somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ শেষ বিকেলের বৃষ্টি

০৩ রা জুন, ২০১২ রাত ১২:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আকাশে তখন মেঘ ছিল না। মরা রোদের আলোয় নগরের রাস্তায় কেবল স্থির দু একটা বাঁক ছিল আর কিছু রিক্সাওয়ালা সেখানে বসে বসে ঝিমুচ্ছিল। বৃষ্টি প্রতিরোধের যথেষ্ট প্রস্তুতি তারা নিয়ে রেখেছে। শ্রাবণ মাস এখন। কথা বলার ফাঁকেই কখন দু এক ফোঁটা বৃষ্টি ঝরে যায় তা হয়তো অনেকে খেয়ালই করতে পাড়ে না শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুদৃশ্য অফিস রুমে বসে। আমি টের পাই। আমার অফিসের জানালা দিয়ে শহীদ স্কয়ারের মোড় দেখা যায় স্পষ্ট। কিছু রিক্সাওয়ালা রিক্সার সিটের ওপর পলিথিনের সুরক্ষা দিয়ে ঢেকে রেখেছে সিট। কেউ কেউ মোড়ের চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছে। আবার কেউ যাত্রীর জন্যে অপেক্ষা করছে।


সকাল থেকে তুমুল বৃষ্টির তোরে আজ রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা। নাগরিক মানুষ হয়তো বাড়িতে বসে মজার খাবার রান্না করছে। হয়তো স্বামী স্ত্রী অথবা সন্তানাদি সহ তারা টিভিতে কোন সিরিয়াল দেখছে। দুপুরে খিচুড়ি আর মাংস দিয়ে ভুঁড়ি ভোজ শেষে আয়েস করে গা এলিয়ে দিয়েছে বিছানায়। আজ ঘরের বাইরে কেউ বের হবে না। শ্রাবণের বৃষ্টি উদযাপন করবে তারা। আমি ভাবছিলাম ছোটবেলার কথা। বাবা মা আর আমরা ৬ ভাই বোন মিলে বৃষ্টির দিন হয়তো কখনো সেভাবে উদযাপন করিনি; টিনের চালে বৃষ্টির ঝম ঝম শব্দ আর ঝড়ে চালার টিন কখন উড়ে যায় এই আশংকায় যখন বৃষ্টির আতঙ্ক পার করছি তখন আমরা অনেক ছোট। সবার ছোট ছেলে আমি। অনেক আদরের তবে মধ্যবিত্ত পরিবারের আদর চোখে পরে না তেমন। যেটুকু মনে পড়ে তা খুব বেশি উল্লেখ করার মতো নয় তবে সেই সময়ের আবেশ গায়ে মেখে চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলাম দিতেই মনে হল আমি আজ খুব একা হয়ে গেছি।
বড়দা বিয়ে করেছে দু বছর হল। ছয় মাসের ছোট একটা পিচ্চি নিয়ে ওরা খুব ভাল আছে। মা আর বড় চার দিদি ভাইয়ের সংসারেই থাকছে এখনো। ওদের আর বিয়ে হল না। মনে আছে মায়ের করুণ আর্তির কথা। তাঁর মেয়েদের চেয়ে বয়সে অনেক ছোট ছোট যারা ছিল আত্মীয় কিংবা পাড়া প্রতিবেশীদের মাঝে, তাদের সবার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে একে একে। মা বিয়ের নিমন্তন্ন রক্ষা করতে প্রতিটি বিয়ে বাড়িতে যেত আর ফিরে এসে মুখ ভার করে রাখত। খুব বেশি খোটা শুনতে হতো মাকে। এতো বড় বড় মেয়েদের বিয়ে না দিয়ে বাড়িতে কেন রেখেছে মা! মেয়েদের তো বিয়ে আর হবেই না, ছেলেদেরও কি বিয়ে দিবেন না? কেন পিশিমা আপনার মেয়েদের বিয়ে হয় না কেন?
মা এই প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারতো না। আমি সেসব বিষয়গুলো না বুঝলেও মা যে খুব বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যেত এটা ঠিক বুঝতাম। প্রতিবেশীদের আবার কি দোষ! ওরা তো সাত পাঁচ কতো কথাই না বলে কিন্তু যে মেয়েদের বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে তাদের বিয়ের কথা বলে মনের গভীরের পীড়া খুঁচিয়ে বুঝি ওরা খুব শান্তি পায়! বড় দিদির বয়স এখন ৪৫ চলছে। আমরা খুব পিঠাপিঠি। আমাদের বয়সের ব্যাবধান খুব কম। আমার জন্মের ঠিক ৮ বছর পর বাবা মারা যান। মা ই আমাদের সব। তাঁর সন্তানদের সবাইকে মানুষ করা, বাবার রেখে যাওয়া সীমিত সম্পদ দিয়ে সব ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখানো এই মা আমার নিজে অক্ষর জ্ঞানহীন। তিনি আমাদের কাছে অতীব শিক্ষিত একজন নারী এবং মা। অন্য সবার কাছে হয়তো মুর্খ কিন্তু তিনিই আমাদের দেবতা। আজ বিস্তৃত দুঃখ কষ্টের দিন কাটিয়ে উঠলেও মা আমার এখনো অপরাধী নিজের কাছে। তিনি তাঁর মেয়েদের বিয়ে দিতে পাড়েন নাই। তিনি এই সমাজের ঠিক করে দেয়া অপরাধে অপরাধী হয়েছেন এবং প্রতিনিয়ত মানুষের বিদ্রুপ উপেক্ষা করে হাসিমুখে আমাদের সুখী রেখেছেন। যখন আত্মীয়দের কেউ খোঁচা দিয়ে বলে যায় মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছ কেন তাদের উপার্জিত টাকায় বসে বসে খাবার জন্যে, তখন পারত পক্ষে মা বরাবরের মতোই চুপ থাকতো। তবে মার সান্ত্বনা এই যে দিদিরা উপার্জনক্ষম এবং নিজ নিজে ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। বিয়ের প্রস্তাব আসেনি তা না তবে যখন মন আর বয়সের যুদ্ধে বয়স জয়ী হয়ে যায় সেখানে মনে কোন রঙ থাকে না। রঙ মাখতেও ভয় লাগে। কেন যেন কিছু কিছু মানুষ খুব ভীতু হয়!


