রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এক মস্ত অভিযোগ হলো, তাঁর সাহিত্যে মুসলমানদের বিষয়ে কথা খুব বেশি নেই। যা আছে তাও খুব স্বচ্ছ নয়। রবীন্দ্রনাথ যেভাবে যীশু খ্রিস্ট বা গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, সেরকম উচ্ছ্বাস কখনই প্রকাশ করেননি হজরত মুহম্মদ [স.] সম্পর্কে। যদিও এই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা বা না করায় সাহিত্যের আসলে কিছুই যায় আসে না। তবু ব্যক্তিটি যেহেতু রবীন্দ্রনাথ, যিনি সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, চিত্রকলা কিংবা ধর্ম থেকে শুরু করে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত বিষয় নিয়েই কোন না কোনো সময় ভেবেছেন তাই আমাদের মধ্যে একটা কৌতূহল থেকেই যায় মুসলমানদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল? কিংবা বাঙালি মুসলিম লেখক সাহিত্যিকদের সাথে তার সম্পর্কই বা ছিল কেমন?
বাঙালি মুসলমান সমাজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এই সম্পর্ক নিয়েই ২০১০ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয় একটি তথ্যবহুল বই ‘রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ’। বইটি সম্পাদনা করেছেন ভূঁইয়া ইকবাল। বইটির ভূমিকা লিখেছেন আনিসুজ্জামান। পাঠকের সুবিধার জন্য বইটিকে মোট দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগে রয়েছে মুসলমান প্রসঙ্গে এবং মুসলমান-সম্পাদিত সাময়িকপত্রে প্রকাশিত কবির বিভিন্ন লেখা। এখানে শুরুতেই পাওয়া যাবে মুসলমানদেরকে উপহৃত কবিতা, শোক কবিতা, সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ও সম্প্রীতি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও কয়েকটি অটোগ্রাফ কবিতা।
আমরা রবীন্দ্রনাথের জীবন-যাপনের দিকে তাকালে দেখব যে, জমিদারি কর্মকাণ্ড পালন করতে তাঁকে বহুবার আসতে হয়েছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গে এবং মিশতে হয়েছিল এখানকার মুসলমান প্রজাদের সাথে। এখানকার আলো হাওয়ায় ঘোরাফেরা করে তিনি লিখেছেন- অনেক গল্প, কবিতা, গান ও চিঠি। হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বকে সামনে রেখে ধর্মের নামে ভারতবর্ষকে খণ্ডিত করার চেষ্টাকে তিনি স্বাভাবিকভাবে নেননি। মেনে নিতে পারেননি বঙ্গভঙ্গের বিষয়কে, এই নিয়ে তিনি পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন এবং বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগও দিয়েছিলেন।
কবি বিভিন্ন সময়ে ‘সওগাত’, ‘মোসলেম-ভারত’, ‘নওরোজ’, ‘মোয়াজ্জিন’, ‘মোহাম্মদী’, ‘বুলবুল’ ও ‘প্রবাসী’সহ মুসলমান সম্পাদিত অনেক পত্রিকাতে লেখালেখি করেছেন এবং এইসূত্রে তাঁর সাথে ওই সময়ের অনেক তরুণ বিখ্যাত মুসলমান কবি-সাহিত্যিক ও সম্পাদকদের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও সম্পর্ক তৈরি হয়। তিনি মুসলমান-সম্পাদিত নতুন পত্রিকা প্রকাশ উপলক্ষে আশীর্বাণী কবিতাও লিখেছিলেন, ওইসব আশীবার্ণী কবিতাও এখানে সংকলিত হয়েছে। যেমন-১৯২২ ও ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ কাজী নজরুল ইসলামের ‘ধুমকেতু’ ও ‘লাঙ্গল’ পত্রিকাতে বহুল প্রচারিত দুটি কবিতা লিখেছিলেন, তার মধ্যে ধূমকেতুর জন্য লিখেছিলেন--
কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু
আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু,
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু দুর্দ্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয়-কেত!
