২
কাঁপতে কাঁপতে ঘরে এসে ঢুকলাম। বাইরে কি প্রচন্ড শীত রে বাবা! কলিয়ার্স উডের এক বেডরুমের ছোট্ট একটি ফ্ল্যাট এ ভাড়া থাকি। সুন্দর ছিমছাম বাসা। আমি থাকি উপরে আর নিচের ফ্ল্যাট এ মাসুদ ভাই আর রাজিয়া আপার সংসার। বাড়িটা খুব বেশি দিন হয়নি কিনেছে তারা। দম্পতি খুব অমায়িক। তাদের ৩ বছরের বাচ্চা মারজুক এর সাথে আমার খুব ভাব। বাবা –মা কোথাও গেলে মাঝে মাঝে আমার কাছে ওকে রেখে যায়। সময় গুলো আনন্দেই কাটে।
বাসায় ঢুকে মনে পড়লো ওরা নেই। রাজিয়া আপার মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে দেশে যেতে হয়েছে। আমার কাছে বাসার চাবি দিয়ে বলেছে খেয়াল রাখতে-এখন পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই আছে। আমার ফ্ল্যাট এর দিকে উঠতে উঠতে নায়লার কথা মনে পড়ে গেল। বড় অদ্ভুত মেয়ে।মনে হচ্ছে ঠিক করতে পারছে না ওর কথাগুলো কিভাবে বলবে আমাকে।
-‘আমি আপনাকে সবই বলবো, তবে কলেজের ভেতরে বলতে চাই না। আজ তো শুক্রবার,কাল ছুটির দিন। আপনি আমার সঙ্গে দয়া করে একটু দেখা করবেন? মানা করবেন না…প্লিজ!
-‘আচ্ছা আমাকে এটুকু বল তোমার যে ব্যাপারটা, কলেজের কোন কিছু নাকি ব্যক্তিগত? যদি তাই হয় সেটা তুমি আমাকেই বলতে চাও কেন? দেখ, আমি তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করতে প্রস্তুত, কিন্তু আমারও কিছু সীমা অতিক্রম করা নিষেধ। প্রাতিষ্ঠানিক প্রবলেম হলে বাইরে এটা নিয়ে আলাপ করাটা ঠিক হবে না।
_’না, না আপু ব্যাপারটা পার্সোনালই। আপনি আমার দেশি মেয়ে, অনেক কিছু আছে যা আপনি বুঝলেও অন্যেরা ওভাবে বুঝবেনা। আর আপনার সাথে আমি কথা বলে সাচ্ছ্যন্দ বোধ করছি। আমার যে ধরনের বিপদ এটা আমি অন্য কারো সাথে শেয়ার করতে পারছি না বলেই আপনা্র কাছে কিছু সময় চাইছি। দেবেন না আপু, শুধু অল্প একটু সময়? আমি জানি আমাকে আপনিই সুরাহা দিতে পারবেন!
এমন করে বলার পর,না করি কি করে?
-‘ঠিক আছে।কোথায় আসতে হবে বলো।
-‘আমরা টুটিং এ দেখা করি? আমি টিউব স্টেশনে পৌছে আপনাকে ফোন দেবো?
-‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমার নাম্বারটা নিয়ে রাখো।
* * * * *
ক্লান্তিতে সারা শরীর ভেঙ্গে আসছে।রান্না করতে ইচ্ছে করছে না। বাটিতে কর্ণফ্লেক্স নিয়ে খেতে বসলাম।
সোফায় বসা আর খাওয়ার মাঝে এক এক করে আমার তিন বোনের কল আসলো।প্রতিদিনের মত আজও তিন জনকেই আমার সারাদিনের কর্মকান্ডের বিবরণ দিলাম। কথা শেষ করে টিভি খুলে বিবিসির খবর দেখছি, মাথায় আবারও নায়লার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। আগে খেয়াল করিনি ,তবে একটা ব্যাপার বার বার ভাবছি মেয়েটার চেহারাটা পরিচিত মনে হচ্ছে কেন? কোথায় যেন দেখেছি! মনে করতে পারলাম না। আমি কি ওকে চিনি? নাহ, আসলেই বেশি ইম্পরটেন্স দিয়ে ফেলছি। কলেজের ছাত্রী- হয়তোবা সেখানেই দেখেছি। তারপরও কেন জানি ভাবনাটা মন থেকে গেল না পুরোপুরি ।বাইরে মুষল ধারে বৃস্টি পড়তে শুরু করেছে।জানালার ফাক দিয়ে হালকা বাতাস আসছে ঘরে।বিবিসির খবরের প্রতি আর আকর্ষণ বোধ হলো না বিধায় বাতি নিভিয়ে সোফাতেই শুয়ে পড়লাম। চোখ ভেঙ্গে মূহুর্তেই রাজ্যের ঘুম নেমে এলো…
আমি এখানে এলাম কেমন করে? চারিদিকে বিস্তির্ণ মাঠ, বাতাসে ভেজা মাটির গন্ধ …দূরে সাদা পোশাকে দাড়িয়ে একজন। ঠিক দেখতে পারছি না কে? ধীরে ধীরে মানুষটি আমার দিকে আসতে শুরু করলো। আমিও একটু করে আগাচ্ছি, চেনার চেস্টা করছি তাকে।
-‘সায়বা! সায়বা!’
থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কন্ঠসরটি অতি পরিচিত। আমার শরীর বেয়ে একটা শীতল ভয়ঙ্কর কম্পন নেমে গেল। পাঁ শক্ত হয়ে আসতে শুরু করেছে।।আমি চিনেছি সে কে ,কিন্তু তাঁর সামনে দাঁড়াতে চাই না! আমাকে দ্রুত পালাতে হবে এখান থেকে। আমি কাঁচের টুকরোর মত চৌচির হয়ে যাবো-তবে কক্ষনো ঐ মানুষটির সামনে নয়!
-‘সায়বা! দাড়াও,শোন! একটু দাড়াও না,প্লিজ!’
আমি দৌড়ে পালানোর চেস্টা করছি, সে আসছে আমার পিছু পিছু… ধরে ফেললো বলে…
-
‘না…!!!!’
ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। এত দিন পর কেন তাঁকে দেখলাম আবার? কই একবারও তো আজ ওকে নিয়ে ভাবিনি! ওহ! আল্লাহ! সারাটা জীবন কি সেইসব দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করে বেড়াবে আমাকে?! আমার মুক্তি হবে কবে খোদা?! আমি কেন তার চেহারা ভুলতে পারি না? কেন বার বার সপ্নে এসেও সে আমাকে খুঁজে বের করে? আর পারি না আল্লাহ! আর পারি না!
বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসে বেশ কিছুদিনের জমে থাকা আর্তনাদ। মনে হলো যেন আট বছর আগের সেই দিন্ টির মত আরও একবার আমি মরতে বসেছি। বাঁধ ভাঙ্গা জলধারা নেমে যাচ্ছে দু’চোখ থেকে। আটকাতে চাইছি বৃথাই-সে ক্ষমতা অনেক আগেই হারিয়েছি-এ অস্রুর তো কোন শেষ নেই…
রাত বাড়ে। প্রবল বৃস্টির শব্দ ছাপিয়ে আমার কান্নাজড়া কন্ঠের ব্যাকুলতা একজন মানুষের কানে গিয়ে সে রাতে ঠিকই বেজেছিল, শুধু আমি তার কিছুই জানতে পারিনি।
(অসমাপ্ত)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



