২০০৮ সালে যখন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ আইপিএল এর পর্দা উন্মোচিত হয়, প্রথম ম্যাচেই আলো ছড়িয়ে ছিলো ব্র্যান্ডন ম্যাকালামের ব্যাট। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর এর বিরুদ্ধে ম্যাকালামের ৭৩ বলে খেলা ১৫৮ রানের ইনিংসটি যেন পরিণত হয় টি ২০তে বিস্ফোরক ব্যাটিং এর আদর্শ উদাহরণ হিসেবে! সেই ম্যাকালাম এবারের মৌসুমে অধিনায়কের দ্বায়িত্ব পেয়েছেন, হারিয়েছেন ব্যাটিং এর ঔজ্জ্বল্য! ২০০৯ এর আইপিএল এ সাত ম্যাচে তার সংগ্রহ ৫০ রান, সেরা ২১! আর এবারো ম্যাকালামের ব্যাটিং যেন পুরো কলকাতা নাইট রাইডার্স দলেরই প্রতিচ্ছবি-ভংগুর, অস্থিতীশীল ও নৈরাশ্যজনক।
আইপিএল যতটা ক্রিকেটের আসর তারচেয়ে বড় ব্যবসা, ভারতের শিল্পপতি ও সিনে তারকারা বিভিন্ন দেশীয় ও বহুজাতিক সংস্থার সহায়তায় ক্রিকেটের মোড়কে প্রচার করছেন বিভিন্ন পন্যের বিজ্ঞাপণ। সেই কারণে ২০০৮ এর আসরে শীর্ষ চারে উঠতে না পারলেও সবচেয়ে লাভবান দলটির নাম কলকাতা নাইট রাইডার্স। এবারো খেলোয়াড়দের পোশাককে বিজ্ঞাপণের বোর্ড বানিয়ে টিভি পর্দায় হাজির আইপিএল। তাই এখানে যে ক্রিকেটীয় প্রজ্ঞার চেয়ে ব্র্যান্ডিং প্রসার পাবে সেটা খুবই স্বাভাবিক। তাই তো নতুন মিউজিক ভিডিও, বিজ্ঞাপণ আর মোহনীয় চিয়ার লীডারদের নিয়ে হাজির শাহরুখ ‘কিং’ খানের কলকাতা নাইট রাইডার্স। কিন্তু এই দলে ক্রিকেটের অবস্থান, একেবারে তলানীতে।
আইপিএল এ নেই কোন রেলিগেশন বা অবনমন। তাই দল খারাপ করলেও ব্যবসায়ীদের কিছু আসে যায় না! স্পন্সর, টিভি স্বত্ব আর বিলবোর্ড বিজ্ঞাপণ থেকে টাকা আসলেই হলো, ক্রিকেটের মান বাড়ানোর অনেক সময় আছে! আর সেই স্পন্সরদের চাপেই ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকায়!
চার অধিনায়ক তত্ব, টুর্নামেন্ট শুরুর আগে সুনীল গাভাস্কার-শাহরুখ খানের বাদানুবাদ, অধিনায়ক পরিবর্তন, অজ্ঞাতনামা ব্লগারের ড্রেসিং রুমের গোমর ফাঁস, মাশরাফির সাথে চুক্তি নিয়ে জলঘোলা করা- সব মিলিয়ে হিন্দী সিরিয়ালের সব উপকরণই ছিলো নাইট রাইডার্স শিবিরে। শুধু ছিলোনা মানসম্মত ক্রিকেটার। আইপিএল এর নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ম্যাচে সর্বোচ্চ চারজন বিদেশী খেলোয়াড় খেলতে পারবে, অর্থাৎ বাকী সাতজনকে হতে হবে ভারতীয় খেলোয়াড়! এই সহজ সূত্রটাই বুঝতে পারেননি বুকানন-জয় ভট্টচার্যরা। ম্যাকালাম-গেইল-ব্র্যাড হজদের পাশে তাই আকাশ চোপড়া-সঞ্জয় বাঙ্গার –লক্ষীরতন শুক্লা- অজিত আগারকার। যারা জাতীয় দল থেকে ব্রাত্য হয়েছেন অনেক আগেই। ক্রিকেটে পরিসংখ্যান অনেক সময়েই মিথ্যা আবার কখনো সত্য। কারণ দিন শেষে হারজিতের যে অংক সে তো পরিসংখ্যান থেকেই আসা। এবারে নজর দেওয়া যাক কলকাতা নাইট রাইডার্স দলের খেলোয়াড়দের পরিসংখ্যানের দিকে।
