বেলাল আহমেদ
আমাদের আগের প্রজন্মের সময়ের জাফলং-এর জৌলুশ, শান-শওকত আর গরিমা এখনও আছে বিছনাকান্দিতে! ঘননীল আকাশ। সামনে সারি সারি পাহাড়। পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের কুন্ডলী। নৈকট্যে গেলে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। মেঘের বুক চিরে নেমে আসা ঝর্ণা। নিচে নেমে জল ও পাথরের সম্পর্কে শাঁ শাঁ শব্দ। সেই জলই আবার মিশে যাচ্ছে পিয়াইনের সাথে। পাথরে পাথরে বন্ধুত্ব। পাথরে ও নদীতে মিতালি। পাথরে মানুষে জীবনযাপনের যুদ্ধ। চারিদিকে বিস্তৃত সবুজ। পাহাড়ে পাহাড়ে সবুজের জলকেলি। বিস্তির্ণ মাঠে সবুজের চাদর। এগুলো দৃশ্যকল্প নয়, বিছনাকান্দি জুড়ে এমন দৃশ্য যেন সত্যিই কেউ ফ্রেম বন্দি করে লটকে দিয়েছে আকাশের সাথে। দূর থেকে মনে হবে এই মেঘ, এই মানুষ, এই পাহাড়-নদী কিংবা পাথরের স্থিরচিত্রই এগুলো। এমন বিছানো সৌন্দর্যের পথে যাচ্ছিলাম আমরা তেরো জন।
সকাল সাড়ে নয়টা। আমি ঘুমোচ্ছিলাম অঘোরে। সেলফোনটা অকেজো হয়ে পড়ায় রাজিব রাসেল স্বয়ং দরজায় ডেকে ঘুম ভাঙালেন। আপনার কাছে কৃতজ্ঞ জনাব। এমন একটি দল আর এমন একটি জায়গা! ঘুরতে না পারলে আফসোসই করতাম। লেগুনা নিয়ে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাকি সবার প্রতিও কৃতজ্ঞতা। আমার জন্য দিনের আধা ঘন্টা সময় খরচ করতে হলো আপনাদের।
আমাদের গাড়ি সারি নদী ছেড়ে হাদারপারের দিকে এগুতে থাকার পর থেকেই বাইরে থেকে চোখ ফিরাতে পারছিলাম না। দূরে আকাশের বুক চিরে পড়া ঝর্ণা, সারি সারি ঘন নীল পাহাড়, যা নৈকট্যে ধিরে ধিরে সবুজ হতে দেখেছি তা ভুলার নয়। হাদারপার বাজারের আগের আধা কি. মি. রাস্তার বিরক্তিকর সময়টা ভুলে গেলাম নৌকাতে উঠে। এ আরেক বিষ্ময়! বাজার থেকে বিছানাকান্দি যাবার উপায় নৌকা। বর্ষায় নৌকা, শীতে হেঁটে কিংবা ট্রাক্টর।
এ প্রান্তিক জনপদের জীবন আরও অনেক গল্পের জন্ম দেয়। জীবনের গল্পগুলো তবু সৌন্দর্যের আভায় ঢেকে যাক আপাতত। আমরা যারা গ্রামে বড়ো হয়েছি, শহরে বুড়িয়ে যাচ্ছি তাদের কাছে এ আর তেমন কি? তবুও নদীর ঘাটে দল বেঁধে কিশোর-কিশোরিদের "মানবনা আজ কোন বাধা" টাইপ উদোম সাঁতারের দৃশ্য! পাথর টানার নৌকার সারি। একটি ইঞ্জিন নৌকার সাথে ছোট ছোট পাঁচ-সাতটি করে নৌকা বেঁধে এক সারিতে এগিয়ে যাবার দৃশ্যগুলোও কি আমাদের যুথবদ্ধ হতে শেখায় না? দুই পাড়ে গ্রাম। আমাদের নদীগুলোতে সোনা ফলে। চকচকে বালু আর সোনালি আভার দুই পারে গড়ে উঠা জনপদের বেশিরভাগই নদীজীবী। কেউ নদীতে নৌকা টানে। কেউ নৌকার মহাজন। কেউ নদীতে মাছ ধরে পাশের বাজারে বিক্রি করে। কারো কারো আছে কোয়ারিতে পাথরের ব্যাবসা। আবার কারো কারো এই নদীতেই ভাসিয়ে দিতে হয় ভাগ্য। মহাজনের প্রতারণার ভাঁজে ভাঁজে সরল মুখগুলোর বিপন্ন হওয়ার গল্পও আছে অনেক। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারির দিকে।
