somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যাকাতঃ ত্বত্ত্ব-তাৎপর্য ও বিধি-বিধান

২৩ শে অক্টোবর, ২০১০ রাত ১০:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যাকাতের পরিচয়
যাকাত শব্দটি ‘তায্কিয়াতুন’ ধাতু থেকে নির্গত। ‘তায্কিয়াতুন’ অর্থ পবিত্র করা। বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থেও যাকাত শব্দটি ব্যবহৃত হয়। যেহেতু যাকাত মানবন্ত-রকে কৃপণতার কদর্যতা এবং গুনাহের অপবিত্রতা থেকে মুক্ত করে, আর ধন-সম্পদ ও অর্থ-কড়িকে পবিত্র ও বরকতময় করে, তাই যাকাত নামে তার নামকরণ করা হয়েছে।
ইসলাম প্রত্যেক বিত্তবান ও ধনাঢ্যকে এ কথার অনুগত বানিয়েছে যে, সে হালাল রুজির অন্বেষণে সদা সজাগ ও তৎপর থাকবে। যাতে করে সে স্বীয় সন্তান-সন্ততি এবং পরিবার পরিজনদের যাবতীয় ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতে পারে। সম্ভব হলে এ উৎপাদন ও আয় থেকে আল্লাহর রাহে কিছু ব্যয়ও করবে। কিন্তু যে হতভাগা-অসহায়, কোন কাজ-কর্ম করতে পারে না এবং তার নিকটে সঞ্চিত কিংবা উত্তারাধিকারীসূত্রে প্রাপ্ত কোন সম্পদ ও গচ্ছিত নেই, যা দিয়ে সে স্বীয় জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। তার ভরণ-পোষণ এবং স্বচ্ছলতার দায়-দায়িত্ব তার আত্মিয়-স্বজনদেরকেই হাতে তুলে নিতে হবে। দারিদ্র্য ও অভাবগ্রস্ততার কালো থাবা থেকে তাকে রক্ষা করা তাদের একান্ত কর্তব্য।
কিন্তু সকল অভাবগ্রস্তের এমন সচ্ছল ও বিত্তবান আত্মীয়-স্বজন কি থাকে যে তার ভরণ-পোষণের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব বহন করতে পারে? এহেন পরিস্থিতিতে গরীব ও অক্ষম মানুষ কি অবস্থায় কালাতিপাত করবে? তার দায়িত্বভার গ্রহণ করার মত কোন নিকটাত্মীয় নেই। সীমাহীন অভাবগ্রস্ত ও অক্ষম মানুষ যেমনঃ ইয়াতীম, শিশু, বিধবা মহিলা ও অতিশয় বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা কি করে দিনাতিপাত করবে? আর তারাই বা কি করবে যাদের দৈহিক শক্তি থাকা সত্ত্বেও জীবিকা নির্বাহের কোন উপযুক্ত মাধ্যম পায় না। এ ছাড়া সে সব লোকদের কি হবে যারা কাজ করে এবং শ্রম বিক্রি করে কিন্তু কাজ ও পরিশ্রম অনুযায়ী পারিশ্রমিক পায় না। তাই সাংসারিক অনটনও তাদের কাটে না। এ সকল লোকদের কি দারিদ্র্য, বুভুক্ষা ও অভাবের উত্তাল সাগরে মৃত্যুর জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে? তারা ডুবে ডুবে মরবে আর সমাজ তামাশা দেখবে? অথচ সেই সমাজের বিত্তবান ও সম্পদশালী লোক যথেষ্ট মওজুদ রয়েছে। তারা কি তাদেরকে সব ধরণের সাহায্য সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত রাখবে? প্রকৃতির ধর্ম ইসলাম এসব লোকদের ভুলে যায়নি। আল্লাহপাক তাদের জন্য বিত্তবানদের সম্পদে নির্ধারিত অধিকার নিশ্চিত করে রেখেছেন। এ পরিমাণ আদায় করা ফরজের মর্যাদা রাখে, শরীয়তের পরিভাষায় তাকেই বলা হয় যাকাত।
যাকাতের সূচনা
আর্থিক ইবাদতসমূহের মাঝে যাকাত অন্যতম। কুরআন ও হাদীস দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত যে, যাকাতের এ ধারা ইসলাম ধর্মের জন্য কোন নতুন বিষয় নয়। নামাজ যেমন পূর্ববর্তী শরীয়তের জন্য অবধারিত ছিল, তেমনিভাবে যাকাতও ছিল তাদের জন্য নিয়মিত। ঈসা আ. দোলনায় থেকে ঘোষণা করেছেন ‘তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি ততদিন নামাজ ও যাকাত আদায় করতে।’ (মারইয়াম-৩১)
আল্লাহ তায়ালা ইব্রাহীম, ইসহাক এবং ইয়া’কুব আ. এর এক আলোচনার প্রেক্ষিতে বলেন, ‘আমি তাদের প্রতি ওহী নাযিল করেছি সৎকর্ম করার, নামাজ কায়েম করার এবং যাকাত দান করার’। (আম্বিয়া-৭৩) ইসমাঈল আ.সম্পর্কে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘তিনি তার পরিবারবর্গকে নামাজ ও যাকাত আদায়ের নির্দেশ দিতেন’। (মারইয়াম-৫৫)
এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ইতোপূর্বে শরীয়তের ইবাদতের তালিকায় যাকাত ও অন্তর্ভূক্ত ছিল। তবে পূর্ববর্তী শরীয়তে যাকাতের নিয়ম-কানুন ও বিধি-বিধান সম্পর্কে ব্যবধান থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। মক্কায় অবতীর্ণ অনেক সূরা যেমন ঃ মুমিন, নামল, লোকমান প্রভৃতি সূরায় নামাজের পাশাপাশি যাকাতের আলোচনাও রয়েছে। এরদ্বারা প্রতীয়মাণ হয় যে, যাকাতের বিধানটি হিজরতের পূর্বে রাসূলের সা. মক্কী জীবনে ইসলামের ঊষালগ্নেই হয়েছে। অবশ্য নিসাব, আদায়ের পরিমাণ, যাকাতের ব্যয়খাতসহ বিস্তারিত বিধি-বিধান তখনও নাজিল হয়নি। শুরুতেই যাকাতের রূপরেখা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ও স্বতন্ত্র। ইসলামের প্রাথমিক যুগে স্বীয় উপার্জনের প্রয়োজনাতিরিক্ত সবটুকুই সৎপথে কিংবা অভাবীদের সহযোগিতায় ব্যয় করতে হত। এটাই ছিল তৎকালিন যাকাতের অর্থ। সাহাবায়ে কেরাম স্বীয় ধন-সম্পদ, সহায়-সম্পত্তি, বিত্ত-বৈভব এমনকি নিজের বিবাহিত দম্পতির বেলায়ও অতিরিক্ত অংশটুকু নিজ ঈমানী ভাইয়ের জন্য ব্যয় করতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। এ ভিত্তিতেই অনেক ঐতিহাসিক এবং ফিকাহ ও তাফসীর বিশারদগণ যাকাতের সূচনা মক্কায় হয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। অধিকাংশ ফকীহ, মুফাসসীর এবং ঐতিহাসিকগণের বক্তব্য হল, যাকাতের সূচনা মাদানী জীবন থেকে হয়েছে। যাকাত আদায়ের যোগ্য মালের নির্ধারণ, নিছাবনির্দিষ্টকরণ, ব্যয়খাত চিহ্নিতকরণসহ বিস্তারিত বিধি-বিধান মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। দিন-ক্ষণ নির্দিষ্ট করে নিশ্চিতরূপে এ কথা বলা মুশকিল যে, যাকাতের সূচনা কখন থেকে হয়েছে?। হ্যাঁ, এতটুকু বলা যায় যে, মদীনা শরীফে হিজরী ২য় সনে রমজানের রোযা ফরজ হয়, এর সঙ্গে সঙ্গে যাকাত ও ফিৎরা ফরজ করা হয়।
যাকাতের ত্বত্ত্ব ও তাৎপর্য
দুনিয়ার বুকে মানুষের একান্ত প্রিয় ও পছন্দনীয় যত কিছু আছে তন্মধ্যে ধন-সম্পদ ও টাকা-পয়সা সর্বাধিক প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পত্তি অপেক্ষা আল্লাহ আমাদের নিকট অধিক প্রিয় কি না? তা যাচাই করার উদ্দেশ্যেই যাকাত প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ঘোষণা হয়েছে তোমাদের অত্যন্ত প্রিয় বস্তু ধন আমার জন্য উৎসর্গ করে দাও। এ উৎসর্গের ধরণ, প্রকার ও পরিমাণ দ্বারাই বুঝা যাবে কে আল্লাহকে কতটুকু ভালবাসে। যাকাত কৃপণতার মলিনতা হতে মানুষের অন্তরকে পবিত্র রাখে। কৃপণতা বাস্তবিক মানব হৃদয়ের পক্ষে একটি অতি জঘণ্য মলিনতা। মানুষ যখন তার প্রিয় ধন-সম্পদ যা তার জীবন যাপনের প্রধান উপকরণ এবং জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন। আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে দেয়, তখন কৃপণতার কদর্যতা হৃদয় হতে দূরীভূত হয়ে তাতে ঈমানের এক বিশেষ নূর, শক্তি ও দৃঢ়তা সৃষ্টি হয়। ধন-সম্পদ অধিকারীকে আল্লাহতায়ালার প্রতি স্বীয় ঐশ্বর্যের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যেই যাকাত প্রদান করতে হয়। একদিকে যখন মানুষ নিজেকে ধনৈশ্বর্যের প্রভাবে নিরুদ্বিগ্ন ও নিশ্চিন্ত অবস্থায় দেখে তৃপ্তিবোধ করে, ঠিক সে সময় অপরদিকে অন্য মুসলমান ভাইকে অর্থাভাবে দারুন কষ্টে দিনাতিপাত করতে দেখে মনে মনে বিচার আরম্ভ করে যে, এ ব্যক্তিও তো আমারই ন্যায় আল্লাহতায়ালার একজন বান্দা। আমাকে তিনি অভাবমুক্ত করেছেন এবং নিরুদ্বিগ্ন করেছেন বলে তার এ নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ গরীব-দুঃখীদের প্রতি সহানুভূতি ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করা আমার উচিত। কেননা তিনি তাকে অভাবগ্রস্ত করে আমার মুখাপেক্ষী বানিয়েছেন। এটি আমার প্রতি পরীক্ষাও হতে পারে। এমনটি বিচিত্র নয় যে, আমি গরীব দুঃখীর প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শনে যদি ত্র“টি করি, তবে তিনি আমার অবস্থা ওদের ন্যয় আর ওদের অবস্থা আমার ন্যায় করে দিতে পারেন।
যাকাত প্রদানের মাধ্যমে উচ্চ পর্যায়ের সহানুভূতির শিক্ষা দেয়া হয়েছে। পরস্পরের মাধ্যমে বিপদাপদ ও দুঃখ কষ্টের সময় এরূপ সাহায্য সহানুভূতির দ্বারা সমাজে শান্তি-শৃংখলা প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। এ মহতি লক্ষ্যেই ধনী ব্যক্তিদের উপর যাকাত ফরজ করা হয়েছে। যদি ফরয নাও করা হত, তবুও মানবতার দাবী ছিল গরীবদের সাহায্য করা, সহানুভূতিশীলতা হচ্ছে মানুষের একটি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন গুণ।
