আমার আজকের কবিতাটি লিখেছিলাম দু’বছর আগে কথিত ক্রসফায়ারে নিহত কমিশনার একরামুলের মেয়ে দু’টোর জন্য,
আজ আবার দিলাম নিহত সিনহার মার জন্য।বারবার দেই
আর যাতে দিতে না হয় কোনদিন আমার এই কবিতা, এটাই যেন শেষবার হয়।
এটা একজন কবির বিষন্ন প্রতিবাদ।
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ - যারা বিষন্ন হতে ভয় পান দয়া করে এই কবিতা পড়বেন না।, বিষন্ন হলে কবি দায়ী থাকবেনা, নিজ দায়িত্বে পড়বেন।
————
মা নু ষ টা র - ক্র শ ফা য়ার - হ য়ে ছে
————————————
আমি অপেক্ষায় আছি
-কখন আমার ডাক হবে।
দুই ঘন্টা আগেও
আমি একজন মানুষ ছিলাম।
আকাশভরা পূর্ণিমার চাঁদ দেখে
কেমন যেন পাগল পাগল হয়েছিলো মাথাটা।
বেসুর গলায় দু’লাইন রবীন্দ্রনাথ গেয়েছিলাম।
মনে মনে দু’লাইন কবিতাও লিখেছিলাম,
-“পূর্নিমার চাঁদ,একদিন তোর সাথে
আসমানে এক কাপ চা খাবো”
বাকী লাইনগুলো এখনো মাথায় আসেনি।
আমাকে এখন মানুষ বলা ঠিক হবেনা,
আমি একজন আসামী-শুধুই আসামী!!
আসামী হওয়ার মতো শক্ত হৃৎপিণ্ড আমার কখনোই ছিলো না।
আমাকে বলা হয়েছে,
-আমি রাষ্ট্রীয় আইন ভঙ্গ করেছি,
-আমি রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর।
বেসুরো গলায় দুলাইন রবীন্দ্রনাথ গাওয়া,
অথবা পূর্নিমার চাঁদ নিয়ে কবিতা লেখা যে
রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর আমি জানতাম না।
কয়েকজন দেবদূত একটু দুরে বসে গল্প করছে,
সবার পরনে সাদা ধবধবে কাপড়।
দেখলেই কেমন যেন ভক্তি করতে ইচ্ছে করছে!!
চা- কফি খাচ্ছে আর হঠাৎ হঠাৎ
-ভয়ংকর ভাবে হেসে উঠছে সবাই।
হয়তো তারা স্বাভাবিক ভাবেই হাসছে,
-শুধু শুধু আমার কাছেই ভয়ংকর মনে হচ্ছে।
কখন যে আমাকে ডেকে বলবে
-“এই তোর সময় হয়েছে ,
চল, একটু হাওয়া বাতাস খেয়ে আসি”।
দেবদূত এর বড় নেতা বললো,
-“আজ আমার বড় মেয়েটার জন্মদিন,
একটু তাড়াতাড়ি বের হওয়া দরকার,
গিফটের দোকান বন্ধ হয়ে যাবে,
মেয়েটা যা অভিমানী,
ভুল হলে কথা বন্ধ করে দিবে”।
আমার নিজের মেয়েদের কথা মনে পড়ে গেলো,
বড় মেয়েকে আমি ‘রাজকন্যা’ বলে ডাকি,
আর ছোটটাকে ‘রাজকুমারী’।
মেয়েরা বলে,
-“বাবা তোমার তো রাজত্ব নেই,
আমাদের আর অন্য নাম পেলে না!”
আমি বলি,
-”আমার বুকের ভিতরে
একটা আস্ত রাজত্ব আছে রে মায়েরা,
তোরা সেখানকার রাজকন্যা-রাজকুমারী।”
একজন ছোটগোছের দেবদূত বললো,
-“স্যার, আজ অপারেশনটা আমি করি ,
আমি এখনো স্কোর করতে পারিনি,
বউয়ের কাছে মান সম্মান কিছুই থাকলো না,
ও কথায় কথায় বলে,
সবার কতো স্কোর, আমার একটাও নেই,
দেবদূত সমাজে ভাবীদের কাছে
ও কোনো ইজ্জতই পায় না,
আজ দয়া করে আমাকে সুযোগটা দিন”।
তখন আমার নিজের বউ এর কথা মনে পড়লো,
না খেয়ে এখনো বসে আছে বোধ হয় ,
দুজন এক সাথে খাবো, এই আশায়।
আমার বউটা বড্ড বোকা!