আকাশ চোপড়া-রঞ্জি ট্রফিতে দিল্লী দলের উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান, ভারতীয় দলের জার্সী গায়ে ১০টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন। সেখানে স্ট্রাইক-রেট ৩০ এর একটু বেশী। কখনো একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে ভারতীয় দলে ডাক পাননি। রান করার চেয়ে মাটি কামড়ে ক্রিজে পড়ে থাকার জন্য খ্যাতিমান এই খেলোয়াড়কে নেওয়া হয়েছে টুয়েন্টি ২০ একাদশে। তারপর তাকে টুর্নামেন্টের মাঝখানে আবার দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে, ফিরে এসে আকাশ চোপড়া আবার ‘ম্যাক্স’ স্যাটেলাইট চ্যানেলে বিশেষজ্ঞের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ম্যাচ বিশ্লেষণ করছেন! সত্যিই সেলুকাস! এমন আরেক খেলোয়াড় সঞ্জয় বাঙ্গার, ভারতীয় রেলওয়ের উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান ও বোলার। ভারতীয় দলের হয়ে ১২টি টেস্ট ম্যাচ ও ১৫টি একদিনের ম্যাচ খেলেছেন। বেশ কিছু টেস্ট ম্যাচে ওপেনার এর ভূমিকাও পালন করেছেন মনোজ প্রভাকরের আদর্শে অনুপ্রাণিত এই ‘অলরাউন্ডার’। গত বছর তিনি ছিলেন ডেকান চার্জার্স দলের সদস্য। আইপিএল ২০০৮ এ ডেকান চার্জার্স দলের অবস্থান ছিলো আট দলের মধ্যে অষ্টম। আর ২০০৯ এর আসরে এখন পর্যন্ত নাইট রাইডার্সের অবস্থানও তাই। এবং এই অবস্থান যে সহসা পরিবর্তন হবে এমনটাও মনে হচ্ছে না। নিজেকে নিশ্চয়ই লাকী চার্ম ভাবছেন না বাঙ্গার!
এবার আসা যাক নাইট রাইডার্স দলের বোলিং আক্রমণের ব্যাপারে। দলের একমাত্র বর্তমান ভারতীয় দলের সদস্য, বল হাতে ভারতের নতুন সেনসেশন ঈশান্ত শর্মা। তার সাথে আছেন অজিত আগারকার, লক্ষ্মীরতন শুক্লা ও অশোক দিন্দা। পরপর সাতটি ম্যাচে শুন্য রানে আউট হওয়ার কারনে মুম্বাই ডাক বা ০০৭ উপাধি পাওয়া এই ক্রিকেটার সর্বশেষ ওডিআই খেলেছেন ২০০৭ সালে। এরপর তার দলে ডাক না পাবার কারণ, খরুচে বোলিং। একদিনের ম্যাচে আগারকারের ইকোনমি রেট ওভার প্রতি ৫ রানের বেশী। টুয়েন্টি ২০ তে ইকোনমি রেট ৮ ছাড়িয়ে গেছে। লক্ষ্মী রতন শুক্লা সেই কবে ১৯৯৯ সালে তিনটে ওয়ানডে ম্যাচে খেলেছিলেন, তাতে শিকার মোটে ১ উইকেট আর ব্যাট হাতে সর্বমোট ১৮ রান। এই হলো শুক্লার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যান। ইকোনমী ৫ এর কোঠায়। তারপর সংগত কারণেই আর ‘ইন্ডিয়া’ খেলা হয়নি এই অলরাউন্ডারের। প্রতিপক্ষের রান উৎসবে লাগাম পরানোটা তাই ঈশান্তের একার কাঁধে। তরুণ ঈশান্তের ওপর প্রত্যাশার চাপটা মনে হয় বেশীই হয়ে গেছে। প্রথম আসরের প্রতিশ্রুতিশীল বোলার আশোক দিন্দাও রানের বন্যায় বাঁধ দিতে পারছেন না। বরং ক্রিস গেইল, ভ্যান উইক কিংবা ব্র্যাড হজের মতো পার্ট-টাইমাররা অনেক ভালো ফল বয়ে নিয়ে আসছেন।
