তখন সবেমাত্র এইচ. এস. সি শেষ করেছি। ফার্মগেটে কোচিং করা ছাড়া আর কোন কাজ কাম করি না। মোটামুটি রিলাক্স মুডেই দিনকাল কাটাচ্ছি।

কোচিংয়ে যাওয়ার জন্য ভাড়া বাবদ যা টাকা পেতাম তা থেকেই হাত খরচ চালাচ্ছি। তো যাই হোক, হঠাৎ আমার এই গা ছাড়া রিলাক্স মুড পর্যবেক্ষন করে এলাকার এক বড় ভাই একদিন ডেকে বললেন উনার এক রিলেটিভের বাচ্চাকে প্রাইভেট পড়াতে হবে। এলাকার বড় ভাই বলে কথা, আমিও আর না করতে পারলাম না। একদিন বিকালে আমাকে তিনি নিয়ে গেলেন ওই বাসায়। আন্টির সাথে কথা হলো, যাকে পড়াবো সেই ছেলেটি স্ট্যান্ডার্ড ফাইভে পড়ে, ওর সাথেও কথা হলো। সেদিন চলে এলাম ভাইয়ের সাথে। তিনি জানালেন আমাকে মাসে ৩০০০ টাকা করে দেয়া হবে। যদিও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের স্টুডেন্ট হিসেবে এই টাকা বেশ কম, তবুও আমি কিছু বললাম না-এলাকার বড় ভাইয়ের আত্মীয় বলে কথা! তো আমার সুবিধামতো দিন থেকে পড়ানো শুরু করলাম। প্রথমে কথা ছিল পড়াবো সপ্তাহে তিন দিন করে। কয়েকদিন পর আন্টি এসে বললেন, 'বাবা আমার ছেলেটাতো বেশ দূর্বল, ওকে আরেকটা দিন বেশি সময় দিতে পারবে?' বেচারী এমনভাবে বললেন, আমি কথাটা ফেলতে পারলাম না, আর ওনার মুখের উপর না করি কিভাবে। আমার প্রাইভেট পড়ানোর অভিজ্ঞতাও তেমন যে নেই, এই কথাও তিনি মনে হয় টের পেয়ে গিয়েছিলেন। এই সুবাদে আমাকে দিয়ে কোনো কোনো সপ্তাহে পাঁচ দিনও পড়িয়ে নিয়েছিলেন। আমিও বলদের মতো এক ঘন্টার যায়গায় কখনো ২/৩ ঘন্টাও পড়াতাম!!! পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে তিনি এসে সুখ-দু:খের আলাপও করতেন আমার সাথে। এদিকে আমার স্টুডেন্ট ক্লাস টিউটোরিয়াল গুলোতেও ভালো মার্কস পেলো। টার্ম ফাইনাল পরীক্ষার শুরুর আগে আন্টি এসে রিকোয়েস্ট করলেন প্রতি পরীক্ষার আগের বন্ধের দিন আমি যেন সকাল বিকাল দুইবার আসি!!! এ কথা শুনে আমার টনক নড়ল, মনে মনে ভাবলাম 'এই বেটি কয় কি!!!' মুখে বললাম আন্টি আমি একটু ব্যাস্ত থাকি তো সকালে আসতে পারব না। তাও উনি রিকোয়েস্ট করতেই থাকলেন, বাধ্য হয়ে একদিন সকাল-বিকাল দুইবার গেলামও। এদিকে আমার এডমিশন টেস্ট শুরু হয়ে যাচ্ছে তাই আমি দেখলাম এখন আর প্রাইভেট পড়ানোর মতো সময় পাব না, তাই একদিন আন্টিকে ডেকে বললাম অন্য আরেকজন টিউটর ম্যানেজ করতে। তিনি তো নাছোড়বান্দা!! আমাকে কোনোমতেই ছাড়বেন না। তারপরও আমি অনেকগুলো কারন দেখানোর পর মোটামুটি রাজি হলেন। তো এভাবে এক মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত পড়ালাম। এরপর উনি বললেন যে স্কুলের একজন টিচার ওকে পড়াতে রাজি হয়েছেন। আমি হাফ ছেড়ে বাচঁলাম। ভর্তি পরীক্ষার ফরম তোলা, জমা দেয়া, পরীক্ষা দেয়া ইত্যাদি কাজে আমি ব্যাস্ত হয়ে গেলাম। এরমধ্যে উনি আর ফোন-টোন দেন নি। শেষ যে মাসে পড়িয়েছিলাম, সে মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত পড়ালাম...আমিতো অর্ধেক মাসের টাকা হলেও পাই...ভেবেছিলাম আন্টি নিজে থেকেই ফোন করে ডেকে টাকাটা দিবেন, কিন্তু উনারতো কোন খবরই নাই। হাতও খালি ছিল, তাই নিজে থেকেই একদিন ফোন দিয়ে স্টুডেন্টের খবর নিলাম, যদিও টাকা পয়সার ব্যাপারে লজ্জার কারনে কোন কথা বলি নি...অবাক হয়ে দেখলাম ভদ্রমহিলাও কোন কথা বললেন না এ ব্যাপারে

। একদিন লজ্জার মাথা খেয়ে ফোন করে বলেই ফেললাম। উনি শুনে এমনভাব দেখালেন যেন তিনিও ভুলে গিয়েছিলেন, তাকে মনে করিয়ে দেয়ার জন্য আমাকে থ্যাংকস দিলেন আর বললেন বিকালে যেন বাসায় যাই। আমি খুশি মনে গেলাম সন্ধ্যার আগ দিয়ে

। নাস্তা খেতে দিলেন। কিছুক্ষন গল্প করলেন। এরপর একটু ভিতরে গিয়ে আবার এসে আমার হাতে কিছু(টাকা) ধরিয়ে দিলেন। এর আগেও উনি আমাকে এভাবেই বেতন দিতেন। আমি সেটার দিকে না তাকিয়েই পকেটে রেখে দিতাম। আমাকে গুনে নিতে বললেও আমি এই ব্যাপারগুলোতে বেশ লাজুক হওয়ায় কখনোই ওই কাজ করতাম না। তো সেদিনও পকেটে রেখে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। ভাবলাম অর্ধেক মাসের টাকা হলেও তো আমাকে ১৫০০ টাকা দেয়ার কথা। টাকা দেয়ার সময় যেহেতু উনি বলেছিলেন যে, উনার একটু সমস্যা ছিল তাহলে কম করে হলেও তো ১০০০ টাকা দিয়েছেন। রাস্তায় এসে সন্ধ্যার পর রাস্তার আলোতে পকেট থেকে বের করে দেখলাম সেখানে ১০০ টাকার ২টা নোট আর ৫০ টাকার ১টা নোট!!! মানে ২৫০ টাকা!!! আমি তো পুরাই হতভম্ব

...নিজেই প্রচন্ড লজ্জা পেলাম...যতদিন অন সার্ভিসে ছিলাম ততদিন পুরাই ভালো আর পড়ানো শেষ খাতিরও শেষ!!! যাই হোক আমি এই কাহিনী পড়ে আর কারো সাথে শেয়ার করার সাহস পাই নি। এমনকি এলাকার ওই বড় ভাইয়ের সাথেও না। আজকে লজ্জার মাথা খেয়ে বেশ সাহস করে আপনাদের সাথে শেয়ার করে ফেললাম!!!
পুনশ্চ: পুরো ঘটনাটিতেই আন্টির কথা এসেছে, আঙ্কেলের কথা না আসার কারন হলো তিনি চাকরি নিয়ে ব্যাস্ত থাকায় তার সাথে আমার খুব কমই দেখা হতো।