somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নজরুলের কাছে আমাদের ঋণ: আহমদ ছফা, কিস্তি ৪

২৩ শে অক্টোবর, ২০০৯ বিকাল ৫:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নজরুল উর্দু ভাষায় গজল ও গান লিখেছেন। রাজ নওয়াব আলী রচিত সঙ্গীত বিষয়ক আকরগ্রন্থ ‘মারিফুন্নাগমাতে’র অংশবিশেষের স্বচ্ছন্দ বাংলা তর্জমা করেছিলেন। ভাষার উপর কি রকম দখল থাকলে এরকম একটি দুরূহ গ্রন্থের এমন সাবলীল অনুবাদ করা যায়, তা অনুমান করা অসম্ভব নয়। হাফিজ এবং ওমর খৈয়ামের গজল-রুবাই-এর মূল ফার্সী থেকে তিনি বাংলায় কাব্যিক রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন। সুতরাং ফার্সীর উপর নজরুলের পরিপূর্ণ দখল ছিল, এটা অনুমান এবং কল্পনার বিষয় নয়। হিন্দী ভাষায় রচিত নজরুলের ভজন নেহায়েত কম নয়। ভাষাটি না জানলে শুধুমাত্র স্মৃতি এবং শ্র“তির উপর ভরসা করে ভজন রচনা সম্ভব নয় বলেই ধারণা করি। নজরুল আরবী গানের সুরে গান লিখেছেন। আরবী ছন্দে বাংলা কবিতা লিখেছেন। ভাষাটি তিনি কতটা জানতেন, সে সংবাদ আমাদের জানা নেই। তবে ভাষার উপর বিশদ অধিকার না থাকলেও গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা নজরুলের ছিল, এটা মনে করা অসঙ্গত না। নজরুল ইসলাম বেশ কয়েকটি ভাষা জানতেন, এটা আমাদের কাছে একটা সংবাদ মাত্র। এই ভাষাজ্ঞান দিয়ে তিনি সাহিত্যের কায়া এবং প্রাণের মধ্যে একটা নতুন সংশ্লেষ ঘটিয়েছিলেন, সেই ব্যাপারটি কদাচিৎ আমরা চিন্তা করে দেখি। সে যা হোক, আমাদের মূল বক্তব্য হচ্ছে—আরবী, ফার্সী, উর্দু ইত্যাদি ভাষায় নজরুলের সমধিক অধিকার ছিল এবং সেই কারণে পুঁথিসাহিত্যের ভাষায় নতুন মাত্রা এবং ব্যঞ্জনা সৃষ্টি তাঁর পক্ষে কোন অসম্ভব বা কঠিন কর্ম ছিল না।

সেই সময়টার কথাও মনে রাখতে হবে। ইতোমধ্যে সমাজ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ভিতর দিয়ে অনেকদূর এগিয়ে এসেছে। হিন্দুসমাজের ভেতর উদারতা এবং মেনে নেয়ার শক্তি বেশ খানিকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর মুসলমান সমাজের ভিতরে একটা জঙ্গমতা সৃষ্টি হতে চলেছে। এই সময়ে নজরুলের আরবী-ফার্সী ভাষার শব্দমিশ্রিত কবিতা-গান যখন প্রকাশ পেতে শুরু হয়েছে, হিন্দুসমাজের ব্যক্তিবৃন্দ সাহিত্যে নতুন উপাদান সংযোজন করার জন্য নজরুলকে অভ্যর্থনা জানালেন। আর মুসলমান সমাজের চক্ষুষ্মান ব্যক্তিরা নজরুলের কবিতায় তাদের ব্যবহারিক জীবনের নিত্যব্যবহৃত শব্দসমূহের অকুণ্ঠিত, অসংকোচ প্রয়োগের সাক্ষাৎ পেয়ে তাঁকে আপন ঘরের মানুষ হিসাবে চিনে নিলেন।

নজরুলের কাছে বাঙালি মুসলমান সমাজের অন্যতম প্রধান প্রণিধানযোগ্য ঋণ এই যে, নজরুল তাদের ‘ভাষাহীন পরিচয় ঘুচিয়ে দিয়ে তাদের সামাজিক ভাষাকে সাহিত্য সৃষ্টির ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা দান করলেন এবং স্বীকৃতি অর্জন করে দিলেন। আর নজরুলের কাছে সমগ্র বাঙালি সমাজের ঋণ এই যে, নজরুল বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যকে বাঙলার হিন্দু-মুসলিম উভয় স¤প্রদায়ের ভাষা হিসাবে চিহ্নিত করে নব বিকাশধারায় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে অনেকদূর পর্যন্ত গাঁথুনি নির্মাণ করেছিলেন।


