somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চন্দ্রশেখর-এর গল্প/ বেলাল আহমেদ

১৮ ই অক্টোবর, ২০১৩ দুপুর ১:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শনিবার! সন্ধ্যা! তখনও লাইটপোস্টগুলো জ্বলে ওঠেনি। ফিরে যায়নি তারা এখনই যাদের ঘরে থাকার কথা। পায়ে পা লাগিয়ে কয়েকজন ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে রাস্তায় হাঁটছে। বাড়ি ফিরতে চায় তারা। রিক্সা ডাকে। টেক্সি ডাকে। শনিবার! সনাতন মিথে শনি একজন কুদেবতা। যার নামের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অন্ধকার, মৃত্যু, বিষাদ, শূন্যতা, অপশক্তি, অপক্ষমতা। আর আজ...

গতরে গতর বাজিয়ে আমরাও একসাথে হাঁটছি। ধ্রুব, সৈকত, পরিমল। অন্ধকারের দিকে। হালকা অন্ধকার, অশরীরি আবহ। চাকার আকুলতা। বাড়ি ফেরার আকুলতা। পায়ে পায়ে। চোখ স্থির অস্থির নগরীতে। আমাদের পা কথা বলে ওঠে পথের সাথে। আমাদের চোখ কথা কয় অন্ধকারের সাথে। বিমূর্ত যাত্রা আমাদের অন্ধকারের মধ্যদিয়ে অন্ধকারের দিকে। আমাদের পায়ের দৃপ্ততা এ অন্ধকারকে অস্বীকারের ক্ষমতা রাখে। আমরা টের পাই।

হাঁটতে হাঁটতে লীলাদিদির ঘর। হালকা আলো অথবা বেশির ভাগই অন্ধকার। নিরেট অন্ধকার কোথাও কোথাও। বিমূর্ত কাব্যময়তা আছে এখানে। লীলাদিদির কল্কি আজ সাজানা হয়নি। স্টিকেই ভারসা করে ধ্রুব, সৈকত। পরিমল বাংলাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর আমার হলেও চলে না হলেও।

লীলাদির স্বামী চন্দ্র শেখর। মেথর। মানুষ ভালো। অন্ধকারের গল্প বলে। গভীর অন্ধকারের। জীবনের বা তমসার গল্প বলে। আজ অসুস্থ সে। বিড়বিড় করে। একা। গভির শূন্যতার সাথে কথা বলছে। তাকে দেখলে আমাদের ভাবনার পরম্পরা ভেঙে যায়। মানুষ যখন ভাবে বিছিন্নভাবে ভাবে, বিক্ষিপ্তভাবে ভাবে। সেখানে পরম্পরা ঠিক থাকে না। ঠিক থাকার নয়। আর চন্দ্র শেখর তো আরো বিক্ষিপ্ত, রক্তে অঙ্কিত। তাই তার ভাবনা ও বয়ানরা আরো বেশি খাপছাড়া, এলোমেলো, ভয়ংকর ভাবে আসে। মৃত্যুশয্যার এ মানুষটি বলে তার জীবনের পাঠ ও বয়ান। কথাগুলো বেশ জোরে সুরে বের হয়। অন্ধকারেও আমি দেখি চন্দ্র শেখর তার চেয়ে বেশি ব্যক্তিত্ববান হয়ে ওঠছে। তার অহংকার তার জীবন তাকে আরো বেশি ব্যক্তিত্ববান করে তোলে। সে তার অন্ধকার, অপসৃয়মান জীবনের কথা বলে, অন্ধকার স্বপ্নের কথা বলে। খুন করে যে অর্জন করেছে শিল্পের হাত— বলে এই জঘন্য মানুষ।

অন্ধকারটা এখন বেশ আরামদায়ক মনে হচ্ছে। চোখ সওয়া হয়ে গেলে আর কোনো কিছুতেই বিব্রতবোধ থাকে না। তার মধ্যে ঘরে একটা মাদকতা ছড়িয়ে দিয়েছে ধ্রুব আর পরিমল। আমি এ অন্ধকারেও চন্দ্র শেখরের দীর্ঘশ্বাস মাপি। অপরাধবোধে ক্লিষ্ট হতে দেখি। ঘরময় যে গল্প ছড়িয়ে রাখে চন্দ্র শেখর তার সাথে ঘরের পরিবেশের এক সম্পূরক সূত্র দাঁড় করানোর চেষ্টা করি। তার চেহারার ইমাজিনেশন দুর্দান্তভাবে ফুটে ওঠে। প্রতিটি রেখা সাবলীল, অথচ চিন্তাশীলতায় পরিশীলিত ব্যাপকতায় হৃদ্ধ প্রতিটি টান। চোখের প্রতিটি উপশিরা ও এই আধো আলোয় দৃপ্তি ছড়ায়।