সামনে মেঘালয়। দূর থেকে যে ঘন নীল পাহাড় দেখেছিলাম, এখন তা হাতগোনা দূরত্বে। এখন আর এ পাহাড় নীল নয়, সবুজ। সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে নেমে এসেছে ঝর্ণা। সামনে জিরো পয়েন্ট। কোয়ারির শেষ মাথায় ভারতের সাথে আমাদের সীমান্ত। ওপারে দুটো পাহাড়ের মাঝে উপত্যকার মুখ হলো জিরো পয়েন্ট। সাবধান করা হলো জিরো পয়েন্টের কাছে না যেতে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে তার ১৫০ গজ দূরেই ভারত। কোন কাঁটাতার নেই। তবু দুই দেশকে ভাগ করে দিয়েছে একটি পিলার, একটি ঝুলন্ত সেতু! অদূরেই আছে বিজিবি ক্যাম্প। তাদের অনুমতি নিয়ে গেলে সবচেয়ে ভালো হয়। স্বচ্ছ জলের স্রোত নদীতে মিশে যাচ্ছে। পাথরে আর পানিতে মুগ্ধ দলটির কেউ বড় বড় পাথরে আয়েশি ভঙ্গিমায় বসে বিভিন্ন পোজে ছবি তোলার কাজটি সেরে নিচ্ছেন। কেউ কেউ উদাস হয়ে তাকিয়ে আছে ঝর্ণা আর পানির স্রোতের দিকে! কেউ কেউ আবার শীতল স্বচ্ছ জলের লোভ সামলাতে না পেরে সেরে নিচ্ছেন গোসল। এমন বিছানো সৌন্দর্যের পাশেই স্বমহিমায় পতপত করে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। আরেক পাশে নোম্যান্স ল্যান্ড মার্কার হিসেবে সাদা পতাকা।
পাহাড়ের ধাপে ধাপে ছোট ছোট বাড়ি। আছে ছোট ছোট দোকান। বাজার পর্যন্ত যাওয়া যায়, পরে জেনেছি। তবে না যাওয়াই ভালো। ১২৬৩ নম্বর পিলারের পাশে গড়ে উঠা গ্রামটির নামই বিছনাকান্দি। অনেকেই কোয়ারির ব্যাবসায়ি। বর্ষার ছয় মাস এক দল কোয়ারির বিভিন্ন স্পট চুক্তিভিত্তিক কিনে নেন স্থানিয়দের কাছ থেকে, কেউ নেন লিজ। প্রতিবছর শীতের পর থেকে বর্ষার আগ পর্যন্ত পাথর হারভেস্ট করেন। পরে তা আবার বিক্রি করে দেন পাথর ব্যাবসায়িদের কাছে, চলে আসেন শহরে। শীতে আবার এই গ্রামেই বসত গড়েন পাথর ব্যাবসায়িরা। তারাও আবার পাথর উত্তোলন শেষে ছয় মাস পরে ফিরে আসেন। এক দল যায় এক দল আসে। এভাবেই চলে এখানকার ব্যাবসা। অনেকের নিজস্ব বাড়ি ঘর আছে এখানে। এই গ্রামে বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠি এই কোয়ারির উপর নির্ভরশীল। 'গাত' গুলোর সাথেই অনেক শ্রমিকের ণস্থায়ী আবাস। 'গাত' হলো ১৩-১৫ ফুট নিচ থেকে পাথরের লেয়ার শুরুর গর্ত। শ্রমিকেরা দৈনিক ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্তও রোজগার করতে পারেন। এদের মধ্যে কিছু ভাসমান শ্রমিকও থাকে। যারা আসেন ভোলাগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, চাঁদপুর, ময়মনসিংহ থেকে। স্থানিয় পুরুষ মহিলা মিলেই শ্রমিকের কাজ করেন শীতের ছয় মাস। বর্ষায় করেন কৃষিকাজ।
বেলা অনেক হল। আমরা ফিরব। খিদেও লেগেছে খুব। এতণ তো ভুলেই গিয়েছিলাম খাবারের কথা। পম্পা কচি বা কানিজদের শুকনো মুখের দিকে চোখ না পড়লেও হয়ত আরো অনেকক্ষণ মনেও পড়ত না।
স্বচ্ছ-জলমগ্ন এক অপুর্ব সৌন্দর্যকে পেছনে ফেলে আমাদের নৌকা ছুটে চলছে হাদারপার বাজারের দিকে। হাদারপার বাজারের মোটামুটি সাইজের এক রেস্টুরেন্টে বসে ভুনা খিচুড়ি আর মুরগির মাংস দিয়ে উদরপূর্তি করে ফিরে আসি লেগুনায়। এখানকার খাবারের মান খারাপ না, দামেও বেশ সস্তা মনে হলো। তারপর আমাদের গাড়ি আবার সেই যন্ত্রের শহরের পথে...
যাওয়া আসার পথ: সিলেট শিশু পার্কের সামন থেকে পাওয়া যায় গোয়াইনঘাটগামী লেগুনা অথবা সিএনজি অটো রিক্সা। ভাড়া ৬০-৮০ টাকা। গোয়াইনঘাট থেকে হাদারপার বাজার যেতে হবে সিএনজি অটো রিক্সায়। ভাড়া ৩০-৪০ টাকা। হাদারপার থেকে নৌকা নিয়ে যেতে হবে বিছনাকান্দিতে। ভাড়া যাওয়া আসা ৫০০-৬০০ টাকা।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০১৩ দুপুর ১:২৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




