প্রথম পর্বের লিঙ্কঃ Click This Link
২য় পর্বের লিঙ্কঃ Click This Link
৩য় পর্বের লিঙ্কঃ Click This Link
৫ম দিনঃ
খুব ভোরে অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙ্গল, ফ্রেশ হয়ে ফজরের নামাজ পরে আমরা তিনজন (হালিম ভাই, রেজাউল ভাই আর আমি) স্কুটার নিয়ে বেরিয়ে পরলাম গতকালের পরিতৃপ্তি না পাওয়া ক্যান্ডলিম বিচ দেখার জন্য, বাকি তিনজন ঘুমে। জিপিএসে গন্তব্য ঠিক করে ঘুমন্ত এক শহরের মধ্য দিয়ে চলতে শুরু করলাম। রাস্তায় কোন মানুষ নেই বললেই চলে, ১০ মিনিটের মধ্যেই ক্যান্ডলিম বিচে পৌঁছে গেলাম। আমাদের আগেই বিচে কয়েকজন এসে নির্জনতার মজা নিচ্ছে, ২-১ জন তাদের পোষা কুকুরের সাথে বিচে হাটতে বেরিয়েছেন। আজ বিচটা গতকালের থেকেও বেশি সুন্দর লাগছে। গতকাল মানুষের কোলাহলে পরিপূর্ণ থাকা বিচটা এখন একবারেই স্তব্ধ, নিরব। আকাশটা আজও একটু মেঘলা, সেই সাথে সমুদ্রের বিশাল ঢেউ, শুভ্র ফেনা যে কারো মন চাঙ্গা করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। খালি পায়ে পানিতে পা ভিজানোর লোভ সামলাতে পারলাম না, এমন অনুভূতি যারা হোটেলে ঘুমিয়ে ছিল তাদের বুঝানো যাবে না। দেড় ঘণ্টা কিভাবে পার হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। এবার হোটেলে ফেরার পালা, হালিম ভাই বললেন যেহেতু আজ শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়তে হবে চল এখানে মসজিদ কোথায় আছে দেখে যাই। জিপিএসে গন্তব্য কাছের মসজিদে ঠিক করে শহর থেকে প্রায় ১৫ মিনিট দূরে মসজিদ চিনে হোটেলে ফিরে আসলাম।
বাকিরা মাত্র ঘুম থেকে উঠলো, আর আমরা সকালে এক অপার্থিব সৌন্দর্য দেখে এলাম যা ঘুরতে এসে ঘুমিয়ে থাকলে কখনোই উপভোগ করা সম্ভভ না। সবাই গোসল শেষে, রেডি হয়ে স্কুটার নিয়ে বেরিয়ে পরলাম, আলী ভাইয়ের (হোটেল ম্যানেজার) পরামর্শ মত পানাজি যাব আর বিকালে ক্রুজ সাফাইর তে যাবো। স্কুটারের প্রয়োজনীয় জ্বালানী নিয়ে জিপিএস অন করে চলতে শুরু করালাম। কাল কোকো বিচে যাওয়ার জন্য যে হাইওয়ে দিয়ে গিয়েছিলাম সেই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলাম, সামনে একটা পুলিশ চেক পোস্ট দেখে কালকের কথা মনে পড়ে গেল। আজকেও যদি ধরে তাহলে টাকা দেওয়া ছাড়া উপায় নাই, কিন্তু তারা আমাদের থামাল না। আজ লিটন আর রাসেল মাথায় গামছা আর লুঙ্গি পড়ে বের হয়েছে, ১০০% বাংলাদেশী।
যেহেতু কাল আমরা ফিরে যাব, হালিম ভাই আর আমি মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম সাউথ গোয়াতে কোলভা বিচে যাবো। রাস্তায় কিছু অতিরিক্ত জ্বালানী নিয়ে আবার চলতে থাকলাম, বাকিরা তখনও আমাদের প্লানের কিছুই জানে না। ওরা শুধু আমাদের ফলো করতো, কখনো জিজ্ঞাসও করেনি কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি। ছুটে চলছি পানভেল-কচি-কন্যাকুমারী হাইওয়ে ধরে, রাস্তায় বহু কিলোমিটার ধরে একটা ফ্লাইওভারের কাজ চলছিল। রাস্তার দুপাশে আপনি সুউচ্চু কোন বিল্ডিং দেখবেন না, একেবারে নিখাদ প্রকৃতি। সবকিছু ঠিকই চলছিল, কিন্তু জুয়াড়ি ব্রিজ প্রায় পাড় হয়ে গিয়েছিলাম ঠিক তখন একজন পুলিশ আমাকে সিগন্যাল দিতে দিতে