সকালে আটটার পরে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে দ্রুত নীচে নেমে এলাম। সকালের নাস্তার ব্যবস্থা হোটেলের লাগোয়া রেস্টুরেন্টে খোলা আকাশের নীচে বিশাল ডাইনিং লাউঞ্জে। নানান দক্ষিণী আইটেমের সাথে প্রচলিত ভারতীয় মেন্যুর সাথে ইউরোপীয় ব্রেড-বাটার টোস্ট, ওমলেট, ফ্রুট জুস। গপাগপ পেট পুরে ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে দৌড় দিলাম অপেক্ষমাণ বাসের দিকে। আয়েশ করে সকালের চা’টা শেষ করতে পারলাম না। কারন, আমাদের আজকের ডে-ট্যুরে’র আমাদের পিকআপ টাইম সকাল নয়টা। তড়িঘড়ি করে বাসে এসে সিট দখল করে বসে পড়লাম; সবাই উঠে বসে আছি, ড্রাইভার এবং গাইডের খবর নাই। মিনিট পনেরো পরে তাদের দেখা মিলল, এক জোড়া সহযাত্রী মধ্য বয়সী দম্পতির সাথে, উনারা নাস্তা করতে দেরী করে ফেলেছিলেন কিনা.... আর আমি আমার আমার সাধের চা’টুকু নাকেমুখে পাণ করে বিশ মিনিট ধরে বসে আছি!!! আমাদের মিরামার রেসিডেন্সি হতে বের হয়ে গাড়ীটি পথিমধ্য হতে GTDC এর বিভিন্ন হোটেল হতে আরো কয়েকজন যাত্রী নিয়ে শুরু করল আজকের নর্থ গোয়া যাত্রা ডে ট্রিপ।
প্রথম গন্তব্য কোকো বিচ, সারি সারি নারিকেল গাছ দিয়ে ঘেরা অর্ধ ডিম্বাকৃতির এই সৈকতে সারি সারি বোট দারিয়ে আছে, তার চারিধারে উড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে সীগাল সহ আরো নানান পাখি। এখান থেকে ডলফিন ট্রিপের জন্য এক ঘন্টার সময় দেয়া হল। কিন্তু, আমরা গতদিনই এই ট্যুর করে ফেলেছি বিধায় ঘুরে বেড়ালাম সৈকতের আশেপাশে, তোলা হল ছবি। গোয়া’র নেরুল নদীটি যেখানে এসে মানদোভি মোহনায় মিশেছে, ঠিক সেখানটায় এই কোকো বিচ এর অবস্থান। এটির ঠিক বিপরীত পাশেই পানাজি (গোয়ার প্রধান শহর) এর অবস্থান। এখানে বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট রয়েছে যেগুলো বিকেলবেলা পর্যন্ত কোলাহল পূর্ণ থাকলেও গোয়ার অনেক বিচের মত সন্ধ্যের পর ব্যস্ত হয়ে ওঠে না; সন্ধ্যে নামতেই এখানকার দোকানপাট সব বন্ধ করে দেয়া হয়। এই মানদোভি মোহনা হতে কিছুটা ভাটি অঞ্চলে আরও দুটো ছোট বিচ রয়েছে; কুদেভলিম আর রিসমাগোস। রিসমাগোস এ রয়েছে পূর্তগীজ ফোর্ট, রিসমাগোস ফোর্ট; যা কিছুকাল জেলখানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল (এটি এখন পাবলিকের জন্য উন্মুক্ত নয়)। কন্ডোলিম বিচ হতে এই কোকো বিচের দূরত্ব ০৫ কিলোমিটার।
ঘন্টাখানেক পরে সবাই ফিরে আসলে, সেখান থেকে রওনা হলাম ফোর্ট আগুডা এবং লাইট হাউসের উদ্দেশ্যে। এখানে যাত্রা বিরতি ছিল আধঘণ্টার। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম এই পূর্তগীজ স্থাপনা। আসলে আজও গোয়া’র পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানান পূর্তগীজ স্থাপনা; গোয়া ভ্রমণে আপনাকে বারংবার মনে করিয়ে দিবে পূর্তগীজ শাসনামলের কথা। ষোড়শ শতকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছিল পূর্তগীজ, ডাচ নাবিকদের দখলদারিত্বের ডামাডোল; একে অপরের দখল হটিয়ে নিজের আধিপত্য কায়েম করতে সর্বদা ব্যতিব্যস্ত থাকতো এই নাবিকদল। তো গোয়া’তে পূর্তগীজদের সর্বদা ব্যস্ত থাকতে হত বাহির হতে ডাচ আক্রমন প্রতিহত করতে; আর অভ্যন্তর হতে মারাঠা’দের। তো এই ডাচ আর মারাঠা’দের প্রতিহত করতে ১৬১২ সালে নির্মিত হয় এই ফোর্ট আগুডা।
