তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানব। দু জাহানের সর্দার। সর্বশেষ নবী। মহান রাব্বুল আলামীন যুগে যুগে মানুষের হোদায়েতের জন্য অগনিত নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। যারা প্রত্যেকেই ছিলেন তাঁর প্রিয় বান্দা। তাঁর পক্ষ থেকে বিশেষ বার্তাবাহী। তাঁরা নিয়ে এসেছিলেন হেদায়েতের দিশা, কল্যাণের বার্তা। মানবজাতির চূড়ান্ত মুক্তির পথ। সেইসব প্রিয় বান্দাদেরই সর্বশেষ তিনি। তিনি সকলের পরে এসেছেন, কিন্তু পেয়েছেন সর্বশ্রেষ্ঠ মুকুট। সকলের পরে এসেও আসীন হয়েছেন সর্বশ্রেষ্ঠ আসনে। তিনি বলে গেছেন, তাঁর আগমনের মধ্য দিয়েই সমাপ্ত হয়েছে আলাহর বিশেষ বান্দাদের আগমনের এই ধারা। অতএব, তাঁর পরে কেয়ামত পর্যন্ত এমন আর কেউ আসবে না। কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মানুষের জন্য তিনিই সকলের নবী আর সকলেই তাঁর উম্মত।
তিনি ছিলেন সকল গুণের আধার। সকল সৌন্দর্যের উৎসধার। গুণের উপমায় তাঁর মত আর কেউ ছিল না। ছোট-বড়-সমবয়সী সবার কাছে তিনি ছিলেন সমান প্রিয়। তাঁর সংস্পর্শে এসে প্রত্যেকেই ভাবত, তিনি আমার মত আর কাউকেই হয়ত এতো ভালোবাসেন না। শৈশব যার গড়ে উঠেছিল ‘আল-আমিন’ উপাধিতে। ‘আল-আমিন’ এর অর্থ বিশ্বস্ত। সবার কাছে তাঁর ছিল এমনই বিশ্বস্ততা। যৌবনে যখন তিনি কর্মক্ষম, হযরত খাদিজা পেলেন তাঁর বিশ্বস্ততার পরিচয়। নিজ ব্যবসায় অভূতপূর্ব লাভের মুখ দেখলেন। মুগ্ধ হলেন তাঁর প্রতি। এমনকি তাঁর সঙ্গে প্রণয়াবদ্ধ হতেও আগ্রহ দেখালেন। পরিণত বয়সে তিনি যখন নবুওয়াত পেলেন তখনও বিরোধীরা তাঁরা বিরোধিতার জন্য অযৌক্তিক বিষয় ছাড়া আর কিছুকেই খুঁজে পেত না। প্রচণ্ড বিরোধিতার মধ্যেও স্বীকার করত তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমা। তাঁকেই মনে করত আমানতের উপযুক্ত আশ্রয়।
দূরের ইয়াসরিবাসীর উদগ্রীব চাহনি আর প্রত্যাশা পূরণে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সেখানে পাড়ি দিবেন। ছেড়ে দিবেন মক্কা নগরী। গোড়াপত্তন করবেন ‘মদীনাতুন্নাবী’ নামে এক নতুন শহরের। আজ থেকে চৌদ্দশত বছর আগের ঘটনা। তখন যোগাযোগ মাধ্যম মোটেও সহজসাধ্য ছিল না। জন্তু বা জন্তুনির্ভর বাহনই ছিল মানুষের প্রধান আশ্রয়। বন্ধু আবু বকরকে বললেন দুটি উট প্রস্তুত করে রাখতে। চারদিকে শত্র“র সন্ধানী চোখ। হ্যাঁ, এমন একজন মানুষেরও শত্র“ ছিল। অজ্ঞতা, মুর্খতা আর ক্ষমতার মোহ মানুষকে এমনই অন্ধ করে দেয়। নিশিরাতে হযরত আলীকে আপন বিছানায় রেখে চুপিচুপি বের হয়ে গেলেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম এই মানুষটি স্বজাতির জ্বালাতনে অতীষ্ঠ হয়ে এক দূর জনপদের উদ্দেশ্যে। রয়ে যাওয়া অনুসারী হযরত আলীর দায়িত্ব ছিল তাঁর কছে রক্ষিত আমানতগুলো যথাস্থানে যেন পৌঁছে দেওয়ার। তিনি যে শৈশব হতেই ছিলেন ‘আল আমিন’ -সকলের বিশ্বস্ত।
ছেড়ে যাওয়া এই শহরটিতেই তিনি এসেছিলেন আরো অনেক পরে। বিজয়ী বেশে। এসে আর থাকেননি। এই শহরবাসীর সবাইকেই তখন ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র এগারজন মানুষকে ক্ষমার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই এগারজনেরও অধিকাংশ ক্ষমা প্রার্থনা করে মুক্তি পেয়েছিল।
দেহাবয়বেও তিনি ছিলেন অপূর্ব। এক জ্যোতির্ময় দেহ সৈষ্ঠব ছিল তাঁর দেহ জুড়ে। অধিক স্থুলকায় ছিলেন না। ছিলেন না অধিক শীর্ণকায়। অধিক লম্বা ছিলেন না। ছিলেন না অধিক বেটে। তাঁর দেহ ছিল মাঝামাঝি গড়নের। অথচ অনেক লোকদের মধ্যে দাঁড়ালে তাকেই বড় মনে হত। হাঁটতেন দৃঢ় পদে। কিছুটা সামনের দিকে ঝুকে। কারো সাথে কথা বললে তাঁর দিকে পুরো দেহ ঘুরিয়ে দাঁড়াতেন। কেউ হাত মিলালে নিজ থেকে সে হাত ছাড়িয়ে নিতেন না। তিনি যখন হাসতেন তখন মুচকি হাসতেন। কখনো ঝকঝকে দন্তপাটি দেখা যেত। তবে আওয়াজ করে কখনো হাসতেন না। তাঁর এই দেহগঠনের বর্ণনাসমৃদ্ধ হাদীস নিয়ে ইমাম তিরমিযী রহ. কর্তৃক সংকলিত হয়েছে ‘আশ-শামায়িলুল মুহাম্মাদিয়্যাহ’। যা আমাদের নিকট ‘শামায়েলে তিরমিযী’ নামে প্রশিদ্ধ। একবার তাঁর চাচা হয়রত আব্বাস রাযি.কে কেউ জিজ্ঞেস করল- বড় কে? তিনি না আপনি? হযরত আব্বাস রাযি. জবাব দিয়েছিলেন- বয়স আমার বেশি তবে বড় তিনি।
তিনি গত হয়েছেন আজ চৌদ্দশত বছরেরও অধিক। এই রবিউল আওয়াল মাসেই তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন আর এ মাসেই তিনি পৃথিবী থেকে গত হয়েছেন। কুরআনের ভাষায় তিনি একথা বলার জন্য আদিষ্ট ছিলেন- বলুন, হে পৃথিবীর মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্যই আলাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল। সুতরাং তাঁর এ আদর্শ জাত-পাত, গোষ্ঠীভেদে এ পৃথিবীর সকল মানুষের জন্যই...
তাঁর প্রতি হৃদয়ের গহীন থেকে থেকে লক্ষ কোটি দুরূদ ও সালাম,
“মুহাম্মাদ” সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম