আগের পর্বের জন্য উপরে ক্লিক করুন
ফজরের আজান হয়ে গেল। মসজিদ কােথায় আছে তা জানা না থাকায় পেপার পিঁচের রাস্তায় বিছিয়ে বাংলাদেশ সিমান্তের একদম শেষ মাথায় ফজরের নামাজটা আদায় করে নিলাম। এ এক অন্য রকম অনুভূতি। যাই হােক, ইমিগ্রেশনের কাজ শুরু হতে এখনো অনেক সময় বাকি। ঐ সময়টা প্রিন্স স্যারের পরিবারের সবার সাথে আড্ডা দিতে দিতে পার করে দিলাম। ইমিগ্রেশনের কাজ অনেক ঝামেলা এই ভেবে প্রিন্স স্যার আমাকে বলল কােন পরিচিত দালাল আছে কি না? আমি আমার পরিচিত এক দালালকে ফােন দিলাম, কিন্তু এত সকালে সে ফোন ধরল না। কিছুক্ষন পর সে আমার ফােন দেখে কল ব্যাক করল। তখন আমি তাকে আসতে বলি।
প্রিন্স স্যারের পরিবারের সবার সাথে ইতিমধ্যে আমার আর বেয়াইয়ের খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে উঠল। দালাল চলে আসল সাড়ে পাঁচটার দিকেই। তার নাম জনি। আমি তাকে আঙ্কেল ডাকি, বললাম ”আঙ্কেল আমরা মােট সাত জন। তিন জনের ইন্ডিয়ান পাসপোর্ট আর চার জনের বাংলাদেশী পাসপোর্ট”। প্রিন্স স্যারের ছেলে স্টিফেনও (৪-৫) ইন্ডিয়ান পাসপোর্টধারী, কিন্তু বয়স কম থাকায় ওর ট্রাভেল ট্যাক্স লাগবে না। ইমিগ্রেশনের কার্যক্রম আস্তে আস্তে শুরু হতে লাগল। জনি আমাদের পাসপোর্ট নিয়ে চলে গেলেন ট্রাভেল ট্যাক্স আর ইমিগ্রেশন সিল মারার জন্য।
প্রিন্স স্যারের ছেলে স্টিফেন খুবই চঞ্চল, ওকে এক জায়গায় ধরে রাখা খুব কঠিন। অন্যান্য মানুষজন টার্মিনালে ঢুকতে শুরু করে। কিন্তু আমেদের দেড়ি হচ্ছে। আমি জনিকে ফােন দিয়ে দেড়ি হওয়ার কারন জানতে চাইলাম, বলল ”আর পাঁচ মিনিট লাগবে”। ইমিগ্রেশনের সব কাজ শেষ করে জনিকে সাত জনের জন্য সাতশত টাকা দিলাম, কিন্তু সে বলল ”রেট বেড়ে গেছে, প্রতিজন দুই শত করে লাগবে বড় বড় স্যারদের খরচ নাকি বেড়ে গেছে!!”। কিভাবে ব্যাপারটা প্রিন্স স্যারকে বলি ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু স্যারকে বলার সাথে সাথে স্যার টাকা বের করে দিল, বলল ”নো প্রবলেম”। আমরা আমাদের ব্যাগ পত্র নিলাম। টর্মিনালে ঢুকতে আবার টার্মিনাল চার্জ দিতে হল চল্লিশ টাকা। দ্রুত ইমিগ্রেশন পার হয়ে নাে ম্যান্স লেন্ডের আগে লাইনে দাড়িয়ে গেলাম। আমাদের সামনে আরো জনা পঞ্চাশেক লােক আছে।
একটু এগুতেই একজন ট্রাভেল ট্যাক্সের স্লিপ চেক করে ছিড়ে দিলন। আরেকটু সামনে ডানপাশে দুই জন পুলিশ শেষবারের মত পাসপোর্ট চেক করলেন। আমার বেয়াই যেহেতু প্রথমবার যাচ্ছেন তাই তার কাছ থেকে ফুলিশ মামুরা একশত টাকা বকশিস চাইলনে। বেয়ই দিয়ে দিলেন। বললেন, আর প্রিন্স স্যারের ছেলের ট্রাভেল ট্যাক্স লাগবে না এই মর্মে একটা লিখিত চাইলেন। জনি আঙ্কেল আর প্রিন্স স্যার স্টিফেনকে নিয়ে গেলেন লিখিত আনতে আর আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে বললেন। আমরা নাে ম্যান্স ল্যান্ডে আবার লাইনে দাড়ালাম, ইতিমধ্যে বাকিরাও চলে আসল। পাসপোর্ট ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশনের লােকেরা চেক করে আমদের হাতে বাের্ডিং পাসের একটা ছােট কাগজ ধরিয়ে দিলেন। ইন্ডিয়ান কাস্টমসের আগে অবার লাইনে। লাইনে দাড়িয়ে থেকেই সবার বাের্ডিং পাস লিখে দিলাম। ইন্ডিয়ান কাস্টমসে আমার পাসপোর্ট চেক করে বলল ক্রেডিট কার্ড সাথে আছে (আমার এন্ড্রোসমেন্ট ক্রেডিট কার্ডে করা ছিল) কি না? আমি বললাম ”হ্যা”। আবার বলল রুপি আছে কি না? আমি ”না” বললাম,। বলল সামনে যান। শহিদুল বেয়াইকে বলল ডলার আছে কি না দেখান। শহিদুল বেয়াই ডলার দেখাল। কাস্টমস থেকে বের হয়ে বাঁশ দিয়ে বানানো গরুর খোয়ারে মত একটা রাস্তা দিয়ে চলে গেলাম ইন্ডয়ান ইমিগ্রেশনে। কােন ঝামেলা ছাড়াই ইমিগ্রেশন শেষ করে সবাই বের হলাম। আমি আর বেয়াই দুইজনে পাঁচশত টাকা করে ভাঙ্গিয়ে রুপি করে নিলাম। প্রিন্স স্যার বলল কলকাতা পর্যন্ত কিভাবে যাব? আমি বললাম ”এখান থেকে বনগাঁও রেলওয়ে স্টেশন আর ঐখান থেকে ট্রেনে শিয়ালদহ বা দমদম”। প্রিন্স স্যার বলল ”ঠিক আছে আপনারা যান আমরা দেখি কি করা যায়”। মেহেদী ভাইয়ের বেনাপোল আসতে দেড়ী হবে তাই তাকে ফােন দিয়ে বলে বলে দিলাম কলকাতায় দেখা করব। আমি আর আমার বেয়াই প্রিন্স স্যারের পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অটোতে উঠে গেলাম।
অটোতে উঠার পর যে রাস্তা দিয়ে বনগাঁও যায় সেই রোডের দুইপাশে বড় বড় গাছগুলো আমার ভালো লাগে। ভাবি এত বড় বড় গাছ কত শত বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে, নিশ্চই ইতিহাসের অনেক কিছুর সাক্ষী। বনগাঁও স্টেশনে পৌছাতে আটটা পনেরো বেজে গেল। গিয়ে দেখি একটা ট্রেন দাড়িয়ে আছে। দ্ইুজনের ত্রিশ রুপি করে অটো ভাড়া দিয়ে নেমে গেলাম। দ্রুত দুইটা টিকিট কেটে নিলাম শিয়ালদাহর। বেয়াইকে বললাম দৌড় দিতে। এক দৌড়ে ওভার ব্রিজ পার হয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম ”শিয়ালদাহ যাবে তাে?” ওনি বললেন ”না, রানাঘাট যবে। পাশে যে ট্রেনটা দাড়িয়ে আছে ঐটা শিয়ালদাহ যাবে উঠে পড়ুন”।
বেয়াই কিছুটা রাগ করেছেন, কারন এত জোড়ে দৌড়। নিজেকে একটু বোকা বোকা মনে হল। শিায়ালদাহগামী ট্রেনে উঠে জানালার পাশে দুইটা সিট নিয়ে বেয়াই আর আমি বসে গেলাম। হঠাৎ দেখি প্রিন্স স্যারও তার পরিবার নিয়ে আসছেন। স্যারকে ডেকে আমাদের পাশে খালি সিটে বসালাম। সাড়ে আটটার দিকে ট্রেনে ছাড়ল। পরের স্টেশনে বেশ কিছু লোক উঠল।
একজন লােক উপরে আমাদের ব্যাগ দেখে বলল ”এই ব্যাগুলো কে রেখেচে?”।
মনে মনে "রেখেচে আবার কি রে!!!" যাই হোক কন্ট্রোল করে বললাম ”আমরা”।
লােকটা বলল ”ব্যাগটা নামান, আমার ব্যাগ রাখব”।
আমরা বললাম ”কেন?” মনে মনে বললাম ”মনে হয় তাের বাপের ট্রেন”।
লােকটা বলল ”আপনাদের ব্যাগ (পিঠের ব্যাগ) অনেক বড়, আপনাদেরটা নামান তাহলে অনেক জায়গা হবে”
আমি বললাম ”তাহলে আমাদের টা কােথায় রাখবো?”
এইটা বলার পর ঐ লােকটা নিজেই আমাদের ব্যাগগুলো সাজিয়ে নিজেরটা রেখে দিল।
আরেকজন এসে বলে ”দাদা চাপুন তাে বসবো”।
আমি বললাম ”কোথায় বসবেন? তিন জনের সিট পাঁচজন কিভাবে বসবেন?”
লোকটা বলল ”আপনাকে চেপে বসতেই হবে, বাচ্চাটা কােলে নিন (প্রিন্স স্যারের ছেলে মেয়ের কথা বলছে)”। কােন মতে স্টিফেনকে বেয়াই কােলে নিয়ে বসলেন, বৃষ্টি সিটেই বসা ছিল। সময় গড়ায় আর লােক এত পরিমানে বাড়তে থাকে যে আমাদের সামনে এসে জানালা বন্ধ করে লােকগুলো দাড়াতে শুরু করল। একে তো গরম আবার জনালা বন্ধ করে দাড়িয়ে আছে, সে এক অসহ্য অবস্থা যা বলে বুঝানো যাবে না। বিপত্তি ঘটলা আরেক জায়গায়, প্রিন্স স্যারের বড় লাগেজটা দরজা দিয়ে ঢুকার ঠিক সামনেই রাখা আছে ঐটা ভিতরে আনা হয় নি। ট্রেনের ভিতরে এখন এত লােক যে ঐটা ভিতরে আনার কােন জাে নেই, আর খােয়া যাওয়ার খুব সম্ভবনা আছে। তাই ঐ লাগেজের দিকে সবসময় খেয়াল রাখতে হচ্ছিল। তবুও কিছু ভলো লােক বলছিল আপনাদের চিন্তা নেই আপনার মালের কোন টেনশন নেই। আমাদের সামনের লােকটা বলছিল ”সমস্যা নেই উনি আমার পরিচিত।” তখন একটু নিশ্চিন্ত হলাম। প্রচন্ড গরম লাগছিল, আর এই ভিড়ের মধ্যেও হকাররা কান ঝালাপালা করে দিচ্ছিল। এর আগেও কয়েকবার বঁনগা লােকালে চড়েছি, কিন্তু এত খারাপ অবস্থায় পড়তে হয়নি। বেয়াইয়ের দিকে লজ্জায় তাকাতে পারছিলাম না। বুঝলাম ওনিও আমাকে কিছু বলতে পারছেন না।
একজনকে জিজ্ঞেস করলাম ”এত ভিড় কেন?”
উনি বললেন ”অফিস টাইম”। বুঝলাম আমাদের টাইমিং খারাপ।
জিজ্ঞেস করলাম ”আপনারা কি সবাই দৈনিক একই কামরায় উঠেন?”
