৪র্থ পর্বের লিঙ্কঃ Click This Link
গোয়াতে আজ ৪র্থ এবং শেষ দিন, ফজরের নামাজ শেষ করেই তিনজন বেরিয়ে পড়ি শেষবারের মত সকালের স্নিগ্ধতা অনুভবের জন্য। আজ দুপুরে আমাদের ফিরতি ট্রেনের টিকেট করা পুনের উদ্দেশে, তাই বেশি দূরে না গিয়ে শুধুমাত্র হোটেলের সামনের বিচের অংশেই ঘুরে বেড়ালাম। সময় খুব দ্রুত শেষ হয়ে গেলো, আসলে সবমিলিয়ে ২ দিন গোয়ার সৌন্দর্য উপভোগের জন্য কোনভাবেই যথেষ্ট না। একটু পরেই বেরিয়ে পড়তে হবে তাই হোটেলে ফিরে বাকি ৩ জনকে জাগিয়ে নিজেরা গুছিয়ে হোটেলের সামনে একত্রিত হলাম। হোটেল ম্যানেজার আলী ভাইয়ের কাছে স্কুটারের চাবি ফিরিয়ে দিয়ে সব বিল মিটিয়ে পায়ে হেটে ৫ মিনিটেই মহাসড়কে চলে আসলাম।
কোন ট্যাক্সি বা জীপ না পাওয়াতে একটা লোকাল বাসে উঠে পরলাম পাঞ্জিম বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশে ভাড়া ২০ রুপি। গোয়া শহরটা এতটাই মনোমুগ্ধকর যে, কিছু কিছু জায়গায় সারাদিন বসে থাকলেও আপনার বিরক্ত লাগবে না। গত ৩ দিনের স্মৃতিচারণ করতে করতে ২০-২৫ মিনিটের মধ্যেই পাঞ্জিম বাস স্ট্যান্ড চলে আসলাম। বাস টার্মিনালটা ছোট হলেও যাত্রীদের জন্য সব ধরনের সুযোগ সুবিধা বিদ্যমান। ভাস্কো-দা-গামা যাওয়ার বাসের টিকেট কাটার আগে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম ভেজিটেবল বার্গার দিয়ে সাথে কিনে ট্রেনে খাওয়ার জন্য কিনে নিলাম বিশেষভাবে প্যাকেটজাত করা আটার মিষ্টি রুটি, সবার খরচ ২৫০ রুপি। লাইনে দাড়িয়ে বাসের টিকেট কিনে নিলাম জনপ্রতি ৪০ টাকা (মনে হয়)।
প্রায় এক ঘণ্টা বাস জার্নি শেষে যখন ভাস্কো-দা-গামা নামলাম ট্রেন ছাড়তে তখনো প্রায় ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট বাকি। আমাদের ব্যাগগুলো স্টেশনের ক্লোয়াক রুমে রেখে বেরিয়ে পড়লাম দুপুরের খাবার খাওয়ার উদ্দেশে। মদিনা মসজিদের নিচে একটা মুসলিম হোটেল থেকে দম বিরিয়ানি খেয়ে জোহরেরে নামাজ পড়ে স্টেশনে ফেরার পথে কিছু ফল কিনে নিলাম। লাঞ্চ এবং ফল ৪৬০+৪০০ রুপি।
স্টেশনে যেতেই দেখি আমাদের পুনে যাওয়ার ট্রেন গোয়া এক্সপ্রেস প্লাটফর্মে দাড়িয়ে আছে। ক্লোয়াক রুম থেকে মালামাল নিয়ে আমাদের নির্ধারিত বগি S7 এ উঠে পরি। রাসেল আর রাকিবের টিকেট আলাদা কাটাতে ওদের সিট একই বগিতে একটু দূরে পড়েছে। ঠিক দুপুর ০৩:১০ মিনিটে ট্রেন ছেড়ে দিল। আমারা ৪ জন যেখানে আছি সেখানে একজন বৃদ্ধ পুরুষ এবং একজন মহিলা আছেন। তাদের সাথে পরিচয় হয়ে নিলাম, পুরুষ লোকটার নাম শারদ জোশী। উনি অবসর কাটাতে পুনে এবং মুম্বাই যাচ্ছেন বন্ধুদের কাছে, আর মহিলাটি উনার সন্তান সম্ভাবা মেয়েকে দেখতে মুম্বাই যাচ্ছেন।
ট্রেনে হকারদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে, পেট ভরপুর থাকা সত্ত্বেও এক হকারের কাছ থেকে মিরচি পাও খাওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। রাজু ভাইইয়ের কাছে এই খাবারটার খুব প্রশংসা শুনেছি। বন রুটির সাথে আস্ত একটা কাঁচা মরিচ চপের মত ভাঁজা। এই খাবারটা মনে শুধু হয় এইদিকেই পাওয়া যায়, আমি ভুলও হতে পারি। বিরিয়ানি খাবার পর মিরচি পাও অবশ্য খুব একটা মজা নিয়ে খেতে পারলাম না।
