somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পরাজয়

২৪ শে মে, ২০১১ সকাল ১১:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাগ নিয়ন্ত্রণ করে রাখার অভ্যাস আমার কম। তারপরও এতো বড় সাহসের কাজ এটাই প্রথম। বসের চোখে চোখ রেখে কথা বলেছি। মুখের ওপর জবাব দিয়েছি। রিজাইন লেটার তৈরিই ছিল- টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিয়েছি। ক্ষোভের সব কথা বলা হয়নি। রাগের মাথায় সব মনেও থাকেনা। তবে অনেক কথাই বলেছি। বসকে শুনিয়ে বসের বসকে দু-একটা গালিও দিয়েছি । অদ্ভূত চাকরি। সপ্তাহে সাতদিন। রাত নেই দিন নেই, বলদের মতো খাটছি। মাসের শেষে যা হাতে পাই তার চেয়ে ভাল ইনকাম একবেলা করে রিকশা চালালেই হয়। দু বছর ধরে শুনছি বেতন বাড়াবে। এখনো একই কথা শুনি। বেতনও বাড়েনা, ছোট ভাইয়ের সাইকেল কেনার শখও পুরণ হয়না। ছোট বোনটি এখন আর এক শিশি সেন্টের কথা বলেনা। মাঝে মাঝে ভাবি, ও কি বড় হয়ে যাচ্ছে? অনেক কিছু বুঝে ফেলছে? নিজের শখের কথা বলে বড় ভাইয়ের অসহায়ত্বকে হয়তো আর খোচা দিতে চায়না। কিন্তু ছোট ভাই বোনের মুখের দিকে তাকালেই বুকের ভেতর কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। শালার চাকরি কি জানেনা যে আমার কোন ছোট ভাই-বোন থাকতে পারে? তাদের কিছু সাধ আহ্লাদ থাকতে পারে। বাবার গায়ের আলখেল্লা আর মায়ের পরণের শাড়িটা পুরনো হয়ে যেতে পারে। জাহান্নামে যাক চাকরি। বসকে গুড বাই বলে, কলিগদের ফ্যাল ফ্যাল করা চোখগুলোতে মুহুর্তে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এসেছি।
বড়াপার বাসায় গিয়ে ওদের বড়লোকি শাওয়ারে গোসল সেরে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘন্টা দুয়েক পর ঘুম ভাঙে। বড়াপা খাওয়ার জন্য ডাকে। ওদের শান শওকতের ঘর। ভাল ভাল খাবার। দেখেই আমার চাকরি ছেড়ে আসার কথা মনে পড়ে। আশ্চর্য লাগে- সত্যিই আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি? কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয়। খাবারের ঘ্রাণ নাকে লাগে। বাসার কথা মনে পড়ে যায়। আব্বাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। ডাক্তারের সারা জীবন একই কাজ। আব্বার চোখ দেখবে। হা করিয়ে জিহ্বা দেখবে। এ কথা ও কথা জিজ্ঞেস করবে। কিছু উপদেশ দেবে। নতুন একটা প্রেসক্রিপশন লিখে আমার হতে তুলে দেবে। ডাক্তার জানে, ঐ জিনিসটার সাথে আমার পকেটের সম্পর্ক। পকেটের সাথে চাকরির সম্পর্ক। ধুস শালার চাকরি। খাবার খেতে ইচ্ছে করেনা। পকেটের ‘মিস্টার ম্যাঙ্গো’ টা ভাগ্নের টেবিলে রেখে বেরুতে বেরুতে আপাকে বললাম- চাকরিটা ছেড়ে দিলামরে! হা করে চেয়ে থাকে আমার আজন্ম চেনা বড়াপা। নিশ্চিত প্রশ্ন টশ্নের ভয়ে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বেরিয়ে পড়ি। আপা শেষ মুহুর্তে কী কী যেন বলেন- ঠিক বুঝিনা। বাড়ির দিকে পা বাড়াই।
দত্ত বাড়ির মোড়ের চেহারায় কোন পরিবর্তন নেই। আমার চাকরি ছেড়ে দেয়ায় এসব রাস্তা ঘাটের কিছু যায় আসেনা। বাস, রিক্সা, ট্যাম্পো আর মানুষের ছোটাছুটির মধ্যেই তার জীবন। বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে একটা ছোকরা চিৎকার করতে করতে মুখের ফেনা তুলছে। এ এক আজিব ভাষা। ওদের মুখে স্টেশনের নাম শোনা আর জর্জ বুশের মুখে আমেরিকান বুলি শোনার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। বাসটাকে পাশ কাটিয়ে রীতিমত দৌড়ে গিয়ে বিনোদপুরের ট্যাম্পোতে চড়ি। বসতে না বসতে ড্রাইভারের এ্যাসিসটেন্ট চ্যাংড়া ছেলেটা ভাড়ার জন্য হামলে পড়ে। মানিব্যাগ বের করে ভাংতি টাকা খুজতে থাকি। ব্যাগে মোট ছয়শ চুরানব্বই টাকা আছে। এর মধ্যেই আমার টেম্পো ভাড়া এবং সংসার খরচ। তাছাড়া এবার মাস শেষে পকেটে কোন টাকা আসবেনা। আবার চাকরির কথা মনে পড়ে। কেমন যেন অস্বস্তি লাগে।
হঠাৎ করে টেম্পো থেমে যায়। ইঞ্জিনে গড়বড়। যাত্রীরা ক্ষেপে গিয়ে যাচ্ছেতাই গালাগালি শুরু করে। চ্যাংড়া ছেলেটা জবাব দিতে গিয়েও ড্রাইভারের ধমক খেয়ে থেমে যায়। এই সব ড্রাইভার কাস্টমার (যাত্রী) ম্যানেজ করার ক্ষেত্রে বি.বি.এ গ্রাজুয়েটদের অনায়াসে হার মানাতে পারে। পারতে হয়। এটা তাদের টিকে থাকার প্রশ্ন। ড্রাইভারের কথায় মনে হয় এক্ষুনি সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যাত্রীরা নাছোড়বান্দা। পেছনের টেম্পোকে ওভারটেক করে যেতে দেখে তাদের দিশেহারা অবস্থা। একেকজন অনলবর্ষী গালিবাজ হয়ে ওঠেন। ভদ্র গোছের একজন গলা বাড়িয়ে বলেন- এখন কী হবে? নষ্ট ইঞ্জিন, ক্ষিপ্ত যাত্রী, অসহায় ড্রাইভার- কিছুই ভাল্লাগেনা। বাকি পথ হেঁটে যাব ভেবে নেমে পড়ি। খুব বেশি হলে আধা ঘন্টার পথ। হাঁটতে হয়তো ভালই লাগবে।
কিন্তু ভাল লাগার সুযোগ হয়না। মাথার ভেতর অচেনা যাত্রীর উক্তিটা বাজতে থাকে। এখন কী হবে...... এখন কী হবে...... এখন কী হবে..............। কী আর হবে? কিছুদিন লেগে থাকলে কিছু একটা হয়ে যাবে। পরিচিত জনদের বলতে হবে একটু যেন চেষ্টা তদবির করে। এরকম শুয়োরের বাচ্চা টাইপ চাকরি ছেড়ে দিয়েছি- বেশ করেছি। নিজেকে সান্ত¦না দিতে থাকি। এক সময় পথ শেষ হয়। চুপি চুপি ঘরে ঢুকে বারান্দার চৌকিতে শুয়ে পড়ি। আম্মা পুঁই শাক তুলতে এসে জানালা দিয়ে আমাকে দেখে ফেলেন।
আম্মা : কিরে! অসময়ে ফিরে আসলি যে?
আমি : কেন- মাঝে মাঝেতো এ সময়ই আসি। (এর আগে একদিন মাত্র এসেছিলাম। কিন্তু আম্মা কথা বাড়াননা)
আম্মা : খেয়ে এসেছিস?
আমি : ভাত আছে?
আম্মা : হাতমুখ ধুয়ে আয়। শিউলিকে বল ভাত বেড়ে দিতে। খেয়ে দেয়ে একটু শারমিনের বাসা থেকে ঘুরে আয়। বাবুটার নাকি অসুখ। তুইতো কাজে কাজে ওদিকে যাওয়ার সুযোগ পাসনা।
আমি : বাবু ভাল হয়ে গেছে।
আম্মা : ওমা! তুই জানলি কিভাবে? রশিদ ফোন করেছিল?
আমি : বলছি সব। তুমি ভাত বাড়ো। আমি আসছি। কথা আছে তোমার সাথে।
‘কথা আছে’- এটা কোন নতুন কথা নয়। আম্মার সাথে সব সময়ই কথা থাকে। শৈশবে কথা থাকত। কৈশোরে কথা থাকত। এখনো কথা থাকে। কিন্তু আজকের কথাটাযে কতটা ভয়ানক সেটা আম্মা টের পাননা। নির্বিকারভাবে প্রতি বেলার মত মিটসেফের সামনে বসে ভাত বাড়তে থাকেন। আমি তোয়ালে নিয়ে ভেজা হাত মুছতে মুছতে পাটিতে বসে পড়ি। কথাটা কিভাবে বলব ভেবে পাইনা। আবার বলতেও হবে। ভাতের প্লেটে লবন ছিটাতে ছিটাতে বলি- আচ্ছা আম্মা! আমার চাকরিটা যদি চলে যায়? আম্মার চোখে মুখে কোন ভাবান্তর নেই। হয়তো ধরে নিয়েছেন- কথাটা তার চাকরির প্রতি অসন্তুষ্ট, আর্থিক টানাটানিতে বিপর্যস্ত, ভবিষ্যত চিন্তায় উদ্বিগ্ন যুবক ছেলের আশঙ্কা মাত্র। তাই একটু রসিকতা করেই জবাব দিলেন- যে আবার চাকরি; তার আবার না থাকা? এরপর আর প্রসঙ্গে থাকতে পারলামনা। আম্মা বড়াপার খোজ খবর নিচ্ছিলেন। আমিও ভাত গিলতে গিলতে যন্ত্রের মতো উত্তর দিই। মাথার ভেতর একটা চিন্তা কুট কুট করতে থাকে। চাকরির ব্যাপারটা বলতেই হবে। আম্মা কী ভাববেন? আব্বা কী বলবেন? তাদেরকে কীভাবে বোঝাবো- আমি আর সহ্য করতে পারিনি। ভেবে কোন কুল পেলামনা। খাওয়া শেষ করে দাঁড়িয়ে সরাসরি বলে দিলাম- আম্মা! চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি।
আশ্চর্য ব্যাপার! কথাটা শুনে আম্মার মুখের রঙ বিন্দুমাত্রও বদলায়নি। তাঁর ভাবলেশহীন চেহারায় তাকিয়ে আমিই হতভম্ব হয়ে যাই। আম্মা কি তাঁর আস্তিকতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখাচ্ছেন? নাকি নিজের সমস্ত অনুভুতিকে ভয়ানক ধৈর্যের আড়ালে লুকিয়ে তার পরিণত সন্তানের অসহায় মুহুর্তকে শিশুর মত আগলে রাখতে চাইছেন? আমি তাঁর মুখে কিছু একটা শোনার জন্য উদগ্রিব হয়ে থাকি। কয়েক মুহুর্ত বিরতি দিয়ে আম্মা মুখ তুলে বললেন- বারান্দায় বিছানা পাতা আছে। কিছুক্ষণ শুয়ে বিশ্রাম নে। খুব স্বাভাবিক কণ্ঠ। তাঁর এ স্বাভাবিকতা আমার ভেতর ঝড় বইয়ে দেয়। খুব চীৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। এরকম মায়ের জন্য যুগ যুগ ধরে সাধনা করা যায়। পুরো পৃথিবীটাই বাজি ধরা যায়। আর আমি কিনা বসের কিছু পাগলামিই সহ্য করতে পারলামনা। রিজাইন লেটার দেয়ার সময় একবারও আম্মার মুখটা মনে পড়লনা!
