সৃষ্টি উৎকর্ষতা লাভ করেছে সেই কবে। সময়ের বিবর্তনে মানুষ কোমর সোজা করে দাঁড়াতে শিখেছে কতদিন হয়ে গেল। এরপর আগুন, ভাষা, সভ্যতা একটার পিঠে একটার কি নিপুন বুঁনিয়াদ! আদিম মানুষেরা যখন কথা জানত না; অথচ কি সাবলীল ভাবে বুঝে যেত সঙ্গীর আহ্বান। একটাই প্রয়োজন খাদ্য আসত শিকার থেকে। আর শিকারের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে কি দলবদ্ধ প্রচেষ্টাই না ছিল। আগুনে ঝলসানো মাংস খাওয়া আর খাওয়ার শেষের শৈল্পীক উৎসব। দারুন ব্যঞ্জনার সেই সব দিন মানুষ পার করে এসেছে বহু আগেই। সে যে কোনকালে বানর ছিল তা তার মনেই পড়ে না। তা হোক, সভ্যতার বিকাশ মানুষকে দিয়েছে উন্নত জীবন, দিয়েছে দিয়াশলাই ভরা আগুন, পাহাড়ের মতো অট্টালিকা, আর অজস্র যন্ত্রের কলধ্বনি। যাকে আমরা প্রযুক্তি বলি। মানুষের উন্নত বিবেক নিয়ন্ত্রণ করছে এই প্রযুক্তির বোতামগুলো। এইসব বোতামে হাত রাখতে রাখতে মানুষের থেকে মানুষের হাতগুলো যে কখন অনেক দূরে সরে গেছে আমরা বুঝতেও পারিনি। আমাদের কোমল হাতগুলি প্রতিনিয়তই নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে অজস্র যান্ত্রিক হাত। যেগুলোর বোধ নেই, আছে কেবল মূঢ়তা।
মানুষের মনে যখন থেকে জন্মেছে সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি; তখনই তার রক্তে হু হু করে ঢুকে পড়েছে হিংসা, লোভ আর ক্রোধ। নিজের কুক্ষিগত সম্পত্তির পুটলিতে বসে তৈরী করেছে ক্ষমতার মসনদ। ক্ষমতার জন্যে মানুষ যতটা হিংস্র হয়ে ওঠে, বোধ করি আর কোনকিছুর জন্যে ততটা হয় না। আর মানুষ নিজের এই অমানুষিকতা ঢেকে রাখবার জন্যে তৈরী করেছে কল্পিত ঈশ্বরের লেলিয়ে দেওয়া শয়তান।
একদিন আদিম মানুষ আগুন এনেছিল। আগুন এনেছিল আলো। সেই আলোকে সুইচ আর বাল্বের ভেতরে সীমাবদ্ধ করেছিলেন এডিসন নামের একজন ভদ্রলোক। আর সেই আলোয় বসে কিছু মানুষ এঁকেছিল হিরোশিমা পুড়িয়ে দেবার নকশা। পৃথিবী আলোয় বসে টিপে দেওয়া বোতামে এক সাথে এত মানুষ পুড়তে দেখছিল সেই প্রথমবার। কিংবা ১৯৭১’ এর ২৫শে মার্চ, সেই আলো নিভিয়ে এক সাথে এত মানুষ হত্যা করতে দেখেছিল সেই প্রথমবার। এতদ্বসত্যেও মানুষ সকল দুর্দশা কাটিয়ে সেই আলোতেই উঁকি দিয়েছে।
আদিম মানুষ আগুন এনেছে বহুদিন হলো। সেই আগুন বাক্সবন্দী হয়েছে সেও বহুদিন হলো। এরপর আগুন নিয়ে বহু কবিতা, বহু স্লোগান আমরা শুনেছি- ‘আগুন আগুন খেলা’, ‘জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো’, মুরুব্বীদের সাবধান বাণী, ‘আগুন নিয়ে খেল না’ ইত্যাদি। আগুন জ্বালানো কিন্তু বন্ধ হয় নি তবুও। আগুন জ্বলেই চলেছে তার নিজস্ব রীতিতে-নীতিতে। সিগারেটের মাথায় জ্বলছে, চুলোয় জ্বলছে, ফ্যাক্টরীতে জ্বলছে, কখনও সখনও গৃহবধুর শরীরেও জ্বলছে। খেলার মাঠে যেমন আগুন জ্বলে, তেমনি জ্বলে রাজনীতির মাঠেও। ইদানীং রাজনীতির তাপমাত্রা মাইনাস ডিগ্রী সেলসিয়াসে নেমে এসেছে। তাই তাকে রীতিমতো আগুন দিয়ে উত্তপ্ত করা হচ্ছে। রাস্তায় রাস্তায় টায়ার জ্বালানো হচ্ছে। তাকে চাকায় লাগানো হয় নি, তাই সে নিজে জ্বলে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। রাস্তায় পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালানো হচ্ছে। যে দেশে প্রতি বছর তিনবার করে পেট্রোলের দাম বাড়া নিয়ে প্রতিবাদ হয়, সে দেশে এভাবে অকাজে পেট্রোল নষ্ট করার প্রতিবাদ কেন কেউ করছে না তা আশ্চর্যের