রাস্তার মাঝখানে চলে আসছিল। আমার সামনে একটা প্রাইভেট কার থাকাতে আমি আরও ডানদিকে চলে যাই। পুলিশকে ক্রস করে একটু দোটানায় পড়ে হালকা ব্রেক করি, কিন্তু কি মনে করে আবার চালাতে শুরু করি তখন সে সজোরে বাশি বাজাতে থাকে। আমি একটু ভয় নিয়েই সামনে চলে যাই, যদি সামনে কোন পুলিশকে সে আবার ফোন করে দেয় সেই ভয়। একটু পর রাকিব ফোন দেয় যে ওদের পুলিশ ধরছে। আমরা আরও প্রায় ২ কিমি পরে রাস্তার পাশে থেমে একটা দোকানে সকালের নাস্তা করতে করতে তাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। প্রায় আধা ঘণ্টা পর তারা ওখান থেকে ৫০০ রুপি জরিমানা দিয়ে আমাদের কাছে পৌছায়।
হালকা নাস্তা শেষে আবার চলতে থাকি, ৩০ মিনিটের মদ্ধে আমরা কোলভা বিচে পৌঁছে যাই। বিচে যাওয়ার একটু আগেই সিদ্ধান্ত হয় জুম্মার নামাজের সময় হয়ে গেছে কাছে কোন মসজিদে গিয়ে আগে নামাজ পড়ে তারপর বিচে যাবো। যেই সিদ্ধান্ত সেই কাজ, প্রায় ৩ কিমি দূরে একটা মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করলাম। গোয়াতে মসজিদ কম বলে অনেকেই দূরদূরান্ত থেকে বাইক, স্কুটার, গাড়িতে করে এসে জুম্মার নামাজ আদায় করে। নামাজ শেষে কোলভা বিচে চলে আসি। বিচটা আসলেই অনেক সুন্দর, গত দুইদিনের মদ্ধে শুধু এই বিচেই মানুষকে দেখলাম গোসল করছে। যদিও এখন অফ সিজন চলছিল তারপরেও সাউথ গোয়া আমার কাছে নর্থ গোয়া থেকে কম জাঁকজমকপূর্ণ মনে হয়েছে।
গোয়ার বিচগুলোতে একটা ব্যাপার খুবই কমন, সব বিচে জরুরী উদ্ধারকারী দল সবসময় আধুনিক সরঞ্জামাদি নিয়ে সবসময়ই প্রস্তুত থাকে। আইসক্রিম খেতে খেতে বিচে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে দুপুরের খাবারের সন্ধান করতে লাগলাম। একটা বাঙ্গালি হোটেলে ঢুকে বাঙ্গালি খাবার অর্ডার করলাম। খেয়েদেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে আবার যাত্রা শুরু করলাম নর্থ গোয়ার দিকে। এবার গন্তব্য ক্রুজ সাফারি করবো, তাই ৩ টার আগে আমাদের পাঞ্জিম ফেরী ঘাটে পৌছাতে হবে। কিন্তু আসার সময় যেভাবে পুলিশ চেকপোস্ট দেখলাম এখন ফেরার সময় আবার কি সমস্যা করে আল্লাহ্ ভাল জানে। সবাই জিপিএস দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা শহরের ভিতরের একটা রাস্তা ধরে জুয়াড়ি ব্রিজের আগে (এবার যাওয়ার সময়) যে চেকপোস্টটা আছে ঐটা ফাকি দিব।
ইতিমধ্যে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল, মনে সবাই একটু সাহস পাচ্ছিল যে এই বৃষ্টিতে চেক পোস্টের পুলিশ হয়ত বাইরে বের হবে না। তাই বৃষ্টিতে ভিজেই হাইওয়ে ধরে চলছিলাম। কিন্তু কি কপাল, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত হয়। চেকপোস্টের আগে ছোট একটা জ্যাম এবং পুলিশ ব্যারিকেড দেওয়াতে স্কুটার আস্তে আস্তে চালাতে হল। দেশে আমার বন্ধু মাসুদের একটা নিয়ম ফলো করার চেষ্টা করছিলাম, যে ডান দিকে থাকতে হবে। ইতিমধ্যে আমাদের সামনে রেজাউল ভাইকে আবার পুলিশ সিগন্যাল দিয়ে থামাল, এই সুযোগে আমরা বের হয়ে চলে আসলাম। কিন্তু ব্রিজে উঠার ঠিক আগেই আবার সেই পুলিশ রাস্তা পার হয়ে আমারা যে সাইড দিয়ে যাচ্ছিলাম সেই পাশে চলে আসলো। আমি ভাবলাম আমাকে মনে হয় চিনে ফেলেছে আগেরবার সিগন্যাল ভাংছি। কিন্তু সে আমাকে আর রাসেলদের সিগন্যাল দিল না।