সময় যত গড়ায় ততই ভয় বাড়তে থাকে। ফিরে যাওয়ার চিন্তা করে কোন লাভ নেই। একটা পোস্ট খালি হয়েছে- এটা একটা বিশাল ব্যাপার। যাদের বেকার ভাগ্নে পড়ে আছে তারা ইতোমধ্যে খবর পেয়ে গেছে। তাছাড়া এরকম ছুতানাতা পোস্টে নিয়োগের ক্ষেত্রেও কয়েকটা এক্সিকিউটিভ পকেটের সরাসরি সম্পর্ক। তারাও এখন গোঁফে তেল দিচ্ছেন। আমি আর ভাবতে পারিনা। ভয়ানক অসহায় লাগে।
এ সময় আব্বা ঘরে ঢোকেন। আমাকে সমনে পেয়েই প্রশ্ন করেন- চাকরি ছেড়ে দিয়েছিস শুনলাম; সত্যি নাকি? আব্বা কোথায় শুনেছেন জানিনা। কিন্তু ঠিকই শুনেছেন। মাথা নাড়িয়ে হাঁ বোধক ইঙ্গিত করলাম। কারণ জিজ্ঞেস না করেই জানতে চাইলেন- এখন কী করব। আব্বা অভিজ্ঞ মানুষ। জানেন কোন প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে ঘটনার প্রকৃত উপসংহার থাকতে পারে। তাঁকে হতাশ করে জবাব দিলাম- জানিনা। তারপর জানতে চাইলেন কেন চাকরি ছেড়েছি। কিছুক্ষণ ধরে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু তাঁকে সন্তুষ্ট মনে হলনা। আব্বার জীবনটাই একটা কষ্টের দুর্গ। তাই তাঁর কাছে এসব কষ্টের যুক্তি অর্থহীন। সব শুনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন- তাই বলে চাকরিটা ছেড়েই দিলি? এ অভিযোগের উচ্চারণ আমার সহ্য হয়না। আগেই বলেছি- রাগ নিয়ন্ত্রণ করে রাখার অভ্যাস আমার কম। হঠাৎ করেই মাথা গরম হয়ে যায়। উত্তপ্ত কথা বলে আব্বাকে তর্কে টানার চেষ্টা করি। সংসারের আজকের দুরবস্থার পেছনে যে তাঁর গত পঁয়ত্রিশ বছরের ব্যর্থতাই দায়ী- সে কথা আত্মবিশ্বাস নিয়ে উচ্চশব্দে প্রকাশ করি। ঝগড়ার ভাষায় যুক্তি দিতে থাকি। আব্বা ভেতরের রুমে চলে যান। একটা কথারও জবাব দেননা। আমিও আগ পিছ না ভেবে অনবরত বলতে থাকি। আম্মা ঝড়ের গতিতে ছুটে এসে কষে একটা চড় বসিয়ে দেন। কয়েক মুহুর্ত যেন পৃথিবীটাই থেমে যায়। আমরা নি:শব্দে দাঁড়িয়ে থাকি। তারপর আমি জামাটা গায়ে চড়িয়ে বোতাম লাগাতে লাগাতে বেরিয়ে পড়ি।
বেরোনোর সময় আব্বার দিকে চোখ পড়ে। হঠাৎ করেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। পৃথিবীটাই ওলটপালট লাগে। মনে হল আব্বার এমন চেহারা আগে কখনো দেখিনি। অসহনীয় কষ্টের দিনগুলোতে যিনি শুধুমাত্র সংসারের কথা ভেবে মেরুদন্ড সোজা রেখে অটল দাঁড়িয়ে ছিলেন, চেহারা দেখে মনে হল, আমার সেই বাবা আজ মেরুদন্ড ভাঙার যন্ত্রণায় কুঁচকে যাচ্ছেন। মেলাতে না পারা অঙ্কের অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছেন । হাঁটতে হাঁটতে অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকি। সংসার যার কাছে জীবনের প্রতিশব্দ তাকে কিনা আমি সংসারের কাঠগড়াতেই আসামি করেছি। একজন বাবার জন্য এ অনুভূতি কেমন হতে পারে- ভাবতেই আমার গায়ে কাঁটা দেয়। শরীরের পশম তির তির করে ওঠে। রাতের পর রাত জেগে আব্বার মেশিন চালানোর খট খট শব্দ ঘড়ির পেন্ডুলামের মত আমার মস্তিষ্কে আঘাত করতে থাকে। দুপুর রোদে ধানক্ষেতে ঘাম ঝরানো এক পুরুষের ছবি আমাকে দগ্ধ করে। আব্বার কাঁধে চড়ার শৈশব আমাকে ধিক্কার দিতে থাকে।