বিষয়। হরতাল, অবরোধ একটি রাজনৈতিক দলের মৌলিক অধিকার। কিন্তু মন্দ যখন ভালোকে ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে সে মন্দ অবশ্যম্ভাবী অভিশাপে পরিনত হয়। আগে জানতাম হরতাল মানে দোকান-পাঠ বন্ধ, যান চলাচল বন্ধ। অবরোধ মানে জানতাম যান চলাচল বন্ধ। এখন জানি এর অর্থ ভাংচুর আর অগ্নিসংযোগ। হরতাল আর অবরোধের সমার্থক শব্দই হয়ে গেল- ভাংচুর, অগ্নি সংযোগ। এ পর্যন্ত যখন মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেল তখন নতুন আর একটি শব্দ যোগ হয়ে গেল সোল্লাসে-‘পেট্রোল বোমা’। তাজ্জব হয়ে যেতে হয়, একজন হুশ করে এসে চলন্ত গাড়িতে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে দিয়ে যাচ্ছে, আর মুহূর্তেই পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে কিছু মানুষ, কিছু জীবন, কিছু স্বপ্ন। নিত্যান্ত ক্রোধের বশে কিংবা খামখেয়ালীর বশবর্তী হয়ে ছুঁড়ে মারা একটি পেট্রোল বোমায় শেষ হয়ে যাচ্ছে একটি স্বভাবিকত্ব, একটি সংসার, তাকে ঘিরে থাকা কতগুলো জীবন। এইসব দগ্ধ মানুষদের পেছনের সীমাহীন যন্ত্রণাময় জীবনের একটি মুহূর্তও কি অনুভব করতে পারে সেইসব খামখেয়ালী, কান্ডজ্ঞানহীন পশুটি কিংবা পশু পালকেরা! মানুষ কি মানুষকে ভালবাসতে পারবে না কোনদিন? মানুষকে নিয়ে ভালও থাকতে পারবে না? ভাল থাকতে চাইলেই পুড়িয়ে মারা হবে? কেউ যদি এই ক্ষমতার রাজনীতি না করে; নিত্যান্ত নিরীহ মানুষের মতো দু’বেলা খেয়ে পরে বাঁচতে চায়, তাকেও কি পেট্রোল বোমা দিয়ে মেরে ফেলা হবে? সে তো কোন অন্যায় করিনি। আমাদের পূর্বপুরুষেরা কি এই জন্যেই আগুন করেছিল আবিষ্কার! মানুষ পুড়িয়ে খাবার জন্যে! কেউ প্রকাশ্যে ভালবাসবার জন্যে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ব্যারিকেড করছে। আর আমরা! কোটি কোটি মানুষের ঘামে আর রক্তে ভেজা যে ক্ষমতার আসনে তোমরা বসতে চাও, কতখানি যোগ্যতা আছে তার? আমাদের ঘাম, আমাদের রক্ত অতোটাও নয় মূল্যহীন। তোমাদের থেকে বড় বড় ক্ষমতাধরেরাও এখান থেকে স্লাপ করে পড়ে গেছে। মানুষ পুড়ছে! সেদিকে নজর দিন একবার। আপনার মতোই হাত, পা, চোখওয়ালা জ্যান্ত মানুষ। শপথ করে যাকে রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন, যাকে রক্ষার দায়িত্ব নিতে গিয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে পড়েন আপনারা। ঘুমের ইঞ্জেকশান নিয়ে পড়ে থাকলে কি করে বুঝবেন প্রিয়জন হারানোর বেদনা। স্বাভাবিক মৃত্যুই যদি এত কষ্ট দেয়, তবে পোড়া লাশের গন্ধে তো আত্মারাম ছুটে পালাবার কথা। এবার দরোজা খুলুন- নইলে কি করে জানবেন, বাইরে থেকে ফিরে যায় মানবতার শুভ্র হাত।
সবার কপালে একই রকম লেখা থাকে না। সবাই তাই পুড়েও মরে না। যারা এখনও ধুঁকে ধুঁকে মরছে, তাদের কাছে আপনারা ক্ষমা চান। নির্মমভাবে পুড়ে যাওয়া এইসব হতভাগারা “মানুষ”। এরা ঠিকই আপনাদের ক্ষমা করে দেবে। শেষবারের মতো একবার মানুষ হবার চেষ্টা করুন। অসংখ্য নির্মল হাত চারপাশে, মানুষের হাত। দ্বিধাহীন হাতটা বাড়ান। রচনা করুন ইতিহাসের শ্রেষ্ট মানব বন্ধন। একবার চিন্তা করুন- হাতের ভেতরে হাত, অনেকগুলো হাত, মানুষের হাত। এই হাতের থেকে আপন আর কিছুই নেই। এখনই সময়। নইলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া জনতা কখন যেন বলে ওঠে- ‘ড্যু অর ডাই’।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



