somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সৈয়দ হকের আত্মজীবনী ‘প্রণীত জীবন’

০৩ রা জানুয়ারি, ২০১১ দুপুর ১২:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আলবেয়ার কামুর ‘আউটসাইডার’ উপন্যাসের নায়ক তার মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে মাকে দেখতে যান। কামুর নায়ককে মনে হয় তিনি যেন মায়ের নয়, দূরের কারও মৃত্যুর খবর পেয়ে এসেছেন। ওই চরিত্রের মধ্যে বিন্দু পরিমাণেও মৃত মায়ের প্রতি আবেগ বা বিমর্ষভাবের প্রকাশ ঘটতে দেখা যায় না, বরং বিষয়টাকে খুব স্বাভাবিক বলেই বিবেচনা করতে দেখা যায়।

‘আউটসাইডার’ উপন্যাসের নায়কের এই আচরণ যতই অস্বাভাবিক আর নিষ্ঠুর মনে হোক না কেন, মনে হয় আত্মজীবনী লেখকের তার জীবনে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনার বাইরে গিয়ে আউটসাইডারের নায়কের মতো অনেকটা নির্মোহভাবে দেখা চোখে লেখা উচিত। এটা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে সম্ভবত আত্মজীবনীতে প্রকৃত সত্য উচ্চারণ সম্ভব নয়। বরং সেখানে দেখা যাবে চিন্তা বা অভিজ্ঞতার সত্যকে লুকানোর প্রবণতা।

সৈয়দ শামসুল হকের আত্মজীবনী ‘প্রণীত জীবন’ পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, এই বই তিনি নির্মেদ আবেগে জীবনকে কেবল একজন আগন্তুকের চোখে নির্মোহভাবে লিখতে চেয়েছন। অবলীলাক্রমে উপন্যাসের আদলেই তুলে ধরেছেন তার বাবা-মায়ের সম্পর্কের বিষয়ে অনেক গোপন সত্য। মনস্তাত্ত্বিকভাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন তার দাদা, বড় চাচা, বাবা ও মার ভেতরের চরিত্রটাকে। সম্ভবত এই কারণে, সৈয়দ শামসুল হকের কাছে এ বই সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, বইটি আসলে আত্মজীবনী নয়, এটা মূলত তার পরিবারেরই কথা।

‘প্রণীত জীবন’ আত্মজীবনী বা সৈয়দ হকের শৈশব-কৈশোরের পারিবারিক গল্প যাই-ই হোক না কেন, এখানে আমরা দেখতে পাই একজন দক্ষ কথাসাহিত্যিকের আশপাশের মানুষ ও নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নতুনভাবে, নতুন দৃষ্টিতে আবিষ্কার করার তাগিদ।

বইটির শুরুতেই লেখক পৃথিবীতে আমাদের জন্মগ্রহণ ও জীবন-যাপন সম্পর্কে পাঠককে চিরায়ত কিছু দার্শনিক প্রশ্নের মুখোমুখি করে নিজেই এর উত্তর সন্ধানে এক শব্দ থেকে অপর শব্দের দিকে এগিয়ে যান। জানিয়ে দেন জন্ম-মৃত্যু-ধর্ম-যৌনতা কিংবা ঈশ্বর বিশ্বাস বা অবিশ্বাস থেকে শুরু করে লেখক হিসেবে শিল্প বিষয়ে নিজস্ব বিশ্লেষণ। একসময় তিনি উপন্যাসের মতো করে, একে একে হাজির করেন তার পরিবারের বিভিন্ন চরিত্রকে যাদের বিচিত্র কর্মকাণ্ড চলচ্চিত্র দেখার মতো করেই পাঠকরা দেখতে পাবেন। তবে প্রসঙ্গত একটি কথা না বললেই নয়, এই বইটিতে কখনও কখনও ঘটনার বিবরণীতে কল্পনা কিংবা মিথ্যার আশ্রয় থাকলেও থাকতে পারে। আত্মজীবনী প্রসঙ্গে সৈয়দ শামসুল হক লেখেন :