অরক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক্ না লেখা,
জাগিয়ে দেরে চমক্ মেরে’
আছে যারা অর্দ্ধচেতন!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপন্যাস ও নাটকের ‘প্লট’ দিয়েছিলেন জসীমউদ্দীন ও বন্দে আলী মিয়াকে। কাজী নজরুল ইসলামকে উৎসর্গ করেছেন ‘বসন্ত’ নাটিকা এবং নজরুল কারাগারে অনশনকালে উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনশন ভাঙ্গাবার জন্য টেলিগ্রাম করেছিলেন। এছাড়া তিনি কাজী নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দীনকে শান্তিনিকেতনের কাজে যোগ দিতে আহবান জানিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ সাথে চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল অনেক মুসলমান কবি সাহিত্যিকদের। রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, স্যার আজিজুল হক, আবুল ফজল, কাজী আবদুল ওদুদ, বন্দে আলী মিয়াসহ খ্যাত-অখ্যাত অনেকের কাছেই, ওই চিঠিগুলিও এই বইয়ের প্রথমভাগে সংকলিত হয়েছে। চিঠিগুলি পাঠ করলে টের পাওয়া যায় বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার, আঞ্চলিক/উপভাষার প্রয়োগ সম্পর্কে কবির চিন্তা। স্পষ্ট হয়ে ওঠে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক সমস্যা, দ্বন্দ্ব ও সম্প্রীতি সম্পর্কে কবির উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরবাড়ির ভারতী পত্রিকায় কায়কোবাদের ‘কুসুমকানন’ কাব্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেছেন; প্রকাশ করেছেন মীর মশাররফ হোসেনের ‘গো-জীবন’, ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ এবং ‘বিষাদ সিন্ধু’র সংক্ষিপ্ত সমালোচনা। এছাড়া তিনি কয়েকজন মুসলিম লেখকের বইয়ের উপর প্রবন্ধ ও ভূমিকা লিখেছিলেন। এই লেখাগুলিও ‘রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ’ বইটিতে সংকলিত হয়েছে।
হজরত মোহাম্মদ [সা.]-এর জন্মদিন উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ একবার বাণী পাঠিয়েছিলেন স্যার আবদুল্লাহ সোরাওয়ার্দীকে। ২৫ জুন ১৯৩৪ ওই বাণীটি প্রচারিত হয় আকাশবাণীতে, ওই বাণীটিও পাওয়া যাবে এখানে।
এখানে সংকলিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের মুসলিম হলে দেয়া অভিভাষণ, শেখ সাদীর সমাধিতে বক্তৃতা, তেহরানে জনসভায় বক্তৃতা, বাগদাদে বক্তৃতা, কামাল আতাতুর্কের মৃত্যুতে বিশ্বভারতীতে দেয়া বক্তৃতা এবং প্রগতি লেখক সম্মেলনে প্রেরিত লিখিত- বক্তৃতা, জালিনওয়ালাবাগ হত্যাকণ্ডের প্রথম বার্ষিক স্মরণসভায় প্রেরিত বক্তৃতার বাংলা অনুবাদ ও মূল ইংরেজি বক্তৃতাসহ বিভিন্ন উপলক্ষ্যে দেয়া মুসলমানদের সাথে সম্পর্কিত কবির বিভিন্ন বিবৃতি, প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবন্ধের দিকে তাকালে প্রায় ৩০ টিরও বেশি প্রবন্ধ পাওয়া যাবে যেখানে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক বিষয়ে তাঁর কোনো না কোনো বক্তব্য পাওয়া যাবে। ওই সব প্রবন্ধ থেকে কয়েকটি প্রবন্ধ সম্পূর্ণ আবার কোনো কোনোটার অংশ বিশেষ এখানে পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে।
বইটির দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের সাথে মুসলমান শিক্ষিত মধ্য ও উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের যোগাযোগের তথ্যাদি। এখানে রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে লেখা কবিতাগুচ্ছ, তার সম্পর্কে মুসলমানদের মনোভাব ও প্রতিক্রিয়া এবং তাকে লেখা বিভিন্ন চিঠি রয়েছে। রয়েছে কবির সান্নিধ্যে আসা জসীমউদ্দীন, আবুল ফজল, সৈয়দ মুজতবা আলী, বন্দে আলী মিয়া, সুফিয়া কামাল, বিজ্ঞানী কুদরত-ই-ক্ষুদা, আবদুল কাদির, কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হোসেনসহ বিভিন্ন মুসলমান লেখক ও ব্যক্তিদের স্মৃতিচারণমূলক লেখা।
এখানে সংকলিত রবীন্দ্রনাথকে লেখা বিভিন্ন চিঠি ও স্মৃতিচারণ পাঠ করলে জানা যায় কবির সঙ্গে তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ ও সম্পর্কের কথা। রবীন্দ্রনাথের কাছে কেউ গিয়েছিলেন ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধানে সাহায্য, সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে সহযোগিতা, রচিত গ্রন্থাবলি সম্পর্কে কবির মতামত ও গ্রন্থ প্রকাশে কবির সহযোগিতা লাভের জন্য। কেউ আবার গিয়েছিলেন কবির স্নেহাশীর্বাদ ও স্বাক্ষর লাভের জন্য।
অবাক ব্যপার হলো এই বইটি পাঠ করলে পাঠক লক্ষ্য করবেন- সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী মামুন, স্কুলছাত্রী জেব-উন-নেসা, মাদ্রাসাছাত্রী আমিনা মোজহার, স্কুলছাত্র ফেরদৌস খান থেকে আরম্ভ করে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আগা খান, ইরানের বাদশাহ, মুখ্যমন্ত্রী একে ফজলুল হকসহ সমাজের নানা স্তরের মুসলমানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ও যোগাযোগ ছিল।
ভূঁইয়া ইকবাল সম্পাদিত ‘রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ’ ৪৪৮ পৃষ্ঠার এই বইটি রবীন্দ্রনাথের চিন্তার জগতকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে সহায়তা করবে বলে আশা রাখি। বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা, প্রচ্ছদ করেছেন জয়নুল আবেদিনের স্কেচ অবলম্বনে কাইয়ুম চৌধুরী, মূল্য ৫০০ টাকা।
বাঙালি মুসলমানের সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না
নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন
যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা
সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন
ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১
নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন
হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়
সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।
হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন
আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই
সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন