আমাদের এই প্রিয় দেশ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই মুসলিম। এটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপদ। ইসলাম এদেশের মূল শেকড়ের সাথে মিশে আছে। এর পেছনের মূল অবদান হচ্ছে আমাদের সেই যোগ্য পূর্বসূরী হযরত সাহাবায়ে কিরাম রা. এবং তাদের পরবর্তী তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন ও মুসলিম মহামনীষীদের সীমাহীন আত্মত্যাগ। আমরা জানি হযরত উমর রা. এর যুগেই ভারত উপমহাদেশের সাথে ইসলামের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সে সময় আরব মুসলিম ব্যবসায়ীদের সাথে এ অঞ্চলের লোকদের ব্যবসায়িক কারণেই যোগাযোগ ছিলো। আরবের সেই সকল মহান মুসলিমগণ শুধুমাত্র তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যকে শুধুমাত্র উদরপূর্তি আর পার্থিব স্বার্থ চরিতার্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে না রেখে বরং এই ব্যবসায়িক সম্পর্কের সূত্র ধরে এই উপমহাদেশে এবং এ অঞ্চলে ইসলামের প্রচার-প্রসারকেই তাদের জীবনের মূল দাওয়া হিসেবে গ্রহণ করেন। ফলে তাদের মাধ্যমেই এই উপমহাদেশে ইসলামের বীজ অঙ্কুরিত হয়।
এরপর ইতিহাস খ্যাত মহান মুসলিম বীর মুহাম্মাদ ইবনে কাসিম রহ. এর মাধ্যমে সেই ঐতিহাসিক অভিযানের মাধ্যমে এই উপমহাদেশের আনাচে কানাচে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিলো। কতিপয় হিন্দু ব্রাক্ষ্মনদের জুলুম-নির্যাতন আর মানবরচিত শাসন ব্যবস্থার জুলুমের আঁধারে নিমজ্জিত অসহায় মানবতাকে মানুষের গোলামী থেকে এক আল্লাহর গোলামীর দিকে স্থানান্তরিত করতে সেই সুদূর ইয়ামান থেকে ছুটে আসেন হযরত শাহ জালাল ইয়ামানী রহ. ও তার সঙ্গী-সাথী ৩৬০ জন মহান দীনী দায়ী। এই সকল মহামনীষীরা বৃহত্তর সিলেটের প্রতিটি প্রান্তে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছিলেন।
কিন্তু দু:খজনক বিষয় হলো, বর্তমানে আমরা মুসলিমরা দাওয়ার কাজ ছেড়ে দেয়ার কারণে বিশেষত: আমাদের দেশের আলেম-উলামাগণ ইসলামের সঠিক স্বরূপ জনগণের সম্মুখে যথাযথভাবে তুলে ধরতে না পারার কারণে বর্তমানে আমাদের দেশের আপামর জনসাধারণের সাথে ইসলামের যে নাড়ীর সম্পর্ক ছিলো তা দিন দিন দূর্বল ও ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। উপরন্তু সাম্রাজ্যবাদী সকল মিডিয়া, প্রচার মাধ্যম, বহুজাতিক কোম্পানী এবং অমুসলিম শক্তির ইসলাম বিরোধী প্রচারণা, অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং মুসলিম তরুন-যুবকদেরকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় ইসলামী আদর্শ ও তাহযীব-তামাদ্দুন আজ কোনঠাসা প্রায়। অমুসলিম শক্তি ও অনৈসলামিক শক্তি এসকল ক্ষেত্রে যতোটা অগ্রসর, আমরা যেনো ঠিক ততোটাই পিছিয়ে আছি।
১৯৭৯ সালের ১৬ এপ্রিল টাইম ম্যাগাজিনে একজন খৃষ্টান লেখকের একটি আর্টিকেল ছাপা হয়েছিলো। সেখানে বলা হয়েছে যে, ১৮০০ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত এই দেড়শত বছরে পাশ্চাত্যে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে ৬০ হাজারেরও বেশি বই লেখা হয়েছে। গড়ে হিসেব করলে দেখা যাবে যে, প্রতিদিন একটিরও বেশি বই লেখা হয়েছে ইসলামের বিরুদ্ধে এবং প্রিয়নবী সা. এর বিরুদ্ধে। আর ৯/১১ এর পরে এর প্রবণতা আরো অনেক বেড়ে গেছে। এখন তো প্রতিদিন অনেক অনেক বই ও আর্টিক্যাল লেখা হচ্ছে।
আমেরিকার খৃষ্টানদের মধ্যকার ‘জেহোভাস উইটনেসেস’ (Jehovah's Witnesses) নামক ক্ষুদ্র একটি সম্প্রদায় ‘ওয়াচ টাওয়ার’ (WATCHTOWER) নামক চার কালারের আকর্ষণীয় একটি পাক্ষিক ম্যাগাজিন প্রকাশ করে। প্রতি পনেরো দিন পর পর অর্থাৎ মাসে দু’বার। এর সার্কুলেশন হচ্ছে ২ কোটি ৮ লক্ষ ৩০ হাজার কপির অধিক। অর্থাৎ এক মাসে তারা ৪ কোটি ১৬ লক্ষ ৬০ হাজারেরও অধিক পত্রিকা ছাপায়। এটি ১৩০ টি ভাষায় বের হয়।
ছাড়াও একই সম্প্রদায় ‘‘AWAKE’’ নামক অনুরূপভাবে আরেকটি ম্যাগাজিন বের করে থাকে। যা প্রতি মাসে দু’বার প্রতিবার ১ কোটি ৬০ লক্ষ কপির অধিক প্রকাশিত হয়। এটি ৮০ টি ভাষায় প্রকাশিত হয়। এগুলোর অধিকাংশই খৃষ্টানরা ফ্রি বিতরণ করে থাকে।
১৯৮১ সনে পারিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে যে, বৃটেনের পনেরটি শক্তিশালী দৈনিক পত্রিকা সম্পূর্ণরূপে ইহুদীদের মালিকানাধীন। যা প্রতিদিন প্রায় ৩৩ মিলিয়ন ছাপানো হয়। অথচ বৃটেনের জনসংখ্যা হলো ৫০ মিলিয়ন। ৫০ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশে ৩৩ মিলিয়ন পত্রিকা সার্কুলেশন!