‘কোনো আত্মজীবনীকেই আমি উপন্যাসের অধিক সত্য বলে গণ্য করি না। আত্মজীবনীকে আমি ‘প্রণীত জীবন’ বলেই জানি। এবং এই প্রণয়নের ভেতরেই ব্যক্তির মূল শাঁসটিকে পাই। যে কারো আত্মজীবনী সে পর্যন্ত সত্য যে পর্যন্ত তা মানুষটির অন্তর-সত্য প্রকাশ করে। এই অন্তর-সত্যটির স্থান বাস্তব তথ্য, ঘটনা ও তারিখের অনেক উর্ধ্বে।’

সৈয়দ শামসুল হকের বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ছিলেন একজন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার আর মা হালিমা খাতুন কেবলই গৃহিণী। তার জন্মের সময় বাবার বয়স ছিল চল্লিশ আর মা নিতান্তই কিশোরী, বয়স ষোলো বছর। তিনি এখানে অবলীলাক্রমে বাবার চরিত্রকে বিশ্লেষণ করেন একজন মনোবিজ্ঞানীর দৃষ্টি দিয়ে। সাবলীলভাবে অঙ্কন করেন বাবার কোমলতা, অন্য নারীর প্রতি প্রেম, মায়ের প্রতি নিষ্ঠুরতা বা প্রেম, বড় ভাইয়ের প্রতি ঈর্ষা ও ভালাবাসার প্রসঙ্গ ধরে বিচিত্র বিষয়ে। মায়ের সাথে সৈয়দ হকের সম্পর্ক ছিল অনেকটা ভাইবোনের মতো। তিনি তার মাকে কুড়িগ্রামের তাজমহল টকিজে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতেন। এই সিনেমা দেখার প্রসঙ্গ ধরে সৈয়দ হক আমাদের জানিয়ে দেন তার মাকে কীভাবে প্রহার করতেন তার বাবা। ফলে মায়ের ব্যক্তিত্বের বিকাশের ক্ষেত্রে বাবার মৃত্যুটাকে তিনি যেন দেখেন পজিটিভ চোখে। তিনি লেখেন :
‘নির্মলকণ্ঠে আমি বলতে পারি, আমার মা যে চৌত্রিশ বছর বয়সে বিধবা হয়েছেন- মুক্তি পেয়েছেন। তাঁকে আমি মানুষ হিসেবে জন্ম নিতে দেখেছি, বিকশিত হতে দেখেছি, একমাত্র তাঁর বৈধব্যের পরই। যদি কেউ সাক্ষাৎ দৃষ্টান্তে এর সমর্থন না পান, তবে স্মরণ করা যেতে পারে লোকশ্রুত কুমিল্লার নবাব ফয়জুন্নেসাকে, নাটোরের রানী ভবানীকে, আমার রংপুরের চৌধুরানীকে যিনি দেবী পর্যন্ত আখ্যা পান। বিধবা হবার পরেই এঁদের আমরা ব্যক্তি বলে চিনে উঠি।’

এই বইটিকে যদি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস হিসেবে দেখি, তবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে আমরা আসলে সৈয়দ শামসুল হকের বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইনকেই পাই। এখানে হক অনেকবারই নাটকীয়ভাবে ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে বাবাকে ‘সিদ্দিক’ বলে সম্বোধন করেছেন। দেখা যায় এই ‘সিদ্দিক’কে কেন্দ্র করেই যেন একে একে হাজির হন তার মা, বড় চাচা, চাচি, দাদাসহ অনেকেই। বড় চাচাকে সৈয়দ হক ডাকতেন বড় বাবা বলে, কেন ডাকতেন এর ইতিহাস বইটিতে তিনি জানিয়েছেন।

সৈয়দ শামসুল হক বইটিতে তার বাবা ‘এখানে আম কী করছি’ এমন একটি প্রশ্ন মাথায় নিয়ে কীভাবে কলকাতা থেকে হোমিপ্যাথিক ডাক্তার হিসেবে প্রথম কুড়িগ্রামে এসে এখানেই বসতি স্থাপন করেন, কীভাবে নিজ জেদে ডাক্তার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন লিখেছেন সে কথা। লিখেছেন বাবার সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে। বাবার মৃত্যুর তিন দিন আগে তিনি একটি দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠেছিলেন, অপর দিকে তার বাবাও দাদার মৃত্যুর তিন দিন আগে অপর একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই দুই সময়ের দুই সন্তানের বাবার মৃত্যুর আগে দেখা রহস্যময় স্বপ্ন নিয়ে নিজস্ব ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চেয়েছেন তিনি। খুবই সাবলীলভাবে তিনি জানান বাবার প্রেমিকাকে দেখার অভিজ্ঞতা ও ওই প্রেমিকার সঙ্গে ইংরেজ সৈনিকদের দেহসম্পর্ক নিয়ে।

