টানা ১৩ দিন ভারত ভ্রমণ করেও এবার হোম সিকনেস পেয়ে বসে নাই; যা ঠিক ১৩তম দিন থেকেই গত কাশ্মীর-সিমলা-মানালি ট্যুরে হয়েছিল। আজ গোয়া’র শেষ দিন; রাতের বাসে রওনা হয়ে যেতে হবে মুম্বাই এর উদ্দেশ্যে। ট্যুর প্রায় শেষের দিকে; ভাবতে বরং একটু খারাপই লাগছিল। আবার কবে আসা হবে কে জানে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে লাগেজ গোছানো শুরু করে দিলাম প্রথমেই; গতকাল রাতে আলসেমিতে যা করে রাখা হয় নাই। তেমন তাড়া ছিল না। লাগেজ গুছিয়ে হোটেলের রেস্টুরেন্টে চলে গেলাম সকালের নাস্তা করে নিতে। আজ কফিটুকুও পাণ করার সময় পেলাম না, নয়টায় গাড়ী ছেড়ে দিল। আজকের গন্তব্য সাউথ গোয়া।
প্রথমেই দেখা হল ফিশ একুরিয়াম এবং এর লাগোয়া হরর শো; ফিশ একুরিয়াম নিয়ে গত পর্বে লিখেছি; আর হরর শো ছিল এক্কেবারেই চাইল্ডিস এন্টারটেইনমেন্ট, যা দেখে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে আমি বের হয়েছি এখান থেকে। বের হয়ে বাইরে দাঁড়াতেই কে যেন আমার মাথা এবং ঘাড়ে পানি ফেলছে বুঝতে পেরে ঘুরে তাকাতেই দেখি এক্সিট গেটের উপরে একটি খেলনা বাচ্চা পুতুল; সে আমার মাথায় হিসু করছে । একটু আগের বিরক্তি কেটে গেল এই ফাজলামো আয়োজনে। যাই হোক, এখান থেকে আমাদের নিয়ে টুরিস্ট কারটি রওনা হল কোলভা সী বিচ এর উদ্দেশ্যে।
বাবার কাঁধে বসা দুষ্ট ছেলে এই সেই হিসুকারী শিশুঃ
শিশুতোষ হরর শো এর কিছু অপচেষ্টা'র ছবিঃ
প্রায় আড়াই কিলোমিটার লম্বা সাদাবালি’র সমুদ্র সৈকত এই কোলভা যার তীর ঘেঁষে সারি সারি নারিকেল গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে। গোয়ার অন্যান্য বীচের মতই এখানে হোটেল, গেস্ট হাউজ, বার, রেস্টুরেন্ট, স্যুভেনিউর এর দোকান দেখতে পেলাম। গোয়ার প্রধান পাঁচটি সী-বিচ এর অন্যতম এই কোলভা। এখানে লাইফগার্ডদের তত্ত্বাবধানে সৈকতে পর্যটকদের জন্য স্থান নির্ধারন করে দেয়া হয়, যেখানে পর্যটকেরা নিরাপদে সৈকতের আনন্দ নিতে পারবেন। প্রায় সারা বছরই কোলভা বীচ পর্যটকে মুখরিত থাকে, বিশেষ করে শীতকালে একেবারে ‘ঈদের মৌসুমে আমাদের কক্সবাজার’র মত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কিন্তু বিদেশী পর্যটকেরা এই অতিরিক্ত ভীড়ের কারনে এই সৈকত এড়িয়ে যায়, বিশেষ করে ইউরোপিয়ান আর আমেরিকান পর্যটকেরা।
এখান হতে আমরা গেলাম ওল্ড পূর্তগীজ হাউস দেখতে। এটি আগে থেকেই পর্যটকদের দ্রষ্টব্য ছিল, তবে আরও বেশী আলোচনায় আসে ভারতীয় বলিউড মুভি “সিংগাম” এর শুটিং এখানে হওয়ার পর। সেই মুভিতে এটি নায়ক অজয় দেবগন এর বাসা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছল। এখানে সাজানো রয়েছে পূর্তগীজদের ব্যবহৃত নানান আসবাবপত্র এবং তৈজসপত্র। প্রচুর ছবি তোলা হল এখানে। পুরো বাসা ঘুরে ঘুরে শতবছর আগের আসবাবপত্র এবং দৈনিন্দন ব্যবহার্য তৈজসপত্র দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল আমি সেই সময়টায় চলে এসেছি। এই বাসার মিউজিয়াম নিয়ে আগামী পর্বে একটি লেখা লেখার ইচ্ছে আছে, মূলত ছবিব্লগ হিসেবে। দেখা যাক, কি হয়।
