somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শেষ চিঠির শুরু

১১ ই অক্টোবর, ২০২১ রাত ১২:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রিয়তমা,
ভুলে গেছো,
আমার কথা হয়তো ভুলেই গেছো!

তিনশ তিনদিন প্রতিটি দীর্ঘরাত
আমি ‌অঘুমে কাটাচ্ছি বদ্ধ একটি ছোট্ট ঘরে।
দরজা জানালার পর্দা টেনে রাখি সর্বদা সজাগ থাকি পাহারাদারদের মতো,চুরি করেও যেন একফোঁটা চাঁদের আলোও আমার ঘরে ঢুকতে না পারে।
একটিও বুকভরে নিঃশ্বাস ফেলিনি আমি দীর্ঘ তিনশ তিনদিন!

কারোই কিচ্ছু আসে যায় না এতে!
আমি অঘুমে থাকলেই কী,
আর বেঁচে থাকলেইবা কী!
আমার কেন যেন মনে হয়
রাত হলেই এখনো “মরতে না পারার করুণ অক্ষমতা”
ডানাভাঙা জোনাকির মতো
বারবার আমার ঘরের কাঁচের জানালায় বসে থাকে,
আর জানালার গ্রীলে অন্ধপেঁচার মতো উল্টো হয়ে ঝুলতে থাকে
আমার বুক জ্বলে যাওয়া দরিদ্রতার অপমান।


আমার মতো খুবই সামান্য একজন অক্ষম মানুষের বুক এফোঁড়ওফোঁড় করে
তোমার মতো এভাবেও কেউ যে চলে যেতে পারে ভাবলে
স্বয়ং খোদাও বোধহয় বিষণ্ন হয়ে যায়।
তিনিও হয়তো লিখেই রাখেননি নিয়তির ডায়রিতে আমার ভবিষ্যৎ।

অনেক সুখে আছ অর্থকড়িতে?
না হলে কেউ এভাবে চলে যায়!

বিয়ের আগে কত রাত অঘুমে কাটিয়ে তোমাকে হয়ত একটি এক লাইনের চিঠি লিখতাম।
আমাদের বিয়ের পর আর লেখা হয়নি তোমাকে কোন চিঠি।
তুমি কত অভিযোগ,‌অভিমান করতে শুধু একটি চিঠির জন্য,
আমি ভাবতাম এই চিঠি চাওয়া তোমার ভালোবাসার এক রঙ।

আজ আবার তোমাকেই লিখছি প্রায় পাঁচ বছর পর,
একটি চিঠি ,
আমার কষ্টের সব রংয়ে,
এটা প্রেম ,ভালোবাসা, অভিমান আর অভিযোগের চিঠি নয়,
এ চিঠি একজন স্বামীর অক্ষমতার স্বীকারোক্তি,
এ চিঠি একজন পিতার অক্ষমতার বিলাপ।

করোনা ভাইরাস নামক এক অসুখ আমার সুখেও অসুখের আগুন ধরিয়ে দিল।
ছোট্ট একটা চাকরি করতাম,
মালিকটা মরে গেল একদিনেই এই অসুখে!
আশ্চর্য,
এত টাকা পয়সা ,
এত ব্রান্ডেড হাসপাতালেও তাকে বাঁচানো গেল না।
মালিক নাই, অফিস বন্ধ তাই বেকার হয়ে গেলাম।

চারিদিকে শুধু মৃত্যু আর বেকার মানুষের ছড়াছড়ি।
বাড়িওয়ালার ভাড়া জমতে শুরু করল,
অল্প কিছু যা জমানো টাকা তাও শেষ
চাকরির জন্য সারাদিন ক্ষুধার্ত কাকের মত ঘোরাঘুরি করি।
সব জায়গায় আতঙ্ক আর অস্হিরতায়,
লকডাউন আর শাটডাউনের জাঁতাকলে আমার মেরুদণ্ড ভেঙে চৌচির।

আমার সক্ষমতার উপর তোমার অবিশ্বাস,
তাইতো তোমার চোখেমুখে ভয় আর অসহায়ের নির্মম ছায়া,
‌অভাব তখন দু’পায়ে দাবড়ায় আমার সংসারের সুখে।

সারাদিন রাস্তায় হাঁটি আর হাঁটি নাক মুখে মুখোশ পরে।
সব জমানো টাকা শেষ,
ঘরের বাজার করার ভয়ে তোমার কাছ থেকে সারাদিন লুকিয়ে থাকি পথে ঘাটে।
ফিরি গভীর রাতে,
কিছু না বলে চুপচাপ শুয়ে পড়ি ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত শরীরে।
তুমিও ভয়ে জানতে চাওয়া ছেড়ে দিয়েছ
সারাদিন আমি কী খেলাম।

দিন দিন অসহায় হতে হতে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছি ,
যখন ছোট্ট মেয়েটির দুধের টাকাও আর জোগাড় করতে পারছিলাম না।
কেউ ধার দেয়না,
এই শহরে বন্ধু বলে আর কেউ নেই।

রিকশা চালাতে চেয়েছি তাও পারি না,
কতবার ভেবেছি মুখোশ পরে ভিক্ষায় নেমে যাই,
চুরি বা ডাকাতি শুরু করি -
সেটুকও সাহস হয়নি।

তারপর একদিন বাড়ি ফিরে দেখি তুমি নেই,
তোমরা নেই!
শূন্য আমার ভাড়ার ঘর।

ভেবেছি বাড়িওয়ালার প্রতিদিনের ‌অপমান সহ্য করতে না পেরে তুমি হয়তো বাবার বাড়ি চলে গেছো!
শুধু টেবিলের উপর সাদা কাগজে লিখে গেলে,
“দরিদ্রতার এই অপমান মরণের চেয়েও বড় কষ্টের।"

তোমার বাবার বাড়িতেও নেই!
সব পরিচিত-অপরিচিতের দরজায়,
থানা-পুলিশ, হাসপাতাল কোথাও নেই তোমাদের খবর,
শুধু শূন্য আর শূন্য এই জগত।
কোথায় গেলে তোমরা
আমি একটুও জানতেই পারলাম না!