সৈয়দ শামসুল হকের নাম প্রথমে ছিল শামসুল হুদা, পরে কীভাবে এটা বদলে ‘হুদা’র জায়গা নিয়ে নিল ‘হক’ লিখেছেন সে প্রসঙ্গেও।

বইটিতে তার পারিবারিক ঘনিষ্ঠজনদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে সৈয়দ হক কখনো কখনো ওই সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপটও আমাদের সামনে তুলে ধরেন। এখানে পাওয়া যায় দেশভাগ প্রসঙ্গ, দেশভাগ নিয়ে তার মনের মধ্যের বিষাদময় প্রতিক্রিয়া, পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষচিত্র, কুড়িগ্রামে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক, গ্রামে একজন ম্যাজিশিয়ানের স্থায়ীভাবে বাস শুরু ও একসময় ধনী হয়ে ওঠার প্রসঙ্গ, জলেশ্বরীর গল্পে কীভাবে উঠে এসেছে তার গ্রাম সে প্রসঙ্গ ও মুক্তিযুদ্ধসহ অনেক বিষয়। তিনি আমাদের জানান কীভাবে তার পারিবারিক বিভিন্ন অভিজ্ঞতা সাহিত্য সৃষ্টিতে এসে পড়েছে।

সৈয়দ শামসুল হক এক সময় পুরান ঢাকার মিরিন্ডা রেস্টুরেন্টে বসে লিখেছেন বহু গল্প, উপন্যাস ও কবিতা। ওই সময় কবি শামসুর রাহমানের সাথে তার আড্ডা হতো, তিনি শামসুর রাহমানের সাথে মদ ও বিয়ার পান করতেন। তিনি কিশোর বয়সে গিয়েছিলেন বোম্বাইতে সে বিষয়ে লিখেছেন।

তার বাবার মৃত্যু হয় ১৯৫৪ সালে। মৃত্যুর আগের দিন তার বাবা ১৮ বছরের সৈয়দ শামসুল হকের হাতে তার মাকেসহ পুরো পরিবারের দায়িত্বভার কীভাবে দিয়ে গিয়েছিলেন লিখেছেন সে কথা। এই লেখাটির শুরুর মতো শেষে এসেও তিনি পুনরায় জীবন বিষয়ে জন্ম ও মৃত্যুর মাঝামাঝি সময়ে ঘটমান বিষয়কে নিয়ে নানা প্রশ্নে আচ্ছন্ন হয়ে, পাঠকদের মধ্যে তিনি সেই নেশাধরানো প্রশ্নের বিষাদ ছড়িয়ে দেন। বইটির শেষে ‘প্রণীত জীবন : পূর্বাপরকথা’ শিরোনামে একটি অধ্যায় রয়েছে, যেখানে এই প্রণীত জীবন লেখার সাথে সম্পর্কিত কয়েকটি কবিতা পুরোপুরি দেওয়া হয়েছে।

‘প্রণীত জীবন’ পাঠে পাঠক সৈয়দ শামসুল হকের চিন্তাজগৎ ও জীবনযাপন সম্পর্কে জানার পাশাপাশি ভাষার জাদুময়তায় বিচিত্র দার্শনিক অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়বেন।

প্রণীত জীবন, সৈয়দ শামসুল হক, প্রচ্ছদ : সমর মজুমদার
প্রকাশক : ইত্যাদি, প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১০
মূল্য : ৩০০ টাকা
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৩:০৬

অবশেষে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতার করেছে ডিবি। এবং প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিবি জানিয়েছে সে ছোটবেলা থেকেই বদমাইশ ছিল। নিজের বাপকে পিটিয়েছে, এবং যে ওষুধের দোকানে কাজ করতো, সেখানেই ওষুধ চুরি করে ধরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×