অফিস থেকে বেড়িয়ে কিছু কেনাকাটা করতে হবে। রুমে খাবার সব ফুরিয়ে গেছে। ফ্রিজে সব্জিও নেই। শহীদ স্কয়ারের পশ্চিম দিকের রাস্তায় বেশ কিছু ভাল দোকান আছে। আনন্দ ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকেই সাধারণত কেনাকাটা করি আমি। অফিস থেকে নেমে দু কদম এগোলেই আনন্দ ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। আমার গাড়ির ড্রাইভার তার অসুস্থ মেয়েটিকে দেখতে হাসপাতালে গেছে। এখনো ফেরেনি। ভাবলাম ওর জন্যে অপেক্ষা না করে কেনাকাটা সেরে নেই। ততক্ষণে হয়তো ড্রাইভার এসে যাবে। কিন্তু অফিস থেকে বেড়িয়েই বৃষ্টির মুখে পড়লাম। ছাই রঙের আকাশে মেঘ ছাড়াই কোথায় যে এতো বৃষ্টি লুকিয়ে ছিল! ভিজতে ভিজতে একটা স্টেসনারি দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। বৃষ্টির ঝাপটা এসে আমাকে প্রায় ভিজিয়ে দিয়েছে। খারাপ লাগছে না। অনেকদিন এভাবে বৃষ্টিতে ভেজা হয় না। আজকের এই অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি স্নান যদিও অনিচ্ছাকৃত তবুও এর বিশালত্ব অনেক। ইচ্ছে হচ্ছে দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে চোখ আকাশের দিকে রেখে ভিজতে। ঠিক মাঝ রাস্তায় হেঁটে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। সময় বড় বেয়াড়া। অসময়ে আমাকে ছোট শিশুর মতো বানিয়ে দিতে চায় কিন্তু তার অপার গাম্ভীর্য বজায় রাখতে ইচ্ছেরা মনের ভেতর ছটফট করলেও সময়ের যেন করার কিছুই নেই। আমিও তাই নিরুপায় হয়ে বৃষ্টি পতন দেখছি আর তার সুর শুনছি।