উনি বললেন ”হ্যা”।
তখন বুঝলাম এই জন্যেই তাদের মধ্যে এত সখ্যতা। অনেকে আমাদের কটুক্তি করছিল। এত ভিড়ের মধ্যেও দেখলাম কিছু লােক দাড়িয়ে দাড়িয়ে তাস খেলছে। মনে মনে ভাবলাম এত ভিড়ের মধ্যে এই লােকগুলো প্রতিদিন এত কষ্ট করে এতদূরে গিয়ে অফিস করে। সেই তুলনায় আমরা অনেক ভালো আছি। অন্তত এতটা কষ্ট করতে হয় না। বারাসাত পার হবার পরেই দাড়ানো সবাই বলছিল ”এখন আপনারা দাড়ান আমরা বসবো।” আমি বললাম ”আপনাদের দেশে মেহমানদেরও দাড়াতে হয়?” সে বলল "হ্যা"। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা ওঠবো না। ভীড়ের মধ্য হতে কেউ একজন বলল "উঠবে না মানে কি রে! ওকে উঠা"। মনে মনে ভাবছি "বেটা যদি সীমান্তের ওপার হত আগে তোর নাকটা ফাটাতাম। এই সেই তর্কাতর্কি করতে করতে দেখি প্রিন্স স্যার দাড়িয়ে গেছেন। কি আর করা, তাই আমিও দাড়িয়ে গেলাম। বেয়াই প্রিন্স স্যারের ঘুমন্ত ছেলেকে নিয়ে বসে আছেন। বেচারা এতটাই কষ্টে আছেন যে নড়াচড়া করতে পারছিলেন না। কিন্তু সবাই সময়রে কাছে অসহায়। দমদম পৌছাতে আরে পনেরো মিনিট লাগবে। সিদ্ধান্ত নিলাম দমদম নেমে যাব, তারপর মেট্রোতে নিউ মর্কেট। অনেক কষ্ট করে এত ভিড়ের মধ্যে দমদম নেমে গেলাম।
বেয়াই মোটামুটি ভালোই রাগ করেছেন (আমি ভুলও হতে পারি)। বললাম এখন মেট্রোতে যাব সমস্যা নাই। কিন্তু বেয়াইয়ের মন মানে না, বললেন" চলনে গাড়িতে বা ট্যাক্সেতে করে চলে যাই। আমি তাকে আস্বস্ত করলাম এইবার কোন সমস্যা হবে না। এসপ্লানেডের টিকিট কাটলাম দশ রুপি প্রতিজন। কিন্তু পিন্স স্যারের বড় ব্যাগ নিয়ে মেট্রোতে যেতে দিল না পুলিশ। তাই সবার কাছ থেকে শেষবারের মত বিদায় নিয়ে আমি আর বেয়াই মেট্রোর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। দুই মিনিট পরে মেট্রো আসলো। মেট্রোতে উঠে বেয়াই মােটামুটি খুশি (যদিও সিট পাইনি) কারন গরম ছিল না, গতিও ভালে ছিল।
দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে এসপ্লানেড পৌছে গেলাম। মেট্রো থেকে নেমে হেটে মারকুইস স্ট্রিটে গেলাম। আমাদের ব্যাগ পরিচিত এক দােকানে রেখে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিলাম যেমন- ডলার এবং টাকা ভাঙ্গানো, অল ইন্ডিয়া সিম কেনা, টুকটাক মার্কেটিং ইত্যাদি। বেয়াই লাঞ্চ করে নিলেন (আমি রােজা ছিলাম তাই করিনি)। তারপর খুব বৃষ্টি শুরু হল, মনে হল বৃষ্টি আমাদের কলকাতাতে স্বাগত জানাল। নিউ মার্কেট এরিয়ায় বৃষ্টির সময়টাতে অপেক্ষা করলাম। মেহেদী ভাইয়ের সাথে যােগাযোগ করতে পারছিলাম না তাই ফেসবুকে নতুন নাম্বারটা মেসেজ করে দিলাম। বৃষ্টি থামার পর বাসে করে সােজা চলে গেলাম হাওড়া রেল স্টেশনে। যেখান থেকে আমাদের সাতটা চল্লিশ মিনিটে ট্রেনে ছাড়বে কালকার উদ্দেশ্যে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৩:৪৪