গোয়ার আপনি যেখানেই যাবেন, আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে সেই পূর্তগীজ আমলে। পূর্তগীজদের ছাপ মিশে আছে গোয়ার পথে পথে, পরতে পরতে। গোয়া নানান সময়ে অন্যদের হাতে চলে গেলেও এর মূল ভিত্তি যেন পূর্তগীজ আমলেই হয়েছে। তাইতো এত বছর পরেও গোয়া গেলে আপনি নানান জায়গায় পূর্তগীজ স্থাপনা খুঁজে পাবেন। এখান হতে আমরা গেলাম গোয়া মিউজিয়াম। ও হ্যাঁ, এর ফাঁকে দুপুরের লাঞ্চ সেরে নেয়া হল।
গোয়া মিউজিয়াম মূলত “State Archaeology Museum, Panaji” নামে পরিচিত। ১৯৭৩ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আওতায় এই জাদুঘরে শুরু হলেও ১৯৭৭ সালে ভাড়া করা একটি ছোট ভবনে এর যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে এটি নিজস্ব ভবন নির্মান করে যাত্রা শুরু করে; যার উদ্বোধন করেছিলেন ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি। এখানে প্রাচীন ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, শিল্প এবং চারুকলা, ভৌগলিক বিভাগ হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। এখানে প্রায় আট হাজারের বেশী জিনিস প্রদর্শিত হচ্ছে যেগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ sculptures, wooden objects, carvings, bronzes, paintings, manuscripts, rare coins এবং anthropological objects। মিউজিয়ামটি নতুন করে ভবন গড়ার জন্য সরিয়ে নেয়া হয়েছে Adil Shah's Palace (Old Secretariat), Panajiতে, যা আগে ছিল EDC Complex in Patto, Panaji । সেখানে নতুন ভবন নির্মান করা হচ্ছে জাদুঘরের জন্য।
এখান হতে গেলাম দুটি মন্দির, লতা মুংগেশকর এর জন্মস্থাম মুংগেশ ভিলেজ, ওয়াক্স মিউজিয়াম। বিশেষ করে ওয়াক্স মিউজিয়ামটা ভীষণ ভাল লেগেছে, এটা নিয়েও একটা ছবিব্লগ দেয়া যেতে পারে। অপেক্ষা করা যাক আপাতত। সবশেষে বিকেলবেলা গেলাম গোয়ার বিখ্যাত সেন্ট জেভিয়ার্স চার্চ দেখতে।
যার নাম হল The Basilica of Bom Jesus। পুরাতন গোয়ায় অবস্থিত এই চার্চটি ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট এর স্বীকৃতি প্রাপ্ত। এখানে St. Francis Xavier এর মরদেহ রয়েছে। এটি ভারতের প্রথম ব্যাসিলিকা যার নির্মান কাজ ১৫৯৪ সালে শুরু হয়েছিল। যা ১৬০৫ সাকে আর্চবিশপ, Dom Fr. Aleixo de Menezes এর দ্বারা সমাপ্ত হয়েছিল। এটি খৃষ্ট ধর্ম উপাসনালয়ের মধ্যে অন্যতম হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেয়।