আনন্দ ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনের রাস্তাটা অনেক ছোট। ডিভাইডার ছাড়াই এই রাস্তাটা গিয়ে মিশেছে মেইল রোডের সাথে। ছোট রাস্তা হলেও কিন্তু বেশ জাঁকজমক পূর্ণ। বিশাল উচ্চতার দুটো শপিং মল। বেশ কিছু ক্রোকারিজ শপ, হলমার্কের একটা শো রুম, আর্চিসের একটা বড় শো রুম, ছোট বড় বেশ কিছু ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আর দু একটা চায়ের দোকান। এখানে একটা ছোট চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আছে। চাইনিজ ভাল লাগে না বলে ওখানে শখ করেও যাওয়া হয়নি কখনো। আমি ঠিক চিলি চাইনিজ রেস্টুরেন্টের বিপরীত দিকের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। রেস্টুরেন্টের ভেতরে লাল নীল রঙের বিচিত্র আলো জ্বলছে। অদ্ভুত মায়াময় একটা পরিবেশ। রেস্টুরেন্টের আলো বৃষ্টির গায়ে পরে মোহনীয় একটা বিকেলের জন্ম দিচ্ছে। শেষ বিকেলের এই নরম আলোয় আমি তাকিয়ে আছি। বিকেল হলেও শহরে এখন সন্ধ্যার নির্জনতা। দু একটা মানুষ দেখা যাচ্ছে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে আমারই মতো কোন না কোন কিছুর আশ্রয়ে নিজেকে লুকিয়ে রেখার চেষ্টায় ব্রত। একটা গাড়ি প্রচণ্ড গতিতে হাওয়ার বেগে দৃষ্টির বাইরে চলে গেলো। উচ্চ স্বরে গান বাজিয়ে হয়তো উঠতি বয়সী ছেলে মেয়েরা বৃষ্টি যাপন করছে। ওদের উদযাপনের রঙ আলাদা। আমাদের সময় এটা না। তবুও সবকিছু মানিয়ে নেয়া, নিজের মতো করে বাঁচা।


একটা সিগারেট ধরাতে চেষ্টা করছিলাম। এত্ত বাতাস যে লাইটারের নীল আলো জ্বলার আগেই বারবার নিভে যাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে বাতাস দেখার ব্যার্থ চেষ্টা করতে মুখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখি একটা ছোট ছেলে, বয়স চার পাঁচ হবে হয়তো, তার বাবা মার সাথে বৃষ্টির জল নিয়ে খেলছে। ছেলেটির মা তাকে ধরে রাখতে চাইছে আর বাবাটি ছেলের এরুপ কাণ্ড দেখে অত্যধিক আনন্দে উচ্চ শব্দে হেসেই যাচ্ছেন। তার হাসির শব্দ বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে আমি ঠিক শুনতে পাড়ছি। সিগারেট জ্বালানোর চিন্তা বাদ দিয়ে আমি এই সুখী দম্পতির দিকে তাকিয়ে আছি। তারা হয়তো এই রেস্টুরেন্টের ভেতরেই ছিল। বৃষ্টি নেমেছে দেখে হয়তো বৃষ্টি দেখতে বেড়িয়ে পড়েছে। বেশ মার্জিত পরিবার মনে হচ্ছে। ছেলেটির মা ছেলেটিকে যখন তার বাবার কোলে তুলে দিতে যাবে তখনই আমার চোখ স্থির হয়ে গেছে। খুব চেনা একটা মানুষ। আগে এতোটা হাসিখুশি দেখিনি তাকে। আগেও সে হাসত কিন্তু আজ যেন খুশি তার উছলে পড়ছে। এটা আমারও কি ভুল হতে পাড়ে না? মানুষ চিনতে আমার খুব সমস্যা হয়। অনেক দিন পর দেখা হলে পরিচিত মুখ দেখেও আমি চিনতে পাড়ি না। খুব কম পরিচিত মানুষও আমার কাছে অপরিচিত। তবে আজ ভুল হচ্ছে না আমার। আমি ঠিক দেখছি সেখানে মৌরী দাঁড়িয়ে আছে। সাদা মতন একটা শাড়ি পড়েছে। চোখে মুখে স্নিগ্ধ একটা আবেশ। খুব সুখী একজন মানুষ মনে হচ্ছে। এই তো সেই আগের মতো করে হাসল। টোল পরা গালের সেই টোল আমি এতদূর থেকেও স্পষ্ট দেখতে পাড়ছি। বৃষ্টির ধূসরতা আমার দৃষ্টির সাথে প্রতারণা করতে পারছে না আজ। আজ আমি একটু বেশিই দেখতে পাড়ছি যেন। সেই মুখ, একই শহরে থাকি আমরা তবুও আজ ৭ বছর পর দেখা আমাদের। আমি দেখছি কিন্তু মৌরী কি আমাকে দেখতে পারছে? সেদিন শেষ বিদায়ের দিন আমাকে সে ঘুরে ঘুরে দেখছিল। যতোটা না এগোচ্ছে তারচেয়ে বেশি আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। আমি একবার হ্যাঁ বললেই যেন সে দৌড়ে আমার কাছে চলে আসবে। আমি সেদিন হ্যাঁ বলতে পারিনি মৌরীকে আর মৌরী সেদিনের পর আর তার টোল পরা মুখের হাসি নিয়ে আমার সামনে হাজির হয়নি।


গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়েছে মাত্র। চাকরি খুঁজছি। উচ্চতর স্টাডির পাশাপাশি একটা জব আমার খুব প্রয়োজন। কোথাও জব পাই না। মন খারাপ করে ঘুরে বেড়াই এখানে সেখানে আর ঐদিকে মৌরীর বাড়ি থেকে বিয়ের জন্যে চাপ দিচ্ছে। মৌরী আমার কাছে এসে চুপ করে বসে থাকে। আমরা কোন কোথা বলি না। এভাবে বসে থাকতে থাকতে একসময় সে চলে যায়। আমি বসে থাকি। মৌরী হয়তো বুঝে গিয়েছিলো আমার নিস্তব্ধতার মানে। তবুও যে ভালোবাসার গানে এতোটা পথ পেরিয়ে এসে এই হঠাৎ রোদের উত্তাপে পুড়ে যাওয়া সময় আমাদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলেছিল, সে সময়ের গায়ে শুধু শুন্যতা ছিল। কিছু একটা হারিয়ে যাবার সম্ভবনা দেখে আঁতকে ওঠার মতো অবসর ছিল না। আমি ভাবতে পারিনি বড় দিদিদের বিয়ে না হলেও আমি বিয়ে করবো। অপেক্ষা করেছি অনেক। সময়ের আবেদন অসময়ের গায়ে কিভাবে বোবা কান্নায় ডুকরে কেঁদে ওঠে তার রুপ আমি চোখ ভরে দেখেছি। হৃদয় ভরে গ্রহণ করতে না পারলেও আমি বাস্তব হয়তো হইনি তবে এতোটা পাষণ্ডও হতে পারিনি। যাকে খুব বেশি ভালবেসেছিলাম হয়তো তার কাছেই সবচেয়ে বেশি অপরাধ করেছি। তাকে গ্রহণ করতে গিয়ে বাঁধা পড়েছি পারিবারিক দুর্গতির যাঁতাকলে। পৃথিবীতে কোন মানুষ কখনো তার পরিবেশ পরিচিতের সবার কাছে বন্ধু হতে পাড়ে না। বন্ধু হতে না পারলেও আমি মৌরীর কাছে একটা অপরাধী হয়েই বেঁচে আছি। ভালোবাসার অপরাধ পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় অপরাধ। এই অপরাধের কোন আইন সম্মত শাস্তির বিধিবিধান নেই। শাস্তি একান্ত ব্যাক্তিগত এখানে। এই ব্যাক্তিগত শাস্তি স্বরূপ মৃত্যুদণ্ডের সাজা পেয়ে যাচ্ছি গত ৭টি বছর ধরে।


আমি চাই নি মৌরী আমাকে দেখুক। এমন তো হয়ই, পথ চলতে কতো পরিচিত মানুষের মুখোমুখি হয় মানুষ। কেউ হয়তো পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কেউ হয়তো হাসি মুখে কথা বলে। আন্তরিকতার সাথে হ্যান্ড শেক করে। নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারলে বেশ হতো। কিন্তু আমার অবস্থান এমনই যে নিজেকে লুকিয়ে রাখলেও আমার দৃষ্টি বারবার একই স্থানে গিয়ে স্থির হয়ে যাচ্ছে। আমি চাইছি না মৌরীর দিকে তাকাতে কিন্তু আমি তাকিয়েই আছি। চোখ সরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে সেও হয়তো পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া মানুষদের মতোই আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেত। আমি নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম মৌরী আমাকে দেখেনি। কষ্ট পেতে ইচ্ছে হলে ভাবতাম মৌরী আমাকে দেখে আমার মতোই করেই আমার দিকে হয়তো তাকিয়েছিল কিছুটা সময়। হয়তো ভেবেছে আমি যেন তার দিকে একটু তাকাই। খুব আপন একটা দৃষ্টি কতোটা পর হয়ে গেছে তা হয়তো জানার খুব ইচ্ছে জেগেছিল মৌরী মনে।