এবার বহুল আলোচিত বুকানন প্রসংগ। জন বুকানন, অস্ট্রেলিয়া দলের প্রাক্তণ কোচ। তার নেতৃত্বে অনেক সাফল্য আছে অসি দলে। কিন্তু এখানে এসে কি হলো বুকাননের, যে বলে বসবেন আইপিএল এর চাপ নিতে পারছেন না! বারবার নিজের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলবেন। কারণ মাঠের পারফর্ম্যান্স। তার অধীনে অস্ট্রেলিয়া দলে ছিলো মার্ক ওয়াহ, স্টিভ ওয়াহ, ম্যাথু হেইডেন, ম্যাকগ্রা, গিলক্রিস্ট, মার্টিন দের মতো খেলোয়াড়। আর কেকেআর দলে আছে আকাশ চোপড়া -সঞ্জয় বাঙ্গার- অজিত আগারকারের মতো খেলোয়াড়। তাই তাদের কাছ থেকে আইপিএল এর মতো প্রতিযোগিতামূলক পর্যায়ে টুয়েন্টি ২০তে ভালো ফল আশা করা আর চৈত্রের গরমে তুষারপাতের আশা করা একই কথা। অবশ্য পাড়ার ক্রিকেট হলে ভিন্ন কথা!
তাই ভূলটা বুকাননের নয়, খেলোয়াড়দের ভূল নয়, আমাদের নিজেদের, দর্শকদের। আমরা যারা প্রতিবেশী অংগরাজ্য বলে, বাংলা ভাষা- ভাষী বলে কলকাতা নাইট রাইডার্সের সমর্থক বনে যাই, মাশরাফীকে ওদের দলে টানা নিয়ে বেলুন ওড়াই। কিন্তু ভুলে যাই ওদের কাছে ক্রিকেট মানে ব্যবসা, ক্রিকেটাররা এখানে সিনেমার জুনিয়র আর্টিস্টদের মতোই নগন্য আর নায়ক-নায়িকার আসনে স্পন্সর গোষ্ঠী। যারা আকাশ চোপড়া-আগারকার-বাঙ্গারকে টি ২০দলে ভেড়ায় তাদের ক্রিকেটীয় প্রজ্ঞা আর মেধার দৌড় কত টুকু তা বুঝতে আর বাকী নেই। মাশরাফীকে দলে নেওয়াটাও ছিলো বাংলাদেশের মানুষের জনসমর্থন আদায়, এখানকার বাজারে বিজ্ঞাপণ প্রচারের এক নয়া ফন্দি। মাশরাফীর ক্রিকেট যোগ্যতা সেখানে মুখ্য নয়,তাইতো দক্ষিণ আফ্রিকার ‘আইপিএল’ এ মাশরাফী অকেজো। তাই হেনরিকসরা খারাপ করেও দলে থাকেন আর মাশরাফি পানির বোতল টানেন!
দিনের শেষে তাই রানরেট আর ওভাররেটের বদলে এয়ারটাইম রেট আর বিলবোর্ড রেটের হিসেব। দল হারুক কি জিতুক, কিং খান আছেন, তার ভক্তরা আছেন। স্পনসররা আছে, টাকা আসছে। ম্যাচ জিতে কি হবে?
আলোচিত ব্লগ
পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট
পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট

পানি জীবনের মূল উৎস। এটি ছাড়া কোনো প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন:
وَجَعَلۡنَا... ...বাকিটুকু পড়ুন
মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)
ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)
০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন
হাদিকে shoot করে লাভবান হলো কে?

শরিফ ওসমান হাদি যিনি সাধারণত ওসমান হাদি নামে পরিচিত একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মী ও বক্তা, যিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ত্রয়োদশ... ...বাকিটুকু পড়ুন
আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।
ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।