চন্দ্র শেখর যেন আমাকে টেনে টেনে ভাবনার ভেতর ঢুকিয়ে দেয়, ভয়-যন্ত্রণা-টেনশনের মধ্যে দিয়ে আমাকে ভাবনার চূড়ান্ত গতির দিকে নিয়ে যায়। তার এক একটি কথাই ফ্ল্যাশব্যাকে এক একটি গল্প হয়ে ধরা দেয়। যেন অন্য মানুষ থেকে আলাদা হয়ে উঠছে চন্দ্র শেখর। এভাবেই নিশ্চল এই অন্ধকারে আমি স্থির দেখতে পাই চন্দ্র শেখর দৌড়াচ্ছে। আধো অন্ধকার। পুলিশের তাড়া খেয়ে এই মঞ্চে চলে এসছে চন্দ্র শেখর। একটি নাটকের মঞ্চের মতো। আলোক নির্দেশকের নির্দেশনায় একটা হালকা হলদে আলো উপর থেকে পড়েছে তার মাথায়। চুলগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। লম্বাটে কালো। মুখে হালকা আলো-আঁধারির খেলা। তার টান টান যৌবনের বলিষ্ট চেহারা হালকা আলোতে ভেসে উঠে। একটু আতঙ্কিত! একটু বিমূঢ় হয়ে বারান্দায় বসে আছে। এই মঞ্চে চন্দ্র শেখর পরিচিত। এ পল্লীতে চন্দ্রশেখর প্রভুর মতো। সে ভাবছে। পুলিশের দৌড়ানিতে তাকে ভাবতে হচ্ছে পুরনো খুন-জখম-জুচ্চুরির কথা। আর ঘরের ভেতর যেন এখনই কতটা চুড়ি ভেঙে মাটিতে পড়ার শব্দ শোনে সে। আর আমি শুনি রেবিতার হাসির শব্দ।

রেবিতা আধ পাগলি। হাসির মোহে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে চন্দ্র শেখেরের যৌবন। ঘরে ঢুকে আশ্রয় নেয়। তার সাথে অদিম খেলায় মেতে ওঠে। ভুলে যায় ভয় আর আতঙ্কের কথা। অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে চন্দ্র শেখর হাঁটে অন্ধকারের দিকে। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে, চোখের কোণে জলের বিন্দু জমে! চন্দ্র শেখর হাঁপায়, কাঁশে, কুখকুখ কাঁশি! কাঁশির কোরাসে চন্দ্র শেখর এগোয়, এগোয় তার জীবন, জীবনের গল্পকথা, অন্ধকার স্বপ্নের কথা! আধ পাগলি রেবিতার গর্ভে জন্ম নেয় সেফু! সেফু চন্দ্র শেখরের ছেলে। চন্দ্র শেখর জানে। সেফু জানেনা! আর তাই সেফু এখন চন্দ্র শেখরের ডান হাত। সুন্দরী যুবতি লীলাদির সঙ্গে যে সেফুর অবৈধ সম্পর্ক তাও চন্দ্র শেখর জানে। বলে যায় গভীর বংশবদের কথা। চোখের সামনে কষ্টের ধোঁয়া ওড়ে আমার। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে যে আলোক ঔজ্জ্বল্য দেখার প্রত্যাশা করি তা আরো গভীর অন্ধকারের দিকে টানে আমাদের। সেফু ভালোবাসতো লীলাকে! পালানোর চেষ্টা করেও পারেনি। প্রভূ চন্দ্র শেখরের হাতে ধরা পড়ে। তারপর থেকেই চন্দ্র শেখরের ঘরে বউ হয়ে থেকে যেতে হয়। সেফু প্রতিবাদ করতে পারে না। লীলা থাকে। পালাতে গেলে শিউরে উঠে ভয়ঙ্কর সেই নারীর মৃত লাশের কথা মনে করে। যাকে চন্দ্র শেখর খুন করে অনেকদিন রেখে দিয়েছিলো খাটের নিচে। পালায় না লীলা। চন্দ্র শেখরের ঘরেই থেকে যায়। তারপর থেকে সেফুও থাকে। প্রভূর ঘাস দাশ হয়ে যায়।

চন্দ্র শেখরের ব্যক্তিত্বের প্রকটতায় স্লান হয়ে যায় আমাদের ঘরহীনতার গল্প, শিল্পের ধ্যানী মন ভেঙে যাওয়ার শব্দ শুনতে থাকি প্রবলভাবে। শিল্পের পরম্পরা ঠিক রাখতে বা তার প্রভাব রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা আমরা হারিয়ে ফেলি। চন্দ্র শেখর সেই শিল্পী। চন্দ্র শেখর সেই মানুষ। শিল্পে আর খুনে মিশ্র বুনটের জীবন এক। অন্ধকার গভীর হতে থাকে, রাতও।

লীলাদিদির ঘরটা ধোঁয়াময় চন্দ্র শেখরের চোখের কার্ণিশে জমে থাকা জল আমাদেরকেও হুঁশিয়ারি দেয়। জীবনের হুঁশিয়ারি। ধ্রুব এই হুঁশিয়ারি অনুবাদ করে। খাদ্যহীনতার গল্প দাঁড় করায়। মুখে থুথু জমে উঠে। ধ্রুবর মুখের থুথু ক্ষুধার না ঘৃণার বোঝা যায় না। মানুষ ক্ষুধা আর ঘৃণা ছাড়া মুখে থুথু জমাতে পারে না।
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×