যাকাত অনাদায়ে ইহকালীন শাস্তি
ইসলাম যাকাত আদায় না করার ব্যাপারে দুনিয়া ও আখেরাতে কঠিন শাস্তির ভীতি প্রদর্শন করেছেন। মানুষ অন্যায়-অপরাধের মুলশাস্তি কেবল পরকালেই ভোগ করবে। কিন্তু এমন কিছু মারাত্মক ও জঘণ্য অপরাধ রয়েছে যার শাস্তি অপরাধ সংগঠিত হওয়া থেকেই আরম্ভ হয়ে যায়। তন্মধ্যে যাকাত অনাদায় বিশেষ উল্লেখযোগ্য। যাকাত প্রদান না করা এমন এক অপরাধ যার শাস্তি ইহকাল, পরকাল ও হাশরের ময়দানে ভোগ করে অবশেষে সীমাহীন দুর্ভোগ আর জাহান্নামের নিদারুণ যন্ত্রণা তাকে পরকালে ভোগ করতে হবে।
যাকাত প্রদান বন্ধ করলে দুনিয়াতে অভাব-অনটন-দারিদ্র্যতা, বুভূক্ষা ও দুর্ভিক্ষ নেমে আসে। আর ধন-সম্পদ ও খাবার-দাবারের বরকত তুলে নেয়া হয়। এর অনেকটারই ভুক্তভোগি আমরা । বর্তমানে বুভ্ক্ষূা আর দুর্ভিক্ষ অভিনব পদ্ধতিতে আবির্ভূত হয়েছে। আর তা হল দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, যা মানুষের ক্রয় সীমানার বাইরে। আয়-উৎপাদন অধিকহারে হলেও অস্বাদ আর রকতহীনতার কারণে তা যথেষ্ট পরিমাণ নয়। রোগ-ব্যধির পিছনে আর বিভিন্ন অশান্তি দূরিকরণে সম্পদের সিংহভাগই ব্যয় হয়ে যায়। যেমনটা লক্ষ্য করা যায় না নববী ও সাহাবী যুগে।
রাসূল সা. ইরশাদ করেছেনÑ যখনই মানুষেরা যাকাত প্রদান বন্ধ করেছে, তখনই আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বুভূক্ষা ও দুর্ভিক্ষে নিক্ষেপ করেছেন। (আত-তারগীব-১/৫৪৩) ইরশাদ ঃ যখন জাতি নিজের মালের যাকাত প্রদান বন্ধ করে দেয়, তখন আসমানী রহমত বর্ষণও বন্ধ করে দেয়া হয়। যদি তাদের মাঝে চতুস্পদ জন্তু না থাকে তাহলে তাদের উপর কোনো সময় বৃষ্টি বর্ষণ হয় না। (আত-তারগীব-১/৫৪৪)
কবর জগতের শাস্তি
যাকাত অনাদায়কারীকে কবরের মাঝে অত্যন্ত লজ্জাজনক আকৃতিতে বিবস্ত্র করে ছেড়ে দেয়া হবে। লজ্জাস্থানের অগ্র ও পশ্চাতে অপরাধ লিখিত একটি ছেঁড়া কাপড় ঝুলন্ত থাকবে। চতুষ্পদ জন্তুর আকৃতিতে সে অগ্নিতপ্ত পাথর আর জাহান্নামের অগ্নিবৃক্ষ থেকে ভক্ষণ করতে থাকবে। এ আকৃতির একদল লোককে রাসূল সা. মেরাজ রজনীতে প্রত্যক্ষ করেন। জিবরাঈল আমীনকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তরে বলেন, এরা যাকাত অনাদায়কারী স¤প্রদায়। রাসূল স. মে’রাজ রজনীতে যেসব শাস্তি প্রত্যক্ষ করেছেন তা কিন্তু কবর জগতেরই শাস্তি। (আত-তারগীব ১/৫৪১)
হাসরের মাঠের শাস্তি
আবু হুরায়রা সূত্রে বর্ণিত, নবী করীম সা. ইরশাদ করেন, যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন কিন্তু সে তার যাকাত দেয় না, তার জন্য তার সম্পদ কিয়ামতের দিন একটি বিষধর সাপ হিসাবে পেশ করা হবে। তার বিষ হবে অত্যন্ত মারাত্মক। সাপটিকে তার গলায় জিঞ্জির হিসেবে পরিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর সে তার দু'চোয়ালে দংশন করতে থাকবে আর বলতে থাকবে যে, আমিই তোমার সেই সম্পদ। (বোখারী ১/১৮৮) রাসূল সা. ইরশাদ করেনÑ যাকাত অনাদায়কৃত সঞ্চিত মাল কিয়ামতের দিন অত্যন্ত বিষাক্ত ও ভয়ঙ্কর সর্পের আকৃতি ধারণ করবে। এ সাপ দেখে যাকাত অনাদায়কারী পালানোর চেষ্টা করবে। অবশেষে সাপটির আক্রমণে কবলিত হবে। সাপটি তার আঙ্গুল দংশন করতে থাকবে। কারণ এ আঙ্গুল দিয়ে সে তার সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছিল। (আত-তারগীব ১/৫৪০)
পরকালের শাস্তি
যাকাত অনাদায়ে আখিরাতের শাস্তির প্রশ্নে আল্লাহর ইরশাদ উল্লেখযোগ্য। সোনা মজুদ করা এবং তা থেকে যারা যাকাত আদায় করে না তাদেরকে ধমক দিয়ে আল্লাহপাক বলেনÑ‘আর যারা সোনা ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের কঠোর আযাবের সু-সংবাদ শুনিয়ে দিন। সেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে। (সেদিন বলা হবে) এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা রেখেছিলে। সুতরাং এক্ষণে আস্বাদ গ্রহণ কর জমা করে রাখার’ (তাওবা ঃ ৩৪-৩৫)। এ আয়াতে যে ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশ দগ্ধ করার উল্লেখ রয়েছে তার অর্থ সমগ্র শরীরও হতে পারে। কিংবা এ তিন অঙ্গের উল্লেখ এ জন্য করা হয়েছে যে, যে কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহর রাহে খরচ করতে চায় না, তার কাছে যখন কোন ভিক্ষুক কিছু চায় কিংবা যাকাত তলব করে, তখন সে প্রথমে ভ্র“কুঞ্চন করে তারপর পাশ কাটিয়ে তাকে এড়িয়ে যায়। এতেও সে ক্ষান্ত না হলে তাকে পৃষ্ঠ দেখিয়ে চলে যায়। এ জন্য বিশেষ করে এ তিন অঙ্গে আযাব দানের উল্লেখ করা হয়। আবু হুরায়রা সূত্রে বর্ণিত রাসূল সা. ইরশাদ করেন ‘কৃপণতা একটি নারকীয় অগ্নিবৃক্ষ। যে কৃপণ সে যেন জাহান্নামের একটি বৃক্ষের ডাল আঁকড়ে ধরল এ ডাল তাকে সে ভয়ংকর জাহান্নামে নিয়েই ছাড়বে’ (মিশকাত-১৬৭)