এখন পালা শেষবারের মত দুধ সাগর ফলস দেখার। যে যার মত জানালার পাশে বা দরজায় গিয়ে দাড়িয়ে রইলাম দুধ সাগর ফলস দেখতে। যদি আবার আসা হয় তবে অবশ্যই ক্যাসেল রক বা কুলেম থেকে হেটে গিয়ে হলেও দুধ সাগর ফলস দেখে আসব। বিশাল আকারের এই ঝর্ণা কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখের সামনে এসেছিল, আর মনের আফসোসটা যেন অনেক গুন বেড়ে গেল। আবার গোয়া আসতে হবে ফুল টুরিস্ট মৌসুমে। ক্যাসেল রক স্টেশন পর্যন্ত বাকি রাস্তাটা ঘন জঙ্গল আর পাহারের সাড়ি দেখতে দেখতে খুব দ্রুত শেষ হয়ে গেল।
এখন পালা আমাদের সহযাত্রী শারদ জোশী আঙ্কেলের সাথে কথা বলার। লোকটা একসময় এয়ার ইন্ডিয়াতে চাকুরি করতেন এখন অবসর নিয়েছেন, গোয়াতেই গড়েছেন নিজের জীবনের বাকি সময় কাটানোর জন্য স্থায়ী নিবাস, মুম্বাইয়ে আত্মীয় আছে তাদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন। আসরের নামাজের পর প্রায় আধা ঘণ্টা কথা বলার পর উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি হিন্দি বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি নাকি ইংরেজি? আমি বললাম ইংরেজিতেই ভাল হয়। উনি আমাকে উপমহাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক কিছু বললেন, আমি ইতিহাসের সবচাইতে কাঁচা ছাত্র আর সবচাইতে অপছন্দের বিষয় হওয়া সত্ত্বেও উনার কাছে শুনতে অনেক ভাল লাগছিল। উনি ভাষার ছাত্র ছিলেন বলে সংস্কৃত ভাষা সম্মন্ধেও অনেক কথা বললেন। বাংলাদেশ সম্বন্ধেও ভাল ধারনা রাখেন লোকটা, উনার এক বন্ধুর আমন্ত্রণে ঢাকা আসার কথা ছিল কিন্তু ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পরে উনার বন্ধুর সাথে আর নাকি যোগাযোগ হয় নি। কথা চলল মাগরিবের নামাজের পরেও, আমাদের সাথে আনা ফল, হকারদের কাছ থেকে নেয়া চানাচুর ভাজা দিয়ে উনাকে এবং পাশের মহিলাকেও আপ্যায়ন করলাম।
পাশের মহিলার সাথেও অনেক কথা হল, মহিলা পাঞ্জিমের অধিবাসী। মুসলিমদের প্রতি উনার বিশেষ ভালোবাসা কাজ করে, কারন উনি নিঃসন্তান থাকা অবস্থায় পাঞ্জিমের এক মুসলিম হুজুর/পীরের কাছে যাওয়াতে নাকি উনার সন্তান হয়েছে (একান্তই উনার মনের বিশ্বাস)। সেই সুবাধে উনার ছেলেদের মুসলিম নাম রেখেছেন। আমাদের ব্যাবহারে উনি এতটাই মুগ্ধ যে উনার মোবাইল নাম্বার দিয়ে বললেন আবার গোয়া আসলে যতদিন থাকবে আমার বাড়িতেই থাকবে বেটা। যদিও আসার পর আর ফোন দেয়া হয়নি।
রাতে আর খাওয়া দাওয়া করা লাগে নাই কারোরই। ট্রেন পুনে পৌঁছাবে রাত ০৩:৫৫ তে তাই এশার নামাজ পড়ে ঘুম দিলাম।
৬ শঠও দিনের খরচঃ
বাস ভাড়া- ৬০ রুপি (জনপ্রতি)
সকালের হালকা নাস্তা- ৪২ রুপি (জনপ্রতি)
দুপুরের খাবার- ৮০ রুপি (জনপ্রতি)
ফল- ৬৭ রুপি
মিরচি পাও- ১০ রুপি
চানাচুর- ৫ রুপি (জনপ্রতি)
মোট- ২৬৪ রুপি জনপ্রতি
আগের ৫ দিনের খরচঃ ২৮৭৯ রুপি এবং ৮৯৫ টাকা
৬ দিনের মোট খরচঃ ৩১৪৩ রুপি এবং ৮৯৫ টাকা
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১৯ দুপুর ১২:৪৭