ভাবতে ভাবতে হাঁটি। হাঁটতে হাঁটতে সেতু আপার বাসায় পৌঁছে যাই। দু একটা কথা বলে শুয়ে পড়ি। কিন্তু মাথার যন্ত্রণাটা বাড়তে থাকে। ক্ষমা চেয়ে নেব বলে বার বার নিজেকে সান্ত¦না দিই। আব্বা ক্ষমা করে দেবেন ভেবে আশ্বস্ত হই। ক্ষমা চাওয়ার ভাষা খুঁজতে থাকি। ক্ষমা চাওয়ার শব্দ খুঁজতে থাকি। খুঁজতে খুঁজতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি।
মধ্য রাতে সেতু আপার ডাকে ঘুম ভাঙে। পানি এগিয়ে দিয়ে মুখ হাত ধুয়ে নিতে বলেন। একটা হারিকেন হাতে দিয়ে বলেন, ‘বাড়ি যা।মনে রাখিস, তুইই পরিবারে একমাত্র বয়সি ছেলে।’ আমি আপার কথার মানে বোঝার চেষ্টা করিনি। এক পা এক পা করে হারিকেনের আলোয় নিজের বাড়ির পথে হাঁটতে থাকি। দূর থেকে উচ্চস্বরে কোরআন পড়ার শব্দ শুনতে পাই। বাড়িতে ঢুকে লোবান আর কর্পুরের ঘ্রাণ পাই। ঘরে ঢুকে দেখি সাদা চাদরে ঢাকা আমার আব্বাকে ঘিরে সবাই সুরা কেরাত পড়ছে। আমি জীবনে প্রথম বার বেহুঁশ হই।
যখন হুঁশ ফিরে তখন সব কিছুই সম্পন্ন। পরিবারের একমাত্র বয়সী ছেলের জন্য কেউ দায়িত্ব ফেলে রাখেনি। আব্বাকে ওরা সাজিয়ে ফেলেছে। রাত থাকতেই কবর আর কফিন তৈরি হয়ে গেছে। সবাই জানাজার জন্য অপেক্ষা করছে। আমিও গোসল করে তৈরি হলাম। বাবার কাফন খাটে তুলে মাঠে নিলাম। জানাজা শেষ করে আবার কাঁধে তুলে নিলাম।কবরে রাখার সময় সমস্ত দরদ মিশিয়ে পড়লাম- মিনহা খালাকনাকুম, ওয়া ফী হা নুয়িদুকুম, ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম তা’রাতান উখরা.......। এক পৃথিবী শুণ্যতা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
আব্বাকে ডাক্তারের কাছে নেয়া হলনা।
আব্বার কাছে ক্ষমা চাওয়া হলনা।
মৃত্যুর সময় পাশে থাকা হলনা।
আমি কি বলে নিজেকে ব্যাখ্যা করব। বুকটা ব্যাথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে, অথবা মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে, অথবা চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে, অথবা আমার পৃথিবীটা ওলট পালট হয়ে গেছে- কিছু বলেই আমি এক সন্ত¦ানের ক্ষমা চাইতে না পারার কষ্ট বোঝাতে পারবনা। উ™£ান্তের মত ঘরের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে থাকলাম। শিউলি এসে হাতে ছোট্ট একটা কাগজ ধরিয়ে দিল বাবার হাতে লেখা একটা চিঠি।
মোতাহার,
তোর সাথে বন্ধুত্ব ছিল একুশ বছর। বন্ধুত্বের প্রশ্নে কোন মুহুর্তেই তোকে হারাতে পারিনি। তোর সাথে শত্রুতার আজ একুশ বছর। বৈরিতার প্রশ্নে তোর কাছে কখনোই হারিনি। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আজ পরাজয়ের সন্ধিপত্রে সাক্ষর করছি।
আমার আসাদের এখন ছাব্বিশ বছর। খুব ভাল ছেলে। তুই ওকে একটা চাকরি দিতে চেয়েছিলি। আমি সেদিন তোর কাছে হারতে চাইনি। আজ মেনে নিচ্ছি আমার সংসারের জন্য এ পরাজয়টা খুব প্রয়োজন। আসাদকে একটা চাকরি দিয়ে দিস। কখনো দেখা হলে তোর জিত হওয়ার স্বীকৃতি দেব। ভাল থাকিস।
আহসান

১২টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×