। অপেক্ষা করার
অনুরোধ জানিয়ে বাঙালি বলে, ‘দাঁড়ান’। বসতে বলার
সৌজন্যটুকুও বাঙালির নেই।

১০৮
এখানে সাংবাদিকতা হচ্ছে নিউজপ্রিন্ট-বলপয়েন্ট-মিথ্যার
পাচঁন।

১০৯
মানুষ মরণশীল, বাঙালি অপমরণশীল।

১১০
এ-সরকার মাঝে মাঝে গোপন চক্রান্ত ফাঁস ক'রে ফেলে।
সরকার মাটি আর মানুষের সমন্বয় ঘটানোর
সংকল্প ঘোষণা করেছে। আমি ভয় পাচ্ছি, কেননা
মাটি ও মানুষের সমন্বয় ঘটে শুধু কবরে।

১১১
আজকালকার আধিকাংশ পি এইচ ডি অভিসন্দর্ভই মনে আশার
আলো জ্বালায়; মনে হয় এখানেই নিহিত আমাদের
শিক্ষাসমস্যা সমাধানের বীজ। প্রথম বর্ষ অনার্স শ্রেণীতেই
এখন পি এইচ ডি কোর্স চালু করা সম্ভব, এতে
ছাত্ররা আড়াই বছরে একটি ডক্টরেট ডিগ্রি পেতে পারে।
এখানকার অধিকাংশ ডক্টরেটই স্নাতকপূর্ব ডক্টরেট;
অদূর ভবিষ্যতে উচ্চ-মাধ্যমিক ডক্টরেটও পাওয়া যাবে।

১১২
সত্য একবার বলতে হয়; সত্য
বারবার বললে মিথ্যার মতো শোনায়। মিথ্যা বারবার বলতে
হয়; মিথ্যা বারবার বললে সত্য ব’লে মনে হয়।

১১৩
ফুলের জীবন বড়োই করুণ। অধিকাংশ ফুল অগোচরেই
ঝ’রে যায়, আর বাকিগুলো ঝোলে
শয়তানের গলায়।

১১৪
ঢাকা শহরে, ক্রমবর্ধমান এ-পাগলাগারদে, সাতাশ বছর
আছি। ঢাকা এখন বিশ্বের বৃহত্তম পাগলাগারদ; রাজধানি নয়,
এটা পাগলাধানি; কিন্তু বদ্ধপাগলেরা
তা বুঝতে পারে না।

১১৫
বদমাশ হওয়ার থেকে পাগল হওয়া অনেক মানবিক।

১১৬
টেলিভিশনে জাহাজমার্কা আলকাতরার বিজ্ঞাপনটি
আকর্ষণীয়, তাৎপর্যপূর্ণ; তবে অসম্পুর্ণ । বিজ্ঞাপনটিতে জালে,
জাহাজে, টিনের চালে আলকাতরা লাগানোর উপকারিতার
কথা বলা হয়; কিন্তু বলা উচিত ছিলো যে জাহাজমার্কা
আলকাতরা লাগানোর উৎকৃষ্টতম স্থান হচ্ছে টেলিভিশনের
পর্দা, বিশেষ ক’রে যখন বাঙলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠান
দেখা যায়।

১১৭
রবীন্দ্রনাথ এখন বাঙলাদেশের মাটি
থেকে নির্বাসিত, তবে আকাশটা তাঁর। বাঙলার আকাশের
নাম রবীন্দ্রনাথ।

১১৮
গণশৌচাগার দেখলেই কেনো
যেনো আমার বাঙালির আত্মাটির কথা বারবার মনে পড়ে।

১১৯
আমাদের অধিকাংশের চরিত্র
এতো নির্মল যে তার নিরপেক্ষ বর্ণনা দিলেও মনে হয় অশ্লীল
গালাগাল করা হচ্ছে।

১২০
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি,
তুমি কথা বলো।

১২১
বিনয়ীরা সুবিধাবাদী, আর সুবিধাবাদীরা বিনয়ী।

১২২
মোল্লারা পবিত্র ধর্মকেই নষ্ট ক’রে ফেলেছে; ওরা হাতে রাষ্ট্র
পেলে তাকে জাহান্নাম ক’রে তুলবে ।

১২৩
জীবন খুবই মূল্যবান : জীবনবাদীরা
যতোটা মূল্যবান মনে করে, তার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান।
আর শিল্পকলা জীবনের থেকেও মূল্যবান।

১২৪
দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম প্রেম ব'লে কিছু নেই। মানুষ
যখন প্রেমে পড়ে, তখন প্রতিটি প্রেমই প্রথম প্রেম।

১২৫
মার্ক্সবাদের কথা শুনলে এখন মোল্লারাও ক্ষেপে না,
সমাজতন্ত্রের কথা তারা সন্তোষের সাথেই শোনে; কিন্তু
শরীরের কথা শুনলে লম্পটরাও ধর্মযুদ্ধে নামে।

১২৬
কোন কালে এক কদর্য কাছিম দৌড়ে হারিয়েছিলো এক
খরগোশকে, সে-গল্পে কয়েক হাজার ধ’রে মানুষ
মুখর। তারপর খরগোশ কতো সহস্রবার হারিয়েছে
কাছিমকে, সে-কথা কেউ বলে না।

১২৭
বিধাতা মৌলবাদী নয়।
কে প্রার্থনা করলো, কে করলো না; কে কোন তরুণীর গ্রীবার
দিকে তাকালো, কোন রূপসী তার রূপের কতো অংশ
দেখালো, এসব তাকে বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন করে না।
কিন্তু বিধাতার পক্ষে এতে ভীষণ উদ্বিগ্ন বোধ করে ভণ্ডরা।

১২৮
খুব ভেবে চিনতে মানুষ আত্মসমর্পণ
করে, আর অনুপ্রাণিত মুহূর্তে ঘোষণা করে স্বাধীনতা।

১২৯
মানুষ যখন তার শ্রেষ্ঠ স্বপ্নটি দেখে তখনি সে বাস করে তার
শ্রেষ্ঠ সময়ে।

১৩০
এ-বদ্বীপে দালালি ছাড়া ফুলও ফোটে না, মেঘও নামে না।

১৩১
আমার লেখার যে-অংশ পাঠককে
তৃপ্তি দেয়, সেটুকু বর্তমানের জন্যে; আর যে-অংশ তাদের
ক্ষুব্ধ করে সেটুকু ভবিষ্যতের জন্য।

১৩২
পৃথিবীতে একটি মাত্র দক্ষিনপন্থী সাম্যবাদী দল রয়েছে।
সেটি আছে বাঙলাদেশে।

১৩৩
আমাদের প্রায়-প্রতিটি মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকের ভেতরে একটি
ক’রে মৌলবাদী বাস করে। তারা পান করাকে পাপ মনে
করে, প্রেমকে গুনাহ্ মনে করে, কিন্তু চারখান বিবাহকে
আপত্তিকর মনে করে না।

১৩৪
শ্রেষ্ঠ মানুষের অনুসারীরাও কতোটা নিকৃষ্ট হ'তে পারে
চারদিকে তাকালেই তা বোঝা যায়।

১৩৫
ঋষি রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখলে বাল্যকাল থেকেই তাঁর
জন্মাব্দ ১৮৬১র আগে দুটি বর্ণ যোগ করতে আমার ইচ্ছে
হয়। বর্ণ দুটি হচ্ছে খ্রিপূ।

১৩৬
বাঙলার প্রতিটি ক্ষমতাধিকারী দল সংখ্যাগরিষ্ঠ
দুর্বৃত্তদের সংঘ।

১৩৭
কবিতা এখন দু-রকম: দালালি, ও গালাগালি।

১৩৮
বাঙলাদেশের সাহিত্যে আধুনিকতাপর্বের পর কি আসবে
আধুনিকতা-উত্তর-পর্ব ? না। আসতে দেখছি গ্রাম্যতার পর্ব।

১৩৯
পাকিস্থানের ইতিহাস ঘাতক আর শহীদদের ইতিহাস।
বাঙলাদেশের ইতিহাস শহীদ আর
ঘাতকদের ইতিহাস।

১৪০
বাঙলার বিবেক খুবই সন্দেহজনক। বাঙলার চুয়াত্তরের
বিবেক সাতাত্তরে পরিণত হয় সামরিক
একনায়কের সেবাদাসে।

১৪১
বাঙলাদেশ অমরদের দেশ। এ-দেশের প্রতি বর্গমিটার মাটির
নিচে পাঁচ জন ক’রে অমর ঘুমিয়ে আছেন।

১৪২
একবার রাজাকার মানে চিরকাল রাজাকার; কিন্তু একবার
মুক্তিযোদ্ধা মানে চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা নয়।

১৪৩
পৃথিবী জুড়ে সমাজতন্ত্রের সাম্প্রতিক দুরবস্থার সম্ভবত
গভীর ফ্রয়েডীয় কারণ রয়েছে। সমাজতন্ত্রের মার্ক্সীয়,
লেলিনীয়, স্তালিনীয় আবেদন ছিলো,
কিন্তু যৌনাবেদন ছিলো না।

১৪৪
স্বার্থ সিংহকে খচ্চরে আর বিপ্লবীকে ক্লীবে পরিণত করে।

১৪৫
অপন্যাস হচ্ছে সে-ধরনের সাহিত্য, যা বছরে
লাখ টন উৎপাদিত হ’লেও সাহিত্যের কোনো উপকার হয়
না; আর আধ কেজি উৎপাদিত না হ’লেও
কোনো ক্ষতি হয় না।

১৪৬
আঠারো তলা টাওয়ারের থেকে শিশিরবিন্দু অনেক উঁচু।
চিরকাল শিশিরবিন্দুর পাদদেশে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু অনেক
টাওয়ারের চুড়োয় উঠেছি।

১৪৭
সৎ মানুষ মাত্রই নিঃসঙ্গ, আর সকলের আক্রমণের
লক্ষ্যবস্তু।

১৪৮
বিপ্লবীদের বেশি দিন বাঁচা ঠিক নয়।
বেশি বাঁচলেই তারা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।

১৪৯
পুঁজিবাদী পর্বের সবচেয়ে বড়ো ও জনপ্রিয় কুসংস্কারের নাম
প্রেম।

১৫০
জীবনের সারকথা কবর।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেসবুক বিপ্লবে সেভেন সিস্টার্স দখল—গুগল ম্যাপ আপডেট বাকি

লিখেছেন মহিউদ্দিন হায়দার, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৩০




কিছু তথাকথিত “বাংলাদেশি বিপ্লবী” নাকি ঘোষণা দিয়েছে—ভারতের সেভেন সিস্টার্স বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে! সহযোগী হিসেবে থাকবে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী আর পাকিস্তানি স্বপ্ন।শুনে মনে হয়—ট্যাংক আসবে ইনবক্সে। ড্রোন নামবে লাইভ কমেন্টে। আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গু এনালিস্ট কাম ইন্টারন্যাশনাল সাংবাদিক জুলকার নায়েরের মাস্টারক্লাস অবজারবেশন !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২৬

বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থীদের দম আছে বলতে হয়! নির্বাচন ঠেকানোর প্রকল্পের গতি কিছুটা পিছিয়ে পড়তেই নতুন টার্গেট শনাক্ত করতে দেরি করেনি তারা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ঘিরে নতুন কর্মসূচি সাজাতে শুরু করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৫:৫৭

একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।

কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।

ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×