[মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৪]
অনুবাদ: আ-আল মামুন
পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী কার্ফিউ শিথিল করেছে
গত বৃহস্পতিবার সেনবাহিনী প্রদেশটি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর পূর্ণ শান্তি বিরাজ করছে বলে দাবি করা হয়েছে এবং গতকাল আরও একঘণ্টার জন্য কার্ফিউ শিথিল করা হয়। কিন্তু প্রদেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দরনগরী খুলনায় ব্যাপক অরাজকতার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, সেখানে বাম সংগঠনগুলো সবচেয়ে বেশি সংগঠিত। সরকার দাবি করেছে একদল ‘বিশৃঙ্খলাকারী’ (miscreants) কিছু সমস্যা সৃষ্টি করেছে। সরকার আরও দাবি করেছে যে প্রদেশের প্রধানতম বন্দরনগরী চট্টগ্রামে জনতা রাস্তায় ব্যরিকেড দিয়ে গত বুধবার সেনাবাহিনীকে বাধা দিয়েছে। তবে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে এবং নিয়ন্ত্রণে আছে। পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবের মুক্ত থাকার দাবি করা হলেও পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের বক্তব্যের পক্ষে শক্তিশালী প্রমাণ রয়েছে যে তিনি ঢাকায় নজরবন্দি রয়েছেন।
গতকাল আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির চার সদস্যের একটি দল জেনেভা থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকবার চেষ্টায় যাত্রা শুরু করেছে। তাদের কাজ হবে যুদ্ধ উপদ্রুত জনগণের রিলিফ চাহিদা যাচাই করা। সুইজারল্যান্ডের এই চার সদস্যের প্রতিনিধিদল করাচির উদ্দেশ্যে প্লেনে যাত্রা করেছে এবং আশা করা হচ্ছে করাচি থেকে তারা ঢাকা পৌঁছাবে। সংকটের সময় পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার দায়ে ভারতকে অভিযুক্ত করে পাকিস্তান সরকার বলেছে যে কলকাতার অদূরে হুগলি নদীতে একটি জাহাজ থেকে গুপ্ত রেডিও ‘ভয়েস অব বাংলাদেশ’ এর সম্প্রচার চালানো হচ্ছে। ভারত এই অভিযোগকে ‘মিথ্যা ও অনৈতিক’ আখ্যায়িত করে অস্বীকার করেছে।
প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া জানাচ্ছে, আজ গুপ্ত রেডিও থেকে আরও কম বুলেটিন সম্প্রচার করা হয়েছে। এই বুলেটিনের একটিতে দাবি করা হয়েছে যে শেখ মুজিবের মুক্তিবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের সাথে তীব্র লড়াইয়ের পর উত্তরবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ শহর রংপুর দখল করে নিয়েছ। গুপ্ত রেডিও থেকে আরও বলা হয়, সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ভারতীয় সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ থেকে দাবি করা হয়েছে যে সেনা কমান্ডার মেজর জিয়া খানের নেতৃত্বে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়েছে। তিনি কূটনৈতিক স্বীকৃতি ও সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন।
জনতা রংপুর সেনাদপ্তর দখল করে নিয়েছে, প্রেস ট্রাস্টের এই রিপোর্টের সত্যাসত্য নির্ণয় করা দুরূহ। এ রিপোর্ট বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না, কারণ রংপুর শুধু ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারই নয়, সেখানে ট্যাংকবহরসহ একটি রেজিমেন্ট রয়েছে। অন্য একটি রিপোর্টে বলা হয়, ঢাকা রেডিও ঘোষণা করেছে যে মার্শাল ’ল হেডকোয়ার্টার থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আরও সেনা নিয়োগের আহবান জানিয়েছে, কিন্তু পরবর্তী রেডিও বুলেটিনে এ সংক্রান্ত আর কোনা সংবাদ সম্প্রচার করেনি। এ ধরনের রিপোর্ট সরকার নিয়ন্ত্রিত রেডিওর জন্য চমকদার খরব হলেও বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে।
