লন্ডনে সূর্যের আলোর এত তীব্রতা থাকে না।
আজ লাগছে খুব! ঠিক মত চোখ মেলে তাকানোও যাচ্ছে না। টের পাচ্ছি একটা মাইগ্রেন এর ব্যথা আসি আসি করছে। রাতে ঘুম ভেঙ্গে যাবার পর সারারাত মনে হচ্ছিল রাজিয়া আপাদের ফ্ল্যাট এ খুট খুট কি যেন শব্দ হচ্ছে। ভয়ে নিচে গিয়ে দেখার সাহস হয়নি। তার উপর আবার প্রবল বৃষ্টি আর বজ্রপাত। অবশেষে অনেক কষ্টে ঘুম যা ও এল উঠে দেখি ১০টা বাজে। তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে আসার সময় আর মনে নেই নিচে দেখে আসতে সব ঠিক আছে কিনা।
মিনিট পনের ধরে দাঁড়িয়ে আছি টুটিং ব্রডওয়ে স্টেশনের সামনে। ঠিক ১১টায় নায়লার আসার কথা, এখন বাজছে ১১টা বেজে ২৫ মিনিট। ভাগ্যিস ওর এসএমএস টা ঘুম থেকে উঠেই দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু কই মেয়েটা? হারিয়ে যায়নি তো আবার? পথ-ঘাট ঠিকমত চেনে কি না তাও তো জিজ্ঞেস করিনি। কোথায় থাকে কি করে,কিছুই তো জানি না! আমি তো ধরেই নিয়েছি যে আমার কলেজের ছাত্রী।কত হবে বয়স? ২৩ কি ২৪? বিয়ে হয়েছে মনে হয়।আর ওর সমস্যাটা সম্ভবতঃ সেটা নিয়েই। তারপরও… হঠাৎ আমার ফোন বেজে উঠলো। নাম্বারটা দেশের।
-‘হ্যালো,সায়বা?’
-‘রাজিয়া আপা? কি খবর? খালাম্মার কি অবস্থা?’
-‘এখন কিছুটা ভাল। সায়বা, লাইনটা ভাল না। আমি তোমাকে একটা উপকারের জন্যে ফোন করেছি…’
-‘বলেন আপা…?’
-‘আমার ছোট দেবর মাশুক খুব অসুস্থ। হল থেকে আমার বাসায় চলে যেতে বলেছি। কাল রাত থেকে তোমার ফোন এ চেষ্টা করছি, পাচ্ছিলাম না। তুমি একটু ওর খোঁজ রাখতে পারবে প্লীজ? রাতেই বোধয় বাসায় চলে গেছে।’
-‘ঠিক আছে আপা, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি দেখব। আপনি খালাম্মার খেয়াল রাখেন ।এদিকটা আমি সামলাবো’।
-‘আমি মাসুদ কে বলেছি,তুমি থাকতে আমাদের চিন্তা করতে হবে না। অনেক ধন্যবাদ, সায়বা। তাহলে এখন রাখি? ওহ আরেকটা কথা…’
কথা না শেষ হতে লাইনটা কেটে গেল। ফোন রাখতে রাখতে দেখতে পেলাম নায়লা আসছে আমার দিকে। ঘড়িতে তখন বাজে পৌনে ১২টা। আজ কেন জানি আরও বেশি করে মনে হচ্ছে আগে কোথাও দেখেছি ওকে…
-‘কি ব্যাপার,এত দেরি যে?