ব্রিজের পরে স্কুটার থামিয়ে রাকিবদের জন্য অপেক্ষো করতে লাগলাম, হালিম ভাই বললেন এমন জায়গায় থামাইলা পুলিশের কাছ থেকে বাইচা আবার থানার সামনে। আর একটু সামনে গিয়ে একটা ছোট দোকানের সামনে বসে তাদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। ওরা চলে আসলে জানতে পারলাম এবার ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে ধরে নাই, এবার গাড়ির কাগজ নিয়ে ধরছিল, ফলস্বরূপ ঘুষ ২০০ রুপি।
কিছুদূর যাওয়ার পর লুকিং গ্লাসে খেয়াল করলাম লিটনদের দেখা যাচ্ছে না, হাইওয়ের পাশে থামিয়ে অপেক্ষা করলাম। ওরা ৪-৫ মিনিট পরে আসলে জানলাম ওরা নাকি ভুলে অন্য একটা স্কুটার নিয়ে চলে এসেছিল। তারাহুরায় চাবি দিয়ে অন্য স্কুটারে কিক মারার পরেই ঐটা চালু হয়ে গিয়েছিল। আধা কিলোমিটার আসার পরে খেয়াল করেছে যে আগের স্কুটারে পিছনে পা'দানি ছিল এইটাতে নেই । পরে গিয়ে আবার ফেরত দিয়ে এসেছে।
মান্ধভি ব্রিজের পর একটা ট্রাফিক সিগন্যাল আছে। ট্রাফিক পুলিশ আমাকে সিগন্যাল দিল অন্য পাশে গাড়ি ছাড়বে, আমি ভাবলাম আবার মনে হয় জরিমানা নিবে তাই আর দিকবিদিক না দেখে দিলাম বাম দিকে চালিয়ে, শুধু একবার যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে জানতাম যে বামদিকেই আমাদের যেতে হবে। আমাকে দেখে রাসেলও ছুজ সোজা, কিন্তু এবারও সেই রাকিবদের ধরা পরার পালা। তারা অর্ধেক পার হয়েও পুলিশের চোখ রাঙ্গানিতে ফিরে আসলো। এখন সবাই আলাদা হয়ে গিয়েছি। আমি আর হালিম ভাই ফেরী ঘাটে গিয়ে ক্রুজের টিকেট কেটে ক্রুজে উথে পড়ি। রাসেলদের সাথে কোন যোগাযোগ করে উঠতে না পারি নাই। রাকিব ফোন দিয়ে জানালো এইবার হিন্দি-ইংলিশ কিছু বুঝি না এই নাটক করে ২০০ রুপি জরিমানা দিয়ে পার পেয়েছি। পরে ওরা আমাদের কথামত ফেরী ঘাটে চলে আসে।
ঠিক ৩ টায় ক্রুজ ছাড়ল, আমরা ক্রুজের ডেকে আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যা হওয়া পর্যন্ত প্রকৃতি উপভোগ করতে লাগলাম। ক্রুজ মাঝ নদী থেকে ফিরে আসার সময় নিচে চলে আসলাম আর বাকি সময়টা ক্রুজের নিচে ডিজে গানের সাথে যে যেভাবে পারে সেভাবে নাচছিল তা উপভোগ করলাম। ৬ টার সময় ক্রুজ থেকে নেমে সরাসরি আমাদের হোটেলে চলে আসলাম। ফ্রেশ হয়ে লিটন আর রাসেলকে একত্রিত করে আলী ভাইয়ের কথামত একটা রেস্টুরেন্ট কাম বারে গিয়ে ডিনার সেরে আবার হোটেলে ফিরে আসলাম। বাকি সময়টা গভীর রাত পর্যন্ত বিচে বসে কাটিয়ে দিয়েছিলাম। সাগরের গর্জন আর মৃদু হাওয়ায় সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে গিয়েছিল।
৫ম দিনের খরচঃ
স্কুটার ভাড়া- ১৫০ রুপি (জনপ্রতি)
সকালের হালকা নাস্তা- ১৭ রুপি (জনপ্রতি)
দুপুরের খাবার- ১৬০ রুপি (জনপ্রতি)
জরিমানা- ১৫০ রুপি (জনপ্রতি)
ডিনার- ১৬০ রুপি (পানি সহ জনপ্রতি)
মোট- ৬৩৭ রুপি জনপ্রতি
আগের ৪ দিনের খরচঃ ২২৪২ রুপি এবং ৮৯৫ টাকা
৫ দিনের মোট খরচঃ ২৮৭৯ রুপি এবং ৮৯৫ টাকা
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৯ দুপুর ১:০০