আমি চোখ সরাতে পারিনি। বৃষ্টির পানিতে নিভে যাওয়া সিগারেট হাতে ধরে রেখেছি। একসময় মৌরী তার খোপার কাঁঠালিচাঁপা ফুল ঠিক করে মাথা ঘুরাতেই যেন চমকে উঠল। ধীরে ধীরে হাত নিচে নামিয়ে হাতের সোনার বালা ঠিক করলো। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো একবার। শাড়ির আঁচল বা হাত ধরে টেনে কোমরের কাছে ধরে রাখল। একবার তার ছেলে আর হাজবেন্ডের দিকে তাকিয়ে চোখ রাখল আমার চোখে। হয়তো কোন এক অচেনা মানুষকে দেখছে মৌরী। কতো মানুষই তো রাস্তায় সুন্দরী দেখলে হা করে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু সুন্দরীরা সে দিকে তাকিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করে না। আমি আর মৌরী আজ শহরের অচেনা মানুষ। পরস্পরকে দেখি চেনা চোখে অচেনার ভিড়ে। আগেও দেখেছি অনেক। চোখে চোখ রেখে এক ছাতার নিচে দুইজন হেঁটেছি কৃষ্ণচূড়া ফুলে লাল হয়ে থাকা শহরের রাস্তায়। বৃষ্টি খুব প্রিয় ছিল মৌরীর। আর আমার ছিল আতংকের। বৃষ্টিতে ভিজলে আমার জ্বর হয়ে যেত। মৌরী বলেছিল, আমার হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজবে তুমি। তাহলে তোমার আর জ্বর হবে না। ঠিক বলেছিল মৌরী। আমার সেদিন থেকে শত বৃষ্টিতে ভিজলেও জ্বর আসে না। ধীরে ধীরে বৃষ্টির প্রেমে পরে গেলাম আমিও। বৃষ্টি শুরু হলেই আমাদের দুইজনের বৃষ্টিতে ভেজা চাই। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বেড়িয়ে পড়তাম বৃষ্টিতে ভিজতে। মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখত আমাদের। কেউ কেউ বিদ্রুপ করে হাসত। আমরা সেসব দেখতাম আর হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজতাম। মানুষের কথায় কি এসে যায় আমাদের!


আমাদের দৃষ্টি বিনিময়ে ছেদ ঘটাল মৌরীর গাড়ির হর্ন। ওর ছেলে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মৌরী চলে যাচ্ছে। ভেতরে খুব অস্থিরতা অনুভব করছি আমি। মনে হচ্ছে কি যেন হারিয়ে যাচ্ছে। আমি নতুন করে শুন্য হয়ে যাচ্ছি। এই শুন্যতা মেনে নেয়া সম্ভব না। আমি হয়তো আর জীবন যাপন করতে পাড়ব না। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি মৌরীর চলে যাওয়ার দিকে। মেঘ জমছে মনে। আর একবার সেই চোখ দেখার জন্যে ভেতরে ভেতরে পুড়ে যাচ্ছি আমি। শেষবার, শেষবারের মতো যদি তাকাত মৌরী! কিন্তু মৌরী এবার ফিরে তাকাল না। গাড়িতে উঠে বসল। একসময় রাস্তায় জমে থাকা জল ছিটিয়ে মৌরীর গাড়ি হারিয়ে গেলো আমার দৃষ্টি সীমার বাইরে। বুঝলাম অনেক মেঘ শেষে বৃষ্টিরও অবসর শেষ হয়ে গেছে। রোদে পুড়ে গেছে আমাদের প্রাণের নগর। বৃষ্টি নেই এখানে। এখানে আছে অষ্টপ্রহর রোদ আর প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাওয়া মানুষ।

৫৮টি মন্তব্য ৫৮টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×