উপরোক্ত চিত্রের বিপরীতে বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় মুসলিমদের অবদান ও কর্মতৎপরতা যে কতটুকু, তা সকলের কাছেই সুস্পষ্ট। অবশ্য আরবী, ইংরেজি এবং উর্দূ ভাষায় মুসলিম উম্মাহর নকীবদের অবস্থান কিছুটা সুসংহত হলেও আর বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং প্রকাশনার ক্ষেত্রে বর্তমানে বিরাজ করছে বিশাল এক শূন্যতা। অন্যান্য দিকগুলোর মতো মিডিয়া এবং প্রকাশনার জগতেও ইসলামী আদর্শ ও সঠিক আকীদা-বিশ্বাস নিয়ে কর্মতৎপরতার খুবই অভাব। এক্ষেত্রে উদ্যোগও অনেক কম। নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টিকারী এবং আদর্শিক চেতনা বিনির্মাণকারী সুস্থ্য সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বই ও প্রকাশনাও একেবারেই নগন্য।
অবশ্য সামান্য কিছু উদ্যোগ এখনও আছে, অল্প কিছু প্রতিষ্ঠান ও বরেণ্য, শ্রদ্ধেয় অনেক ইসলামী গবেষক, লেখক এখনও নিভৃতভাবে দীনের জন্য প্রকাশনার মাধ্যমে কিছু কাজ করে যাচ্ছেন। দেশ এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য তাদের গ্রন্থনা, রচনা ও সৃষ্টিশীল অনবদ্য কাজের পরিমাণও অল্প আকারে হলেও বাড়ছে। তবে এক্ষেত্রে দু:খজনক বিষয় হলো, যেহেতু লেখা-লেখি এবং প্রকাশনার এই ময়দানে উলামায়ে কিরামের আসার সময়টি একেবারেই সাম্প্রতিক এবং এর পরিমাণও যথেষ্ট কম হওয়ার ফলে ইসলামী অনেক প্রকাশনা এবং গ্রন্থনার গেট-আপ, সেটাপ এবং প্রিন্টিং কোয়ালিটি তথা ছাপা, প্রচ্ছদ, বাঁধাই ইত্যাদি বিষয় গুলো অন্যান্য অনৈসলামিক ও অমুসলিম প্রকাশনা সমূহের মতো আকর্ষণীয় হচ্ছে না।
এ সবেরই মূল হচ্ছে এ বিষয়ে আমাদের সীমাহীন উদাসীনতা। আমরা আজ আমাদের সৃষ্টিশীলতাকে গঠনমূলকভাবে কাজে লাগাচ্ছি না। মিডিয়া ও প্রকাশনার মাধ্যমে বিশ্ব মানবতার কাছে নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টিকারী এবং আদর্শিক চেতনা বিনির্মাণকারী সুস্থ সংস্কৃতির প্রকাশ, প্রচার ও প্রসারে এগিয়ে আসছি না। অনেক ক্ষেত্রে এর কোনো গুরুত্বই দিচ্ছি না। যার কারণে সুস্থ সংস্কৃতি ও আদর্শিক চেতনার ইসলামী প্রকাশনার বিকাশ হচ্ছে না। বিশেষত: বাংলা ভাষায় এ ক্ষেত্রে বিরাট শূন্যতা বিরাজমান।
মহান আল্লাহ যাদেরকে মেধা দিয়েছেন, যোগ্যতা দিয়েছেন; যারা লিখতে পারেন, নতুন নতুন অনবদ্য রচনা ও গঠনমূলক লেখা সৃষ্টি করতে পারেন; তাদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, তাদেরকে প্রদান করা এই যোগ্যতা মহান আল্লাহর এক নিয়ামত, একটি আমানত। একইভাবে মহান আল্লাহ যাদেরকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা ও সম্পদের প্রাচুর্য দান করেছেন, তাদের জন্যও এটি একটি নিয়ামত ও আমানত।
যদি আজ আমরা আমাদের এই যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতাকে সঠিকভাবে কাজে না লাগাই, যদি আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী প্রকাশনার মাধ্যমে ইসলামী সাহিত্য, সংস্কৃতির বিকাশে এগিয়ে না আশি তাহলে এজন্য অবশ্যই অবশ্যই কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহর কাছে কঠিন জবাবদিহী করতে হবে।
তাই অবশ্যম্ভাব্য সেই কঠিন দিবসে আমরা যেনো মহান আল্লাহর দরবারে ভালো কিছু কাজ নিয়ে যেতে পারি, সে লক্ষ্যে আমাদেরকে সক্রিয় হতে হবে এখনই। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে বিষয়টি সঠিকভাবে বেঝার তাওফীক দিন। বিশ্বমানবতাকে বিশেষত: বাংলা ভাষাভাষী বিশাল জনগোষ্ঠিকে আমরা যেনো সত্যের দিশা দিতে পারি মহান আল্লাহ আমাদেরকে সেই তাওফীক দিন। আমাদেরকে তার দীনের জন্য কবুল করুন। আমীন।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