-‘একটু হারিয়ে গিয়েছিলাম। অনেক্ষন অপেক্ষা করছিলেন,না? সরি। আসলে এইদিকটাতে বেশি আসা হয়না তো,তাই। আমি থাকি নর্থ লন্ডনে।
-‘ঠিক আছে ,চলো এখন কোথাও বসি। আমাকে একটু জলদি ফিরতে হবে বাসায়। একজন খুব অসুস্থ।’
-‘হ্যাঁ ঠিক আছে। চলুন, যাওয়া যাক’।
স্টেশন থেকে রাস্তা পার হয়ে দুজনে ক্যাফে নিউরোতে ঢুকে কফি’র অর্ডার দিয়ে বসলাম ।এবার সকল রহস্যের পাট চুকানোর পালা। নায়লার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-‘ এবা্র শুরু কর’।
-‘জী,বলছি। তবে অনুরোধ আপনাকে,আমার কথা শেষ হলে এর পর আপনি মন্তব্য করবেন’।
-‘ঠিক আছে’।
নায়লা বলতে শুরু করলো…
-“আমার বাবা ৩০ বছর আগে এ দেশে আসেন আমার মাকে নিয়ে। তিন বোন এক ভাই এর মধ্যে আমি ২য়। জন্ম এখানে হলেও জীবনের বেশ কিছু অংশ আমরা বাংলাদেশেও কাটিয়েছি। এসএসসি পর্যন্ত পড়া শেষ হতেই বাবা বিয়ের জন্যে ছেলে দেখা শুরু করলেন। ইতিমধ্যে বড় বোনের বিয়ে হয়ে সে এক সন্তানের মা ।আমার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। ২০০৩ এ আমার পরীক্ষা শেষ করে চাচার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে শুনলাম পরিকল্পনা করে আসা হয়েছে। আমাকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে তাই।
আমি বরাবর ভাল ছাত্রী ছিলাম। প্রেম-ভালোবাসার যে চল ছিল এড়িয়ে চলেছি, উল্টাপাল্টা আড্ডা দেইনি এমনকি বন্ধুদের বাড়িতেও মায়ের অনুমতি ছাড়া কখনো যাওয়া পড়েনি। একটু চুপচাপ থাকতে পছন্দ করতাম। দরকার ছাড়া তেমন কথা বলতাম না কারো সাথে। এমন সভাবের কারনে অনেকেই আমাকে ভুল বুঝেছে।কিন্তু ইচ্ছে করে এমন করতাম না আমি ।আমার ভাবনাগুলো কে কখনো সহজে প্রকাশ করতে পারতাম না, ভেতরে রেখে দিতাম। তাই বিয়ে করার তেমন ইচ্ছে না থাকলেও বাবা-মা’র মতের বাইরে বলতে পারিনি কিছু।
যথারিতি পাত্রপক্ষ আসার দিন এলো। ছেলে আমার চাচার এক প্রাক্তন ছাত্রের ছোট ভাই। ঢাকায় এক নামকরা স্কুলের ডিরেক্টর এবং পার্টনার। বিকেলের দিকে ওরা এলো। দুই ভাই, ভাবী আর ছেলে নিজে।সবাই বসে কথা বললো অনেক্ষন।এরপর আমাকে আর ছেলেকে একা কিছুক্ষন কথা বলার দেয়ার জন্যে আরেকটা রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। প্রথম বারের মত আমি তাকে দেখলাম ভালো করে। সে দেখতে খুবই সুদর্শন। এত্ত সুন্দর করে কথা বলে! কোন কথা বলতে তার কোন দিধাবোধ নেই। তার সাবলীল কথা বলার ঢং আমার খুব ভাল লেগে গেল। মনে হলো এ পুরুষ ছাড়া আমার জীবন অর্থহীন।এমন অনুভব আমার জীবনে প্রথম। আমি আমার হবু বরের প্রেমে পড়ে গেলাম।
খুব অল্প দিনের ভেতর আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। সব কিছু ঘটে যাচ্ছিল সপ্নের মত করে। খুব আনন্দে আর ভালবাসায় দিন কাটছে। মনে হত সবাই আমার বরভাগ্য দেখে ঈর্ষা করছে। এত সুন্দর, ভদ্র, অসাধারন মেধাবি একজন কে জীবন সাথী হিসেবে পেয়ে কার না ভাল লাগবে? আমাদের পরিচয় বেশি দিনের ছিল না বিধায় একটু একটু করে ওকে জানছি,চেনার চেস্টা করছি। বিয়ের প্রথম ৩ মাস এভাবেই কেটে গেল। কিন্তু ওর জীবনের এমন কিছু ব্যাপার আমি জানতে পারলাম, যা আমার অন্তরটাকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিল…’
এটুকু বলে নায়লা এমন ভাবে কাঁদতে আরম্ভ করল যেন সত্যি ওর অন্তর ভেঙ্গে যাচ্ছে…ওর কষ্ট দেখে আমারও চোখ ভরে গেল।
(অসমাপ্ত)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