যাকাতের উপকারিতা
যাকাত আদায়ের মাধ্যমে দুর্বলের সাহায্য হয়, কপর্দকহীন বা বিত্তহীন তাতে উপকৃত হয়। যাকাত, আদায়কারীকে গুনাহের অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করে। তার চরিত্রকে পাক-পবিত্র করে। তার মধ্যে উদারতা ও লোভ-লালসা পরিত্যগের গুণাবলী সৃষ্টি করে। আল্লাহ তায়ালার ঘোষণায় এ সব বিষয় অন্ত-র্ভূক্ত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন Ñ ‘তাদের সম্পদ থেকে একটি অংশ ছদকা হিসেবে আদায় করে তাদের পবিত্র কর’ (তাওবা - ১০৩)।
নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন বিবেক ও শরীয়ত উভয় মতেই ফরজ। যাকাত আদায় করা নিয়ামতের শোকর বা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনেরই নামান্তর। অর্থ সম্পদ একান্ত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায় একমাত্র যাকাতের মাধ্যমে। জীবনের অগ্রগতি ও আর্থিক উন্নতি সাধিত হয় এর দ্বারা। ইরশাদ হয়েছে ‘দান ছাদকাহ সম্পদ হ্রাস করে না।’ (বোখারী/মেশকাত-১৬৭)
আরো ইরশাদ হচ্ছে ‘প্রত্যহ প্রত্যুষে একজন ফেরেস্তা এ দোয়া করতে থাকেÑ হে আল্লাহ! দানকারীকে উত্তম বিনিময় ও প্রতিদান দান করুন। আর অন্য আরেক ফেরেস্তা বলতে থাকে হে আল্লাহ! সম্পদ গচ্ছিতকারীকে (যাকাত অনাদায়কারীকে) বিপদও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিন (বোখারী-১/১৯৪)। সর্বোপরি চিরশান্তি ও সুখে অনাবিল শান্তির বাসগৃহ জান্নাতে স্থান লাভ করবে। তাছাড়াও কবর হাসরসহ সর্বত্রে নিরাপদও মুক্ত থাকবে।
যাকাতের বিধি-বিধান
ইসলামী যে কোন কর্ম তথা ইবাদত সঠিক ও যথাযথ সর্বোপরি আল্লাহতায়ালার নিকট গ্রহণযোগ্য অর্থাৎ মাকবুল হওয়ার জন্য পূর্ব শর্ত হল, এ বিষয়ের যাবতীয় ইলম বা শরয়ী জ্ঞান থাকা। কোন ব্যক্তি যখন ৫২.৫০ তোলা (ভরি) রৌপ্য কিংবা ৭.৫০ তোলা (ভরি) সোনা বা তৎপরিমাণ ব্যবসার মালের মালিক হয় তখনই তার উপর যাকাতের যাবতীয় প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান জেনে নেয়া ফরজ হয়ে পড়ে। যে মাসের যে তারিখে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হল সেদিনটি ডায়েরিভুক্ত করা একান্ত কর্তব্য। এ হিসেবে এ দিনে প্রতি বছর যাকাত আদায় করবে। আরবী সন তথা চান্দ্রসন অনুযায়ী যাকাতের বছর গননা করবে। কারণ ঈসায়ী এক শতাব্দীতে হিজরী ১০৩ বছর হয়। খৃস্টীয় সন গননা করা হলে প্রতি একশত বৎসরে তিন বৎসরের যাকাত কমে যাবে। এর জন্য আপনি আল্লাহর দরবারে দায়বদ্ধ থাকবেন।
নগদ অর্থের যাকাত
৫২.৫০ তোলা (ভরি) রূপার মূল্য পরিমাণ নগদ অর্থের মালিক হলেই যাকাত ফরজ হয়ে যায়। অবশ্য এটা প্রয়োজনাতিরিক্ত এবং ঋণমুক্ত হতে হবে। এ টাকা এক বৎসর স্থায়ী হলেই ২.৫০% যাকাত প্রদান করতে হবে। ৩৫০ টাকা রূপার ভরি হিসেবে বর্তমানে নগদ অর্থের হিসাব হল ১৮৩৭৫ টাকা (৫২৫ী৩৫০)। ব্যাংকে জমাকৃত টাকার যাকাত প্রদান করতে হবে। দোকান ও বাসা ভাড়া নিতে গিয়ে যে এডভান্স প্রদান করতে হয়, এডভান্স দাতাকেও তার যাকাত আদায় করতে হবে। সমাজে এর প্রতি খুবই শিথিলতা ও উদাসিনতা পরিলক্ষিত হয়। বীমা ও সমিতির মূল টাকা ও লভ্যাংশের উভয়টির যাকাত আদায় করতে হবে। বীমা ও সমিতির সকল সদস্যের অংশ একত্রে হিসাব হবে না। বরং ব্যক্তিগত অংশ নির্ধারিত পরিমাণ হলেই কেবল যাকাত দিতে হবে। ইদানিং সমাজে জমি ও দোকান বন্ধকের খুব জোয়ার চলছে। বন্ধকের ক্ষেত্রে যে টাকা দেয়া হয় তার যাকাত ও মূল মালিকের উপর ফরজ। ব্যবসায়ীগণ ব্যবসা করতে গিয়ে ক্রেতাদের নিকট তাদের অনেক বকেয়া টাকা সঞ্চিত হয়, বকেয়া উসূলের পর হিসাব অনুযায়ী বিগত বৎসরের যাকাত আদায় করতে হবে। অন্যের নিকট পাওনা ঋণেরও একই বিধান।