স্ক্যানিয়ান আইল্যান্ডে সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার এর মৃত্যুর পর তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পূর্তগালে, দুই বছর পর তা জাহাজে করে গোয়ায় নিয়ে আসা হয়। বলা হয়ে থাকে তার দেহ এখনো তাজা রয়েছে। এই দেহবাশেষ এখনো সারা পৃথিবীর পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। প্রতি দশ বছর পর পর জনগনের দেখার জন্য তা উন্মুক্ত করা হয়। শেষ ২০১৪ সালে এমনটা করা হয়েছিল। দামী সব পাথর আর মার্বেলে তৈরী হয়েছে এর মেঝে জুড়ে সাধাসিধে ডিজাইনের এই চার্চে রয়েছে জেসাস সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা St. Ignatius of Loyola এর স্ট্যাচু।
বিকেল নাগাদ ঘোরাফিরা শেষ করে ছয়টার কিছু আগে আগে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। হ্যাঁ ভাল কথা, তখন গোয়া-মুম্বাই জোনে সন্ধ্যে হত সাতটার পরে। মুম্বাই হতে যেদিন কলকাতা হয়ে ঢাকা ফিরছি সেদিন কলকাতায় দেখলাম সন্ধ্যে হল ছয়টার আগে অথচ একদিন আগে একই দেশের অন্য একটি শহরে সন্ধ্যে হতে দেখেছি এক ঘণ্টারও বেশী সময় পরে। সেসব গল্প আগামী পর্বগুলোতে করা যাবে। হোটেলে ফিরে আজ আর ঘোরাফিরা করলাম না, যার যার রুমে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে চলে এলাম পানজিম বাস স্ট্যান্ড, উদ্দেশ্য গোয়া হতে নাইট কোচ করে মুম্বাই এর উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া। সেই নাইট কোচ খুঁজে বের করার এক বিশাল বিড়ম্বনা নিয়ে মুম্বাই সফর শুরু হয়েছিল ঠিক সেই সময়টায় যখন কিছু বাংলাদেশী সাংবাদিক খেলা কাভার করতে গিয়ে মুম্বাইয়ে হোটেল পাওয়া নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন; পড়েছিলাম আমরাও... সেইসব গল্প নিয়ে খুব শীঘ্রই হাজির হচ্ছি। যদিও আমার এই খুব শীঘ্রই মাঝে মাঝে অতি অতি দীর্ঘ হয়ে যায়, সবই বোকা মানুষের বোকা বোকা কর্মকান্ড’র ফল।
সবশেষে দেখে নেই গোয়াতে আমাদের তিনদিনের আশ্রয়, "মিরামার বিচ রেসিডেন্সি" এর কিছু ছবিঃ
ছবিঃ লেখক এবং উইকি
এই সিরিজের আগের পর্বগুলোঃ
মিশন গোয়া - ২০১৬ (প্রথম পর্ব)
পানজি টু মিরামার : মিশন গোয়া - ২০১৬ (দ্বিতীয় পর্ব)
নর্থ গোয়া ডে ট্রিপ (প্রথমাংশ) - মিশন গোয়া - ২০১৬ (তৃতীয় পর্ব)
নর্থ গোয়া ডে ট্রিপ (শেষাংশ) - মিশন গোয়া - ২০১৬ (চতুর্থ পর্ব)
Abyss Marine Fish Aquarium - (সাউথ গোয়া ডে ট্রিপ) - মিশন গোয়া - ২০১৬ (পঞ্চম পর্ব)
আগের ভারত ভ্রমণের সিরিজগুলোঃ
কাশ্মীর ভ্রমণ সিরিজ
দিল্লি-সিমলা-মানালি সিরিজ
কেরালা ভ্রমণ সিরিজ
কম খরচে ভারত ভ্রমণ সিরিজঃ
কম খরচে ভারত ভ্রমণ - প্ল্যান ইউথ বাজেট ডিটেইলস সিরিজ
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১১:৫৬