সূত্র: প্রথম আলো, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১০।
বিজয় যখন কড়া নাড়ছেআত্মসমর্পণের আগে...
নিকোলাস টোমালিন, ঢাকা থেকে | তারিখ: ১৪-১২-২০১০
০ মন্তব্যপ্রিন্টShareThis« আগের সংবাদ পরের সংবাদ» ঢাকায় বৃহস্পতিবার আত্মসমর্পণের আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শহরের বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করেছে এবং তাঁদের মধ্যে পঞ্চাশেরও বেশি লোককে গুলি করে হত্যা করেছে। আকস্মিক সামরিক অভিযানের অংশ হিসেবে নিবিড় পরিকল্পনার আওতায় বাঙালি এলিট নিধনের অংশ হিসেবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। এটা অবশ্যই কমান্ডিং অফিসার জেনারেল নিয়াজিসহ পাকিস্তান হাইকমান্ডের পূর্ণ জ্ঞাতসারে ঘটেছে।
এসব মৃতদেহের আবিষ্কার ঢাকা শহরে উত্তেজনা বাড়াতে পারে, পাল্টা হত্যাকাণ্ড ও দাঙ্গার জন্ম দিতে পারে, এমনকি মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যেও সংঘর্ষের সৃষ্টি করতে পারে।
ঢাকার মূল শহরের পাশের রায়েরবাজারে কতগুলো বিচ্ছিন্ন গর্তে নিহত বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়। আমি নিজে ৩৫টি গলিত দেহ দেখেছি। আপাতদৃষ্টে মনে হয়, তাঁরা চার-পাঁচ দিন আগে নিহত হয়েছেন। মৃতের সংখ্যা সম্ভবত আরও বেশি হবে। ঢাকায় অপহরণ করা এ ধরনের লোকের সংখ্যা অন্তত ১৫০ হতে পারে।
ইউপিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রধান হূদেরাগ চিকিৎসক ফজলে রাব্বী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান মুনীর চৌধুরী রয়েছেন। ঢাকার মধ্যবিত্ত এলাকা ধানমন্ডির বাইরে একটি ইটখোলাকে বধ্যভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। যদিও কচুরিপানার নীল-সাদা ফুল কর্দমাক্ত জলাশয়ে শোভা পাচ্ছে। স্থানটি লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন। আজ ঢাকার শত শত মানুষ মাটির বাঁধ দিয়ে হেঁটে হেঁটে এখানে এসেছে, তাদের অনেকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে নিরুদ্দিষ্ট স্বজনদের।
বিশিষ্টজনদের অপহরণ করে তুলে নেওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে মঙ্গলবার সকালেই। পাঞ্জাবি সেনাদের কয়েকটি স্কোয়াড নির্দিষ্ট ঠিকানায় হাজির হয়ে নির্ধারিত পুরুষ ও নারীকে সশস্ত্র প্রহরায় উঠিয়ে নিয়ে এসেছে। তাঁদের সম্ভবত রায়েরবাজার ইটখোলায় এনে মাটির বাঁধের পাশে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করেছে, যাতে তাঁরা হুমড়ি খেয়ে নিচের জলাশয়ে পড়ে যান।
দেহগুলো এখনো সেখানে শায়িত, কাদা ও বালুতে মাখা, গলতে শুরু করেছে। ঢাকার কুকুরগুলো নাটকীয়ভাবে একটি দেহের কঙ্কাল তুলে এনে বাঁধের ওপর ফেলে রেখেছে। এই কাদার মধ্যেই বাঙালি জনতা অদ্ভুতভাবে শক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে না এখানে তারা ক্ষুব্ধ। কিন্তু অন্যত্র তারা ক্ষিপ্ত। এখানে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে, বিড়বিড় করে কথা বলছে, যেন তারা একটি গির্জা দেখতে আসা পর্যটক।
একটি জলাশয়ের পাশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ, সেখানেই পাওয়া গেছে সবচেয়ে বেশি মৃতদেহের স্তূপ। একজন মুসলমান ব্যক্তি উলের মাফলারে মুখটা ঢেকে চিৎকার করে বিলাপ করছেন। মুয়াজ্জিনের নামাজের আহ্বানের মতো শোনাচ্ছিল তাঁর স্বর। আমরা তাঁর নাম জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, তিনি আবদুল মালেক, ঢাকার একজন ব্যবসায়ী। সামনের জলাশয়ে তিনি তাঁর তিন ভাইকে শনাক্ত করতে পেরেছেন—বদরুজ্জামান, শাহজাহান ও মুল্লুক জাহান। তাঁরা পাশাপাশি পড়ে আছেন। তাঁরাও ঢাকার ব্যবসায়ী। তাঁদের ব্যবসা পারিবারিক। তাঁর আর কোনো ভাই নেই।