একা থাকার ভয়ে
আমি কতবার যে মরতে চেয়েছি,
সেই জন্য মাস্কবিহীন ঘুরেছি রাস্তা রাস্তায় হাজারো মানুষের ভীড়ে সারাদিন।
এমনকি হাসপাতালে গিয়ে করোনা রোগীর পাশে বসে থেকেছি,
তবুও করোনা আমাকে আপন করলো না।

তোমার বন্ধ মোবাইলে ফোন করতে করতে আমার হাতের আঙুলে ক্লান্তি ভর করেছে ,
সেই একই নারী কন্ঠে একই কথা বারবার বলে,
“আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি আর ব্যবহৃত হচ্ছে না!”।
ফেসবুকে তোমাদের সন্ধান চেয়ে কত যে পোস্ট দিলাম,
তবুও কোন খবর নেই তোমাদের।

তিনশ তিনদিন তোমাকে দেখিনা, মেয়েটাকে দেখি না।
মেয়েটা বোধহয় কথা বলা শিখে গেছে,
আমার চেহারা হয়তো ভুলে গেছে,
আহারে,
বাবা বলে ডাকা হয়তো শিখতে পারেনি।

লকডাউন শাটডাউনের খেলা শেষ,
করোনা এখন দুর্বল।
এক বন্ধু দয়া করে একটি মোটর সাইকেল কিনে দিয়েছে।
এ দিয়ে পাঠাও আর উবারে মানুষ টানি আর সারাদিন তোমাদের খুঁজি।

তারপর একদিন,
একদিন সেই ফেসবুকেই তোমাকে দেখলাম,
পাশে একজন মেরুদন্ড সোঁজা করে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষ।
খুব হাসিখুশি ছবি,
আমার মেয়েটা সেই পুরুষটির কোলে।
মেয়েটা অনেক সুন্দর হয়েছে তোমারই মতো, মাশাল্লাহ্।

আমার বেকারত্ব আর দরিদ্রতার বেড়াজালে পড়ে
তোমার কীভাবে কি হয়েছিলো!
আমি একবারের জন্যও বুঝতে পারিনি,
জানতেও পারিনি!
তোমার তো কোন অভিযোগই ছিলনা আমার প্রতি কখনোই?
আমি শুধু ভাবতাম
আমার বেকারত্ব,
আর আমার জলে ভাসা মানিব্যাগ
তোমাকে কষ্টে রেখেছে প্রতিক্ষণ।

আমি খোদার কাছে শুধু চাইতাম,
আমার এই দরিদ্রতার ‌অপমানের কষ্টটুকু
শুধু আমার বুকেই যেন থাকে।
তোমাকে যেন দরিদ্রতার ‌অপমান,কষ্ট আর গ্লানি থেকে দূরে রাখে।
আমি না হয় মাটির সাথে আরেকটু মিশে যাবো অর্থ কষ্টে আর ‍অপমানের চাপে।

আমার শূন্য এই ঘরে,
শূন্য এক হাহাকারের দীর্ঘশ্বাস এখন রাজত্ব করে,
আমাকে ভয়ে রাখে দিন রাত।
তাইতো দরজা জানালা আটকিয়ে তোমাদের চিৎকার করে ডাকি,
কেউ সারা দেয়না।

তবুও ভাবি
ভালো আছো তুমি,
সুখে আছো,
আমার মেয়েটা তিনবেলা অন্তত খেয়ে পরে ভালো আছে।
আমার অক্ষম বুক এফোঁড়ওফোঁড় করে বিবশ দীর্ঘশ্বাস শূন্য ঘরের দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খায়,
আমি কাঁদি আর কাঁদি।

এক মুহূর্তের জন্যও আমার মন ভালো থাকেনা।
তোমরা ভালো আছো
তবুও আমি কাঁদি আর কাঁদি।

তুমি দেখো
একদিন এই কান্নার জলে আমি পুরো পৃথিবী ডুবিয়ে দিবো।
খোদাও বোধহয় ভয়ে ভয়ে থাকে,
যদি উনার কাছে আমি আমার কান্না থামানোর জন্য প্রার্থনা করি।

আমি এখনো সেই একই ভাড়া বাড়িতেই থাকি,
যেখান থেকে তুমি চলে গেছে আমাকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে।
এই চিঠি আমি কোন ঠিকানায় পাঠাবো?
তাইতো তোমার নাম লিখে সেই একই টেবিলে পাথর চাপা দিয়ে রেখে দিবো।

যদি কোন একদিন এই শহরে ফিরে আসো,
তবে তুমি তোমার কাছে লেখা আমার শেষ চিঠিটি নিতে একবার জন্য হলেও এই বাড়ির দরজায় টোকা দিও।
ইতি
আমি কাঁদি আর কাঁদি
আমি কাঁদি আর কাঁদি
আমি কাঁদি আর কাঁদি
————————
র শি দ হা রু ন
১০/১০/২০২১
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০২১ রাত ১২:৩৯
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×