যে সব নগদ অর্থের যাকাত দিতে হয় না
পাগল ও নাবালেগ শিশুর সম্পদের যাকাত দিতে হয় না। যে বেতন নিজ আয়ত্বে না এসে প্রভিডেন্ট ফান্ডে জমা করা হয়েছে তার ও বিগত বৎসরের যাকাত দিতে হবে না। বরং হস্তগত হওয়ার পর থেকে তার নতুন রূপে হিসাব হবে। বকেয়া বেতনেরও বিগত দিনের যাকাত দিতে হয় না। কারণ বেতন হস্তগত হওয়ার পূর্বে এতে তার মালিকানা সাব্যস্ত হয় না।
সোনা-রূপার যাকাত
সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা অর্থাৎ ৬১২ গ্রাম ৩৬০ মিঃ গ্রাম অথবা সাড়ে সাত ভরি অর্থাৎ ৮৭ গ্রাম ৪৮০ মিঃ গ্রাম স্বর্ণ কিংবা উভয়টি মিলে সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপা বা সমমূল্যের সোনা-রূপা কারো মালিকানায় থাকলে তার উপর যাকাত ফরজ হবে। স্বর্ণ কিংবা রৌপ্যের তৈরি যে কোন জিনিসের উপর যাকাত ওয়াজীব। গহনা-পত্র এমনকি কাপড়ের পাড়, লেস, নকশা, জরি এবং স্বর্ণ বা রূপার বোতাম ইত্যাদির উপরও যাকাত ওয়াজীব। যদিও লেস, নকসা, জরি কাপড়ের সাথে লাগানো থাকে। বর্তমানে অধিকাংশ মহিলাদের উপরই যাকাত ওয়াজীব হয়ে যায়। কারণ মহিলাদের অনেকেরই স্বর্ণালংকারের সাথে রূপার অলংকার কিংবা হাতে নগদ টাকা থাকে। এ অবস্থায় কিন্তু সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণের হিসাব হবে না বরং স্বর্ণ-রূপা বা নগদ টাকা মিলে ৫২.৫০ ভরি রূপার সমমূল্য হলেই যাকাত ওয়াজীব হয়ে যাবে। এ বিষয়ে অলংকার ব্যবহারকারিনী রমনীদের সতর্কতা অবলম্বন করা বাঞ্চনীয়। স্বর্ণ-রূপার দরের মাঝে মার্কেটে অনেক তারতম্য দেখা যায় সাধারণ স্বর্ণ রূপার একদর। আর বানানো অলংকারাদির ভিন্ন দর। আবার ক্রয় মূল্য একটি আর বিক্রয় মূল্য হয় অন্য আরেকটি। এ ক্ষেত্রে স্বর্ণরূপার মূল্য নির্ধারণ করবে তার ধরন দেখে। আর ক্রয় মূল্য হিসেবে যাকাত প্রদান করবে। মোট কথা এ ধরনের অলংকার বাজারে দোকানদার যে দরে বিক্রি করে সে দর হারে যাকাত প্রদান করবে। অনুমান ও ধারণার ভিত্তিতে যাকাত প্রদান করবে না। বরং বাজার দর দেখে সঠিকভাবে মূল্য নির্ধারণ করে তার যাকাত দিতে হবে। ধারণার ভিত্তিতে যাকাত দিলে হতে পারে কিয়দাংশের যাকাত রয়ে যাবে, আর এর জন্যও আপনাকে গুনাহগার হতে হবে। সোনা-রূপার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমনÑ দাঁত ইত্যাদি যা শরীর থেকে পৃথক করা যায় সেগুলোর যাকাত ও দিতে হবে।
পণ্যের যাকাত
নগদ অর্থ ও স্বর্ণ-রূপা ব্যতীত শুধুমাত্র ব্যবসার পণ্যেরও যাকাত দিতে হয়। এ ছাড়া অন্য কোন সম্পদের যাকাত দিতে হয় না। সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপার সমমূল্য পণ্য এক বৎসর স্থায়ী হলেই এর যাকাত দিতে হবে। যেদিন নিসাব সমপরিমাণ মালের বৎসর পূর্ণ হয় সেদিন ব্যবসায়ীর মালিকানাভূক্ত সমস্ত ব্যবসার পণ্যের যাকাত আদায় করতে হবে। যদিও কিছু মাল এক বৎসর স্থায়ী হয়নি। ব্যবসার জন্য খরীদকৃত প্লট, গরু-ছাগল, হাস-মুরগীর খামার, মৎস খামার ব্যবসার পণ্যের অন্তর্ভূক্ত। এসব মালেরও যাকাত আদায় করতে হবে। মূল্য হিসাবে যাকাত দিলে খুচরা মূল্যের হিসেবে যাকাত প্রদানই উত্তম। ধারণা ভিত্তিক যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত থাকা চাই। পরিপূর্ণমালের যথাযথ হিসাব-নিকাশ করে তিল পরিমাণ সম্পদেরও যাকাত দিতে হবে। কারণ আপনার মূল সম্পদের সাথে তিল পরিমান যাকাতের সংমিশ্রণ থাকলেও গোটা সম্পদ ধ্বংস ও বরবাদ হয়ে যাবে।
যে সব সম্পদের যাকাত ওয়াজিব নয়
নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী, ব্যবহারের জন্য নয় এমন সম্পদ এবং ব্যবসার সরঞ্জামাদির যাকাত দিতে হয় না। বাড়ি-ঘর, ঘরের আসবাব পত্র, হালের বলদ, ব্যবহৃত কাপড়-চোপড় এবং নিত্যনৈমিত্তিক ব্যবহার্য সামগ্রী প্রয়োজনীয় জিনিসের অন্তর্ভূক্ত। দোকান ঘর, কল-কারখানা, গাড়ি, নৌকা, লঞ্চ, জাহাজ, বিমান ইত্যাদি ব্যবসার সরঞ্জামাদি, তাই এর যাকাত দিতে হয় না। গৃহপালিত হাস-মুরগী, চাষাবাদের অতিরিক্ত জমি ঘরের ফার্ণিচার ইত্যাদি ব্যবসার জন্য নয়, তাই এতে যাকাত ওয়াজিব হয় না।