আবদুল মালেক বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মঙ্গলবার ভোর সাতটায় এসে হাজির হয়। ঘটনাচক্রে আমি আগেই বেরিয়ে গিয়েছিলাম।’ তখন আমার সঙ্গী যুবকটিও কাঁদতে শুরু করে। তাঁর নাম নাজিউর রহমান, ঢাকার ছাত্র। তিনিই আমাকে এই ইটখোলায় নিয়ে এসেছেন। তিনি তাঁর ভগ্নিপতিকে খুঁজছেন।
ড. আমিনুদ্দিন বেঙ্গল রিসার্স ল্যাবরেটরির প্রধান, অক্সফোর্ডের পিএইচডি। পাকিস্তানি সেনারা যখন তাঁকে তুলে নেয়, সেই মঙ্গলবার ভোর সাতটায় তাঁকে শেষবারের মতো দেখা যায়। নাজিউর রহমান বললেন, ‘আমি দুঃখিত, আমাকেও যেতে হচ্ছে, খুঁজে দেখি।’ ততক্ষণে তিনিও উলের মাফলার দিয়ে নাক-মুখ পেঁচিয়ে নিয়েছেন।
গতকাল আমি কেবল তিন ঘণ্টা ঢাকায় ছিলাম, ততক্ষণে ইটভাটার এই খবর তেমন ছড়ায়নি। জনতা উত্তেজিত, তবে আচরণে অদ্ভুত কোমলতা। ভারতীয় সেনাদের হাত নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছে, গাড়িতে এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রাপ্ত পর্যন্ত যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে।
সেদিনও অনেক গোলাগুলি হয়েছে, বিশেষ করে, রাতের বেলায়। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অবস্থানরত সাংবাদিকেরা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি তখনো বিস্ফোরণোন্মুখ। বাঙালিরা অভিযোগ করছে, বিহারি এই বিদেশিরা বহু বছর আগে মুসলমান হিসেবে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে, তারা বাঙালি হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের সাহায্য করেছে। আট মাস আগে আমি যখন যশোরে ছিলাম, এ কারণেই সেখানে বেসামরিক বিহারিদের হত্যা করা হয়। ঢাকায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড যশোরের হত্যাকাণ্ডের চেয়ে শতগুণ বেশি ভয়াবহ একটি ব্যাপার। কাজেই এক ধরনের প্রতিশোধ গ্রহণের ব্যাপার অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।
ইতিমধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রহরায় সেনানিবাসে বন্দী পাকিস্তানি সেনারা এখনো সশস্ত্র, যদি প্রয়োজন পড়ে! ঢাকা যখন জেনে যাবে পাকিস্তানি সেনারা কত পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তখন দেখা দেবে সত্যিকারের সংকট। যা-ই ঘটুক, পরাজিত পাকিস্তানি সেনাদের জন্য সহানুভূতিপ্রবণ হওয়া বাঙালিদের জন্য ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। এ রকম একটি সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী এভাবে খেলাচ্ছলে অপ্রয়োজনে, উন্মত্তের মতো খুন করতে পারে, তা অবিশ্বাস্য।
যদি পাইকারি হত্যাকাণ্ডকে সংবাদপত্র গণহত্যা আখ্যায়িত করে, তা অবশ্যই ভয়ংকর; কিন্তু পরিকল্পিতভাবে বাছাই করে জাতির সবচেয়ে যোগ্য, বুদ্ধিমান ও গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ ও নারী হত্যার মাধ্যমে যদি জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেওয়া হয়, সেই ‘এলিটোসাইড’ এলিট হত্যা যে আরও বেশি ভয়ংকর।
গত মঙ্গলবারের অনেক আগেই পাকিস্তান শেষ হয়ে গেছে। যেসব কর্মকর্তা এই পরিকল্পনা করেছেন, তাঁরাও তা অবশ্যই জানেন। কাজেই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকেও ধসিয়ে দেওয়া। বহুদিন ধরেই অনুমান করা হচ্ছিল, পাঞ্জাব মরুভূমির রুক্ষ সেনারা বাঙালিদের প্রতি হিংস্র বর্ণবাদী ঘৃণা লালন করে আসছে। এখন দেখা যাচ্ছে, তারা বুদ্ধিভিত্তিক ঈর্ষাও লালন করছে, যার প্রকাশ ঘটেছে এই ব্যাপক হত্যাকাণ্ডে।
দ্য সানডে টাইমস, ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ (ঈষৎ সংক্ষেপিত)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