কখনো রাগ করে না,
শুধু একটু আদর সোহাগটাই বেশী চায়।
আরেকজন মোটা মতো দেবদূত বললো,
“স্যার, আমার মা হাসপাতালে,
দেখতে যেতে হবে,
আমাকে না দেখা পর্যন্ত ঘুমাবে না,
অপারেশনটা তাড়াতাড়ি করেন”।
আমি ভাবলাম, বড় বাঁচা বেঁচে গেছি,
মা বাবা আমার অনেক আগেই মরে গেছে।
না হলে আমার জন্য অযথা চিন্তা করে
না ঘুমিয়ে জেগে বসে থাকতো।
আমি খুব আশা নিয়ে আছি,
হয়তো শেষ মুহূর্তে বলবে,
-“তোমাকে ভুল করে ধরে আনা হয়েছে,
গান গাও আর কবিতা যতো খুশি লিখো,
বাসায় চলে যাও,
তোমার মেয়ে ,বউ অপেক্ষা করছে”।
নেতা দেবদূত ছোট জনকে বললো
-“আমার মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষ্যে
তোমাকে আজ একটা স্কোর এর সুযোগ দিলাম,
মেয়ের জন্য দোয়া করো।”
ছোটজন খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,
“ জি স্যার, মামনি অনেক বড় হবে,
অনেকদিন বাঁচবেন”।
ছোটজন হঠাৎ আমাকে বললো,
-“এই চল, একটু হাওয়া বাতাস খেয়ে আসি”।
বুকটা ধক্ করে উঠলো আমার,
-“স্যার আমি কোনো অপরাধ করিনি,
আপনাদের কোথাও যেনো ভুল হয়েছে,
আমি এই জীবনে আর কখনো
বেসুরো গান গাইবে না,
আর কবিতা লেখার চেষ্টাও করবো না”।
সব দেবদূত এক সাথে হেসে উঠলো,
এক সাথেই বলে উঠলো,
-“সব আসামী একই কথা বলে”।
তারপর পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে আসামীকে নিয়ে বের হয়ে গেল
-একদল দেবদূত-হাওয়া বাতাস খেতে,
রাতের নির্জন কোনো মাঠে।
সেদিন আকাশ ভরা পূর্ণিমা ছিলো,
পূর্ণিমার চাঁদ আর দুটো অন্ধ পেঁচা শুধু সাক্ষী থাকলো
-ছোট দেবদূতের প্রথম স্কোরের।
বড় দেবদূতের মনটা খুবই খারাপ,
জন্মদিনের গিফট তার মেয়ের পচ্ছন্দ হয়নি।
ছোট দেবদূতের বউ তাকে প্রচন্ড আদর করেছে,
আর বার বার স্কোরের গল্প শুনতে চায়,
কোনো কিছু যেনো বাদ না পরে।
গুলিটা বুকে লেগেছিলো না মাথায়?
তখন কি তার হাত কেঁপেছিলো কিনা?
মগজ ঠিক মতো বের হয়েছিলো তো?
আসামী কান্নাকাটি করে ছিলো কিনা?
মোটা দেবদূত এর মার শরীরটা
একটু বেশী খারাপ করেছে,
আইসিইউ তে এখন।
মার জন্য সে কাঁদছে হাউমাউ করে
-রাতের নির্জনতাকে নষ্ট করে!!
আসামীর মেয়ে দুটো জেগে আছে,
বাবা আসলে, বাবার গলা ধরে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমোবে।
তার বউ না খেয়ে
দরজা খুলে এখনো বসে আছে,
-স্বামী আসলে এক সাথে খাবে।
পূর্ণিমার চাঁদের আলোর দিকে তাকিয়ে
আসামী হা করে শুয়ে আছে!
মুখে পিপড়ে ডুকছে আর বের হচ্ছে
-রক্ত খাবার জন্য।
একটা অন্ধ পেঁচা আরেকটা পেঁচাকে জিজ্ঞাসা করলো,
-“মানুষটার কি হয়েছে বলতে পারবি?”
অন্ধ পেঁচা বললো,
-“মানুষটার ক্রশফায়ার হয়েছে”।
——————————-
কাব্যগ্রন্থ- সময় ভেসে যায় বৃষ্টির জলে
রশিদ হারুন
৩১/০৫/২০১৮
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই আগস্ট, ২০২০ ভোর ৪:০৭