ব্যোমকেশ সিরিজের 'তেতাল্লিশের মতন্বর' দেখছিলাম। বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দূর্ভিক্ষ।পূর্ব বাংলার অজপাড়া গাঁয়ের মানুষেরা দলে দলে ছুটলো ঢাকার দিকে, আর পশ্চিম বাংলার মানুষেরা ছুটলো কলকাতা শহরে। বড়লোক বাবুদের বাড়ির দরজায় দরজায় কি এক হাহাকার; 'ভাত লাগবোনাগো, এক বাটি ফ্যান দিলেই চলবো' পথে ঘাটে মানুষের নিথর দেহ। লাশ পরে আছে নাকি ক্ষুধার্ত নিথর দেহ, বুজার কোনো উপায় নেই।
সেই ভয়ঙ্কর অতীত আর ভাবতে পারছিনা। বর্তমানের কথা বলি। পৃথিবী আজ কঠিন সময় পার করছে। করোনার প্রভাবে চারপাশে কেমন শুনশান ভয়ঙ্কর নিরবতা নেমে এসেছে। পৃথিবীর এই ভয়ঙ্কর নিরবতা আমাকে ছুঁতে পারে নাই, মোটেও না। আমি হাটছি। সন্ধ্যের লালিমা কেটে অন্ধকার নেমে গেছে। হাটতে হাটতে বড় রাস্তার কাছে এসে পৌঁছলাম। মানুষজন নেই। জরুরী প্রয়োজনে যারা বেরিয়েছে তাদেরও বড্ড তাড়া। ঘরে ফিরতে পারলেই মুক্তি। রাস্তার পশ্চিম কোনে কেবল একজন মহিলা নিরলস ভঙ্গিতে বসে আছে। পাশে একটা ছেলে। বয়েস বড়জোড় ৮ হবে। কোলে আরেকটা বাচ্ছা। বোধহয় সদ্য জন্ম নেয়া কন্যা সন্তান হবে। বুজতে পারলাম, ভিক্ষুক। চোখে মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। জনমানবশূন্য এই নগরীতে এই ভিখারীকে কেবা ভিক্ষা দিবে?
আমি দূর্বলচিত্তের মানুষ। মানুষের দুঃখ কষ্ট আমি সহ্য করতে পারিনা। যেখানে দুঃখ কিংবা কষ্ট জড়ো হয়, আমি সেখান থেকে দ্রুত পলায়ন করি। বড় রাস্তা ফেলে গলি রাস্তা ধরে হাটা শুরু করেছি। কি সুন্দর বাতাস বইছে। রাস্তার পাশের আম গাছটাতে প্রচুর আম ধরেছে। ছোট ছোট আম গুলো বাতাসে দুলছে। বাতাসে নাকে চন্দ্রপ্রভা ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। পাশে কোথাও বোধহয় চন্দ্রপ্রভা ফুলের গাছ আছে। কি সুন্দর ঘ্রাণ।
চন্দ্রপ্রভা অপর্ণার খুব পছন্দ। গাছটাকে খুঁজে পেলে কয়েকটা ফুল নিয়ে নেয়া যেতো। হঠাত করে চন্দ্রপ্রভা পেলে সে খুশি হতো। চারপাশে কয়েকবার করে খুঁজলাম, পেলামনা। দীর্ঘ একটা শ্বাস ভেতর থেকে চলে আসলো। হাটা ধরলাম। রাস্তার পাশে কিছু মানুষ এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। আরেকটু সামনে গিয়ে বুজতে পারলাম, শিল্পপতি ধরণের কেউ একজন ত্রান সামগ্রী বিতরণ করছেন। নিম্নবিত্ত মানুষদের ভিড়। ত্রান সামগ্রী বোধহয় শেষের দিকে। সেজন্য পেছনে যারা লাইনে আছেন, তারা অস্থির হয়ে ছুটাছুটি করছেন। একজন বৃদ্ধ লাঠি হাতে খুড়াচ্ছেন। ধাক্কাধাক্কি করার মত শক্তি এবং স্বামর্থ্য কোনোটিই তার নেই। এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে রাস্তার এক কোনে এসে বসে গেলেন। আমি ধীরে গিয়ে তার পেছনে দাঁড়ালাম। ভিড়ভিড় করে বলছেন, 'আজকাও খাওন জুটবোনা।'
আমার আর সহ্য হলোনা। দ্রুত প্রস্থান ঘটালাম। ভেতরে প্রচন্ড রকমের কষ্ট হতে লাগলো। আমার সকল দুঃখ কষ্ট এক বিন্দুতে গিয়ে জমা হয়। অপর্ণা! অপর্ণার জন্য ভেতরটা ঢুকরে কেঁদে উঠলো। 'এই দুঃখ বিগ্রহের দিনে তুমি কই থাকো? জাগতিক এই বিষণ্ণতা আমাকে ধুমড়ে মুছড়ে গিলে খাচ্ছে। দোহাই লাগে তোমার; আমারে বুকে জড়ায়ে নাও; মুক্তি দাও এই বিষণ্ণ পৃথিবী হতে।'
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:৫৩