যাকাতের ব্যয় খাতসমূহ
১. ফকীর তথা দরিদ্র, ২. মিসকিন তথা সর্বহারা, ৩. যাকাত উসূলের কর্মচারী, ৪. মুক্তিপণ আদায়কারী দাস, ৫. ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি, ৬. গাজী বা ধর্ম যোদ্ধা, ৭. মুসাফির যে বিদেশে পাথেয় শূণ্য হয়ে পড়েছে, এ সাত শ্রেণীর যে কাউকে দিলেই যাকাত আদায় হয়ে যাবে। স্বীয় উর্ধ্বতন অর্থাৎ পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, ইত্যাদি কাউকে বা নিজ অধঃস্তন যেমন ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনি ইত্যাদিকে যাকাত দেয়া যায় না। কাফির, ধনী, বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিবের বংশধরগন যাকাতের টাকা গ্রহণ করতে পারবে না। তাছাড়া উল্লেখিত সাত শ্রেণী ছাড়া অন্য কোথাও যেমন Ñ মসজিদ, মাদ্রাসা, রাস্তাঘাট ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক কাজে যাকাতের অর্থ ব্যয় করলে যাকাত আদায় হবে না।
যাকাতের বিবিধ মাসায়েল
(১) একজন মিসকিনকে এ পরিমাণ যাকাতের সম্পদ দান করা মাকরূহ, যদ্বারা গ্রহীতার উপরও যাকাত ওয়াজিব হয়ে যায়। অবশ্য এর দ্বারাও যাকাত আদায় হয়ে যাবে।
(২) হারাম পন্থায় উপার্জিত সম্পদের উপর যাকাত ওয়াজিব নয়। উক্ত সম্পদ সম্পূর্ণ ছদকা করা ওয়াজিব। সওয়াবের নিয়্যাত না করে হারাম সম্পদের কুফল ও শাস্তি হতে পরিত্রাণের নিয়্যাতে হারাম সম্পদ ছদকা করতে হবে।
(৩) নিসাব পরিমাণ স¤পদের মালিক যদি কোন বৎসরের যাকাত বছর শেষ হওয়ার পূর্বেই আদায় করে দেয়, তাহলে করতে পারবে।
(৪) যাদেরকে যাকাত দিলে যাকাতের সম্পদ দ্বারা অধিক ফায়দা হয় এমন লোকদেরকে যাকাত দেয়া সর্বোত্তম। আত্মীয়, প্রতিবেশী ও তালিবে ইলমকে যাকাত দিলে আত্মীয়তা ও প্রতিবেশির হক্ব, এবং ইলমের সহযোগিতাও হয়। তাই এদের যাকাত দেয়া উত্তম।
সদকায়ে ফিতর
সাদকায়ে ফিতর ফরজ করা হয়েছে রোজাকে ভুল-ত্র“টি থেকে পবিত্রকরণ এবং দরিদ্রের পানাহারের উদ্দেশ্যে। যে মুসলমানের নিকট ঈদের দিন সুবহে সাদিকের সময় প্রয়োজনীয় তৈজষপত্রের অতিরিক্ত এবং ঋণমুক্ত সম্পদ রয়েছে, যার মূল্য হয় সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপা পরিমাণ তার উপর সাদকায়ে ফিতর দেয়া ওয়াজিব। চাই সে সম্পদ ব্যবসায়ের হোক বা না হোক। পূর্ণ এক বৎসর স্থায়ী হোক বা না হোক। যে ব্যক্তি কারণ বশতঃ রোজা রাখতে পারেনি, তার উপরও সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব। যে সন্তান সুবহে সাদিকের পর ভূমিষ্ঠ হয়েছে তার পক্ষ থেকে সাদকা দেয়া ওয়াজিব নয়। প্রয়োজনাতিরিক্ত গাড়ি-বাড়ি, দোকান-মার্কেট, সোনা-রূপা, অতিরিক্ত জায়গা, জমি, ঘরের ফার্ণিচার, অতিরিক্ত কাপড়-চোপড়, মিল-কারখানা ইত্যাদি সাদক্বায়ে ফিতরের হিসেবে ধর্তব্য হবে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের সাদকা পিতার উপর ওয়াজিব। বালেগ ও স্ত্রীর ফিতরা বাপ ও স্বামীর উপর ওয়াজিব নয়।
সাদকায়ে ফিতরের পরিমাণ
ফিতরের পরিমাণ হল- মাথা পিছু অর্ধ ছা’ গম, আটা, অথবা গমের ছাতু। খেজুর বা কিসমিস দিয়ে আদায় করতে চাইলে পূর্ণ এক ছা’ দিতে হবে। প্রচলিত মাপ অনুযায়ী অর্ধ ছা’ এর পরিমাণ হল ৮০ তোলায় এক সের সাড়ে বার ছটাক, আর কিঃগ্রাঃ হিসাবে ১কি, ৫৭৪গ্রাম ৬৪০ মিঃ গ্রাঃ । তবে পূর্ণ ২ সের বা দুই কিঃ আদায় করে দেয়াই উত্তম। সুতরাং দুই কিঃ গ্রাঃ আটার মূল্য বা এ পরিমাণ অন্য কোন বস্তু যাকাত গ্রহণের যোগ্য কাউকে দিলেই সাদক্বা আদায় হয়ে যাবে। এ সাদকা ঈদের নামাযের পূর্বেই আদায় করতে হবে। দেরি করলে গুনাহগার হবে। একান্ত কারণ বসতঃ দেরী হয়ে গেলে পরে হলেও আদায় করে দিবে। ‘মিনহাতুল খালেক’ নামক কিতাবে উল্লেখ রয়েছে যে, রাসূলের সা. যুগে সাহাবাগণ ঈদের দিনের আগেই ফিতরা আদায় করে দিতেন।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ
আদান-প্রদান ও লেন-দেনের সুবিধার্থে একটি একান্ত ডায়রি কিংবা বিশেষ একটি নোটবুক বা ব্যক্তিগত কোন খাতা আপনার সংগ্েরহ রাখুন। এতে আপনি ঋণের তালিকা নোট করতে পারেন। কোন অছিয়ত থেকে থাকলে তাও লিপিবদ্ধ করে রাখুন। অনুরূপভাবে সে দিনেরটি নোট করুন, যেদিন আপনি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন। একটি কথা লক্ষ্য করুণÑ আপনি কিন্তু আরবী তারিখ লিখতে ভুল করবেন না। মহিলাগণ তাদের বিয়ের তারিখও লিখতে পারেন। এতে আপনি যাকাত আদায়ে বিভ্রান্তিতে পড়বেন না। এবার আপনি প্রশান্ত চিত্তে আনন্দভরে আগামী বৎসরে সে দিনটির অপেক্ষায় প্রহর গুণতে থাকুন। মনে-প্রাণে, অঙ্গে-প্রত্যঙ্গে বা মুখের ভাষায় আল্লাহর শোকর আদায় করতে থাকুন। তিনি যে আপনাকে এতো সম্পদ দিয়েছেন, তা একমাত্র তাঁর অনুগ্রহ বৈ কিছু নয়। ফকীর-গরীব, কিংবা কোন কল্যাণমূলক কাজে আপনার সহযোগীতা কামনা করা হলে, আপনি ঋণের ঐশ্বর্যে অতীত ভুলে গিয়ে তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন ও তুচ্ছ জ্ঞান করবেন না। হালাল রিযিকের আশায় এ মাল দিয়ে ব্যবসা করতে থাকুন। এক দু’দিন করে যখন পরবর্তী বৎসরে সেদিনটি ঘনিয়ে আসবে। তখন আপনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়–ন। কারণ আপনি আল্লাহর মহান একটা ফরজ আদায় করতে যাচ্ছেন। দানকারী আর দানবীর হবেন পত্র-পত্রিকায় আপনার নাম ছাপবে মিডিয়ায় আপনার ঘোষণা হাঁকবে সে জন্য নয়। স্বীয় মাহবুব আল্লাহর নিমিত্তে কিছু ব্যয় করতে পারছেন সে আনন্দে। অন্যদিকে আপনি খুব সতর্ক ও আতঙ্কিত থাকুন যে দিনক্ষণ, হিসাব নিকাশ অথবা নিষ্ঠারকারণে আমার যাকাত কোন আবার বিফলে চলে যায়নি। মনের এককোণে যাকাত প্রদানের নিয়ামতের আশা লুকিয়ে রাখুন। আরেক কোণে যাকাত অনাদায়ে ঘোষিত শাস্তিতে প্রকম্পিত থাকুন। এবার যখন চন্দ্র মাসের সে দিনটি আসবে আপনি কাগজ কলম নিয়ে হিসাব নিকাশে বসে পড়ুন। প্রয়োজনে কোন কেরানী কিংবা দক্ষ হিসাবীর সহযোগিতা গ্রহণ করতে পারেন। খুব তাড়াতাড়ি হিসাব করে ফেলুন। কারণ যাকাত আদায়ে বিলম্বিত হলে গুনাহগার হতে হবে। অগত্যা কোন বিপদ এসে আপনার সব সম্পদ ধ্বংস করে দিলে, কিন্তু আপনি দায়বদ্ধ থেকেই যাবেন। খোদা না করুক আপনার মৃত্যু হয়ে গেল, আর যাকাত আপনার দায়িত্বে রয়ে গেল তখন পরকালে আপনার কি দশা হবে? বেহুদা রমজানের অপেক্ষা করবেন না। যথা নিয়মেই আদয় করে ফেলুন। অবশ্য একটা কাজ করা যায়। এক বছর সাল তামামির পূর্বে রমজানে যাকাত দিয়ে ফেলুন। এরপর থেকে প্রতিবছর রমজানই হবে আপনার যাকাত আদায়ের মাস। এতে রমজান আপনার বৎসরের শেষ মাস হবে। এবার আপনার দোকানের, গুদামের ও ফ্যাক্টরীর যাবতীয় পণ্যের তালিকা তৈরি করে ফেলুন। একটি সুইও যাতে বাদ না পড়ে। খুব সতর্ক থাকুন। ঐ দিন বাজারে পণ্যের যে খুচরা মূল্য থাকে লিস্টের মাঝে সে দর পণ্যের সামনে লাগিয়ে দিন। অহেতুক পাইকারী রেট ধরে যাকাত কমানো ঠিক না। গরীবদের ঠকিয়ে কোন লাভ নেই। নতুবা আল্লাহও আপনাকে ঠকিয়ে দিবেন। যোগ করে দেখুন সর্বমোট কত হয়। এবার আপনার বকেয়া খাতা খুলুন। সম্পূর্ণ বকেয়া টাকা যোগ করুন। পণ্যের মূল্যের সাথে যোগ করে ফেলুন। বকেয়া টাকা যখন উসুল হবে তখন যাকাত দিতেই হবে। এখনই দিয়ে ফেলুন তো আপনি দায়িত্বমুক্ত হয়ে গেলেন। পরবর্তীতে ১০০ /২০০ করে বকেয়া উসুল হয় এর হিসাব রাখা ও যাকাত দেয়া জটিল হয়ে পড়ে। এবার হিসাব করুন আপনার নগদ টাকা আছে কি না? ব্যাংকে সঞ্চিত টাকাও উপরের অংকের সাথে যোগ করুন। দোকান ও বাসা ভাড়া নিতে গিয়ে কোন এডভান্স প্রদান করেছেন কি না? তাও যোগ করে ফেলুন। কারণ এগুলো সব আপনার সম্পদ। আর রয়ে গেল মাত্র একটি বিষয়। কারো কাছে আপনার পাওনা টাকা আছে কি না? এটাও যোগ করতে ভুলবেন না। পুরুষের তো সাধারণত সোনা-রূপা থাকে না। থাকলে এগুলোর মূল্যও যোগ করুন। এবার যোগের কাজটা সেরে ফেলুন। পুণরায় যোগটি ভালভাবে নিরিক্ষণ করুন। সাবধান ভুল যাতে না হয়। যোগফলটি সুন্দর করে লিখুন। একটি বিষয় লক্ষ্য করুন। সোনা-রূপা, টাকা-পয়সা, পণ্য দ্রব্য ছড়া অন্য কিছুই হিসাবে আনতে হবে না। দেখুন এ টাকায় অন্য কোন অংশীদার আছে কি না? থাকলে ভাগ করে ফেলুন। অতঃপর যাকাত বের করুন। আপনার কোন সমিতি বা বীমা আছ কি না? সেখানে আপনার মূল টাকা ও লভ্যাংশ জেনে নিন এবং যোগ করুন।