পরবর্তীতে ইউরোপ হতে যত জাহাজ ভারতীয় উপমহাদেশ এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করত, তাদের গন্তব্যের রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হত এই ফোর্ট আগুডা। এই ফোর্ট আগোডা গোয়ার মান্দোভি নদীর তীর ঘেঁষে কন্ডোলিম বিচের দক্ষিণভাগে অবস্থিত। নির্মানের সময় এই ফোর্ট নিশ্চিত করত গোয়া’র রক্ষণ, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং জাহাজ যাতায়াতের কেন্দ্রস্থল হিসেবে। এই ফোর্টে একসময় ৭৯টি কামান স্থাপন করা যেত।
এই ফোর্টের লাগোয়া মিঠাপানির একটি আধার হতে জাহাজে নাবিকদের জন্য পানি সরবরাহ করা হত। আর এটা হতেই ফোর্টের নাম আগুডা হয়। এই ফোর্ট এর নিকটেই রয়েছে একটি চারতলা বিশিষ্ট লাইট হাউস যা ১৮৬৪ সালে পুনঃনির্মিত হয় যা এশিয়া’র মধ্যে সর্ব প্রাচীন। এই ফোর্ট দুটি অংশে বিভক্ত ছিল; একটি ছিল উপরিভাগ যা দূর্গ হিসেবে ব্যবহৃত হত। আর অপর অংশ ছিল নিম্নভাগের পানি সংরক্ষণাগার যেখান হতে পূর্তগীজ জাহাজে পাণীয় জলের সরবারহ করে হত। এই জলাধারের ধারণ ক্ষমতা ছিল ২,৩৭৬,০০০ গ্যালন, যা সেই সময়কার এশিয়ায় সবচেয়ে বড় পরিষ্কার পাণীয় জলের আধার ছিল। এই নীচের অংশে জলাধারের সাথে ছিল স্টোরেজ রুম, গানপাউডার রুম। এখানে ছিল লাইট হাউস এবং বেস ষ্টেশন। এখান হতে ছিল একটি গোপন পথ, যেখান দিয়ে যুদ্ধ এবং আপদকালীন সময়ে পালিয়ে যাওয়া যেত। ১৮৬৪ সালের পুনঃনির্মাণের আগে এই লাইট হাউস প্রতি সাত মিনিটে একবার আলো প্রদর্শন করতো। পুনঃনির্মাণের পর যা নেমে আসে প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একবার এবং ১৯৭৬ সালে পরিত্যক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত এটি আরব সাগরে যাতায়াত করা জাহাজকে আলো দিয়ে পথ চলতে সহায়তা করে যেত।
এখান হতে গেলাম রক বিচ আনজুনা এ, চমৎকার একটি পাথুরে সমুদ্র তীর, অনেকটা আমাদের ইনানীর মত। সমুদ্রের নীলাভ জলের সাথে ব্যাকগ্রাউন্ডে পাহাড়ের সারি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাথুরে সমুদ্র সৈকত আপনাকে মুগ্ধ করবে। মাপুসা শহরতলী হতে ০৮ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই বিচ ছড়িয়ে রয়েছে “ল্যাটেরাইট” নামক পাথরে। ছোটখাট এই বিচ এলাকা পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠেছে। সাদা বালিতে কালো রঙের পাথুরে তটে আরব সাগরের ঢেউ যখন আছড়ে পরে তখন সত্যি ভ্রমণ পিয়াসীদের মন ভালোলাগায় ছেয়ে যায়।
এই বিচে সারা বছরই পর্যটকদের ভীড় লেগেই থাকে; বিশেষ করে নিউ ইয়ার আর ক্রিসমাসে। আর হবেই না বা কেন? এখানে রয়েছে ছবির মত সুন্দর প্রাকৃতিক ন্যাচারাল ভিউ, লাক্সারি হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট, নির্জন পরিবেশ, সি-ফুড নিয়ে গড়ে ওঠা নানান রেস্টুরেন্ট যেখানে মিলবে জিভে জল আনা নানান পদের খাবার, এবং নানান বাহারি শপিংশপ। আর তাইতো গোয়া’র অন্যতম জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকত হয়ে উঠেছে এই আনজুনা সি বিচ। আমরা এখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে রওনা হলাম ভাগাতার সি বিচ, যার পাশেই রয়েছে চাপোরা ফোর্ট, যেখানে বলিউডের “দিল চাহ তা হ্যায়” সিনেমার সেই আইকনিক দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছিল। আগামী পর্বে থাকবে এদিনের ডে ট্রিপের বাকী অংশ।
এই সিরিজের আগের পর্বগুলোঃ
মিশন গোয়া - ২০১৬ (প্রথম পর্ব)
পানজি টু মিরামার : মিশন গোয়া - ২০১৬ (দ্বিতীয় পর্ব)
আগের ভারত ভ্রমণের সিরিজগুলোঃ
কাশ্মীর ভ্রমণ সিরিজ
দিল্লি-সিমলা-মানালি সিরিজ
কেরালা ভ্রমণ সিরিজ
কম খরচে ভারত ভ্রমণ সিরিজঃ
কম খরচে ভারত ভ্রমণ - প্ল্যান ইউথ বাজেট ডিটেইলস সিরিজ