বাঙালি মুসলমান সমাজের ধর্মচিন্তা এবং সংস্কৃতি-চিন্তার মধ্যে একটা দুস্তর পার্থক্য বর্তমান। ইসলাম ধর্মের প্রচার-প্রসার হওয়ার পূর্বে এখানকার যে স্থানীয় সংস্কৃতি বিদ্যমান ছিল, তার স্রোতধারার ভিতরে ধর্ম-ভাবনা পুরোপুরি অবগাহন করতে পারেনি। স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মচিন্তার একটা বিরোধ বরাবর থেকে গেছে। পৃথিবীর অন্যান্য মুসলমান সমাজে এ ধরনের ঘটনা খুবই কম ঘটেছে। যেমন ইরানে ইসলাম প্রসারের পরেও ইরানী জনগণ প্রাক-ইসলামী যুগের উৎসব-আচার, জাতীয় গর্ববোধ কোনকিছু পরিহার করেনি। ইন্দোনেশিয়াতে হিন্দু-ঐতিহ্যের সঙ্গে ইসলাম ধর্ম চমৎকার মিলেমিশে সহাবস্থান করছে অদ্যাবধি। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় নিশানবাহী বিমান সংস্থাটির নাম ‘গরুড়’। প্রতি বছর সে দেশে জাতীয়ভাবে রামায়ণ উৎসব পালন করা হয় এবং জনগণ হিন্দু-ঐতিহ্যের জন্য গর্ববোধ করেন। মুসলিম সন্তানের সংস্কৃতি নামকরণ করতে তাঁদের বাধে না। ইরানে দেখা গেছে ইসলাম পাকাপোক্তভাবে চালু হওয়ার পরেও ইরানী মহাকবিরা অগ্নি-উপাসক পারসিক নরপতিদের স্মৃতিকে সযতেœ লালন করে আরব আগ্রাসনের প্রতিবাদ করছেন।

বাংলা মুলুকেও ধর্ম-সংস্কৃতিতে এক ধরনের সংশ্লেষ যে ঘটেনি সে কথা সত্যি নয়। কিন্তু তার মাত্রা একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করতে পারেনি। খুব সম্ভবত মুসলিম অধিবাসীর সংখ্যা হিন্দুদের অনুপাতে কম ছিল বলে এবং গোটা সমাজের অর্ধাংশেরও বেশি মানুষ অমুসলিম থেকে যাওয়ার কারণে ক্ষেত্রজ সংস্কৃতিটিকে সবসময় সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে। ইসলাম ধর্মের অভিভাকেরা সকল সময়ে স্থানীয় সংস্কৃতির মধ্যে শেরক্ এবং মূর্তিপূজার গন্ধ খুঁজে পেয়েছেন।

বাঙালি মুসলমান সমাজে মিলাদ মাহফিল, ওরস শরীফ, দুই ঈদের জামাত, নবীর দরূদ পাঠ, কোরআন খতমের আয়োজন করা—এ সকলই ছিল সংস্কৃতিচর্চার অন্তর্ভুক্ত শাস্ত্রসম্মত বিষয়। শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠানসমূহ আরবী ভাষার মাধ্যমে পালন করা হত, যার এক বর্ণও আম-জনগণ বুঝতে পারত না। এই ধরনের পরিবেশ-পরিস্থিতিতে জীবনের প্রতি অস্তিবাচক কোন সৃষ্টির প্রত্যাশা এক রকম অসম্ভব। সাধারণ বাঙালি মুসলমানদের আরবী-ফার্সীতে কোন অধিকার ছিল না। অভিজাত মুসলমানদের সমাজে হয়ত কিছুটা আরবী-ফার্সীর আংশিক অধিকার ছিল। কিন্তু সাধারণ মুসলমানদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগের পথ সুগম ছিল না। তাঁরা বাংলায় কথা বলতেন না। আর সাধারণ মুসলমানদের প্রায় শতকরা একশ ভাগই বাংলা ছাড়া অন্য ভাষা বুঝতে পারত না।

পলাশীর যুদ্ধের পর মুসলমান অভিজাত শ্রেণী ক্রমে নিঃশেষ হয়ে যায়। আপদকালে সামাজিক নেতৃত্ব নির্মাণ করার যে দায়িত্ব অভিজাত নেতৃশ্রেণীর থাকে, ভাষাগত কারণে মুসলমান অভিজাতরা তা করতে পুরোপুরি অসমর্থ ছিলেন। উত্তর ভারতের মুসলমান সমাজ যে রকম একজন স্যার সৈয়দ আহমদের মত সংস্কারক ব্যক্তিত্বের জন্ম দিয়েছিল, কিংবা বাঙালী হিন্দু সমাজ যেমন বিদ্যাসাগর-রামমোহনের আবির্ভাব সম্ভাবিত করেছিল, বাঙালি মুসলমান তেমন একজন ব্যক্তিত্বের উত্থান ছিল সামাজিক কারণেই এক রকম অসম্ভব। পরবর্তীকালে বাঙালি অভিজাত মুসলমান সমাজের পক্ষে একজন সৈয়দ আমির আলী জন্ম দেয়া সম্ভব হয়েছিল। সৈয়দ আমির আলী অভিজাত স¤প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। বাংলা ভাষায় তাঁর অধিকার ছিল না। তাঁর সমস্ত রচনা তিনি লিখেছিলেন ইংরেজিতে। তাঁর মধ্যে যে পরিমাণ যুক্তিবাদিতা এবং মনীষার প্রকাশ দেখা যায়, যদি তিনি বাংলা ভাষায় লিখতেন বৃক্ষ-সমাজের মত অনড়-স্থবির মুসলমান সমাজের মোহনিদ্রার অবসান আরো তাড়াতাড়ি ঘটত। কিন্তু তা ঘটতে পারেনি।

(চলবে)
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×