এ পর্যায়ে আপনি ঋণের খাতা খুলুন। দেখুন আপনার যাবতীয় ঋণের পরিমাণ কত? উপরোক্ত যোগফল থেকে ঋণ বিয়োগ দিয়ে দিন। মনে রাখুন মহর এবং আল্লাহর ঋণ যেমন- মান্নত, কাফ্ফারা ইতাদি কিন্তু কর্তন করবেন না। এবার বিয়োগ ফলটি ৪০ দিয়ে ভাগ করুন। ভাগফল যা বের হবে তাই হবে এ বছরের আপনার যাকাত। ইহা আদায় করুন। আচ্ছা আপনি যদি মহিলা হয়ে থাকেন। আপনার কি শুধু স্বর্ণের অলংকারই আছে? রূপা-টাকা-পয়সা-ব্যবসা-বাণিজ্য কিছু নেই? তাহলে জেনে নিন এ স্বর্ণ সাড়ে সাত ভরি কি না। আর যদি স্বর্ণের সাথে রূপা, নগদ অর্থ, বা ব্যবসার মাল থাকে তাহলে সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপার সমমূল্য কি না তা জানুন।
স্বর্ণকারের নিকট গিয়ে জিজ্ঞাসা করুন এ স্বর্ণগুলো কত টাকা দরে বিক্রি করে। ঠিক সেই দর হিসেবে হিসাব করুন। আপনার যত টাকার সোন-রূপা আছে এর সাথে আপনার নগদ অর্থ এবং ব্যবসার পণ্যের মূল্য যোগ করে ঋণ কর্তন করুন। আপনি যে মহর স্বামীর কাছে পাওনা তা এখন যোগ করতে হবে না। ৪০ ভাগ করে ফেলুন। এ ভাগ ফলটি আপনার যাকাত। এখন আপনি ৪০/১ পরিমাণ টাকা ভিন্ন করে রাখুন। মনে মনে নিয়ত করে ফেলুন এটি যাকাতের টাকা। কাউকে উহা আদায় করার দায়িত্বও দিতে পারেন। এবার আপনি যাকাতের বোঝা মাথায় নিয়ে ফকীর মিসকিনের খোঁজে বের হয়ে পড়–ন। খুব চুপে চুপে। যাকাতের ঘোষণা-বিবৃতির কোন দরকার নেই। রমজান বা ২৭ তারিখের অপেক্ষা কেন করবেন? খবরদার! সাবধান! এমন যাতে না হয়, যাকাত প্রদানের তারিখ নির্ধারণ করে, সিরিয়াল লাগিয়ে সব ফকির জমা করে দরবার বসালেন। কেন এমন করবেন? এত লৌকিকতা। যাকাত তো আল্লাহর জন্য। আল্লাহ তো গোপন। তার তার জন্য চুপি চুপি দিয়ে ফেলুন। আরো খোঁজ করতে থাকুন ফকীরের। এ জন্য কোন গরীব আপনার কাছে এসে পড়লে তা গনীমত মনে করুন। এতো আপনার সৌভাগ্য। আপনার প্রতি ফকীরের দয়া। সে আপনার খোঁজা-খুজির বিশাল কাজ সমাধা করে দিল। ফকিরকে ধমক দেয়া, সিরিয়াল লাগিয়ে কয়টা পিটা ও দেয়া এ কেমন কথা ছিঃ! ছিঃ! ধিক্কার এসব ধনীদের। মনে মনে যোগ বিয়োগ দিন। যাকাতটি কাকে দিলে বেশি লাভ হবে। আগে দেখুন আপনার আত্মীয়দের মাঝে কোন গরীব আছে কি না? এ আত্মীয় যদি প্রতিবেশি হয় এবং ইলমের খাদেমও হয় তাহলে তো সবচেয়ে বেটার। একেই দিয়ে দিন। মনে রাখুন আত্মীয়, প্রতিবেশি ও তালিবে ইলম এরাই এই সম্পদের বেশি হকদার। এদের কাউকে না পাওয়া গেলে অন্য কোন ফকিরকে দিয়ে দিন। দূরে কোথাও অভাবী থাকলে সেখানেও পাঠিয়ে দিতে পারেন। সাবধান! আপনার দোকান বা ফ্যাক্টরীর অকেজু ও অচল মাল যাকতে চালিয়ে দিবেন না।
উত্তম ও ভাল মাল দিয়ে যাকাত প্রদান করবেন। মনে মনে ভাববেন না, যা দিচ্ছি আল্লাহকে দিচ্ছি। তো আল্লাহ কি এত নিকৃষ্ট যে, আপনার অচল মালগুলো এখানে চালিয়ে দিলেন। লক্ষ্য রাখুন, আপনার যাকাত গ্রহীতা নেককার, পরহেজগার কি না? খুব সতর্ক থাকুন সে আপনার যাকাত নিয়ে কিভাবে ব্যয় করে। কোন অন্যায় অপরাধে ব্যয় করে আপনাকেও গুনাহের ভাগিদার বানায় কি না? বর্তমানে অনেক ফকিরের ব্যাংক ব্যালেন্স থাকে। এ বিষয়ে ও সতর্ক থাকুন এবার সব টাকা প্রদান করার পর আপনি দায়িত্ব মুক্ত হলেন। বিশাল এক বোঝা আপনার মাথা থেকে সরে গেল। আন্দিত হোন যে, যথাযথভাবে একটি ফরজ আঞ্জাম দিতে সক্ষম হয়েছেন। অতঃপর দুই রাকাত শোকরের নামাজ আদায় করে এ যাকাত কবুল হওয়ার জন্য দোয়া করুন।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদির হত্যাকান্ড ও সরকারের পরবর্তি করণীয়!

লিখেছেন আহলান, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫১

হাদির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সে দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ইনসাফের জীবন এনে দিতে সংগ্রাম করেছে। তাকে বাঁচতে দিলো না খুনিরা। অনেক দিন ধরেই তাকে ফোনে জীবন নাশের হুমকি দিয়ে এসেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব রাজ্যে উত্তেজনা: হাদির মৃত্যুতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪২

রোম যখন পুড়ছিল নিরো নাকি তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল; গতরাতের ঘটনায় ইউনুস কে কি বাংলার নিরো বলা যায়?



বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদটি সবসময় ছিল চ্যালেঞ্জিং।‌ "আল্লাহর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×