ছাত্রাবাসগুলোয় গোলা বর্ষণ করা হয়েছে
যুদ্ধের এই বর্ণনা গত শুক্রবার ঢাকা শহরেরই একটি হোটেলে বসে লেখা। সে সময় আমাদের প্রতিনিধিকে হোটেল ত্যাগ করতে সেনাবাহিনী বাধা দিয়েছে এবং টেলিফোন লাইনও কেটে দেয়া হয়েছিল। শনিবার সকালে পূর্ব পাকিস্তানের বাইরে থেকে এই রিপোর্টটি গার্ডিয়ান অফিসে তার করা হয়।
বৃস্পতিবার রাত ১১:৩০টায় সেনাকনভয়গুলো যখন ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যা শুরু করে তখন বাঙালি গণজাগরণ থেমে যায়। সেনাদের অস্ত্র উঁচিয়ে চলা আজ সকালে আমি দেখেছি। একটি জীপের পিছে ট্রাকে বিশাল পাকিস্তানী পতাকা উড়িয়ে তারা যাচ্ছিল। গত চার সপ্তাহে বাংলায় এতো বড় পতাকা খুব কমই দেখা গেছে। শহরের বিভিন্ন স্থানে এখনও আগুন জ্বলছে। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস এলাকা এখনও দাও দাও করে জ্বলছে। সেখানে রাত ১:২০টায় রকেট লাঞ্চার গর্জন করে ওঠে। নয় ঘণ্টা পরও সেখান থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উড়তে দেখা যাচ্ছে।
যে মেইনরোড ক্যান্টনমেন্টের দিকে গেছে তার উপরই আমার হোটেল এবং শহরের একটু বাইরেই বিমান বন্দর। আমার হোটেল থেকে যা কিছু ঘটেছে সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া সম্ভব নয়। গত রাত ১১টা থেকেই আর্মি গার্ডরা আমাদেরকে হোটেলের বাইরে যেতে দেয়নি। মূলত হোটেলে অবস্থানরত পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তার জন্যই সেনা সদস্যরা পাহারায় রয়েছে। স্বংয়ক্রিয় অস্ত্রের গুলিবর্ষণ ঘণ্টাখানেক ধরে অবিরত চলছে। আর ২:১৫টার দিকে আর্টিলারির গোলাবর্ষণ প্রথম অনুভব করা গেল। হোটেলের ফ্লোর কেঁপে উঠল। হোটেলের এক কর্নারে একটা মোড়। মোড়ের উল্টো দিকে ছোট ছোট দোকনের একটি দোতলা মার্কেটের পাশের গলি দিয়ে দুটি কার টেনে আনা হচ্ছিল।
মেশিন গান
এলাকাটা শান্ত। আধামাইল বা তারও দূরবর্তী অঞ্চলে গুলিবর্ষণের শব্দ শুনছিলাম। এমন সময় মেশিনগান তাক করে দুটি জিপ মোড়ের উপর এল এবং জনশুন্য রাস্তায় গুলিবর্ষণ করল, তারা কার দুটিতে এবং গলির মোড়ের দোকানে আগুন ধরিয়ে দিল। মার্কেটটির ছাদ থেকে কিছু সোরগোল শোনা গেল এবং সাথে সাথে একতালার কর্ণার জানালা বরাবর গুলি করা হলো। একদল সৈন্য বিল্ডিংটি লক্ষ্য করে একটি বাজুকা নিক্ষেপ করার ব্যর্থ চেষ্টা করছিল। ইনফ্যান্ট্রির দুটি দল কার দুটিকে ভেঙে গুড়ো করে রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলল এবং ফাঁকা রাস্তা ও পার্শ্ববর্তী পতিত জমি লক্ষ্য করে মাঝে মাঝেই গুলি বর্ষণ করতে থাকল। প্রবেশদ্বার ভেঙ্গে তারা গণকণ্ঠ সংবাদপত্র অফিসের ক্ষুদ্র উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালো। অফিসের দিকে না গিয়ে তারা গুলিবর্ষণ শুরু করল। ‘গণকণ্ঠ’ সংবাদপত্রটি বাঙালির স্বাধীনতা এবং সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতা নিয়ে সবসময় সোচ্চার ছিল।
যারা অফিসের ভিতর ছিল তাদেরকে বাইরে চলে আসতে বলা হলো যাতে তারা প্রাণে বাঁচতে পারে (যদিও এখানকার ভাষা বাংলা, তারা উর্দূতেই এই নির্দেশ দিল)। সেনারা তারপর জোর করে ভিতরে ঢুকে দ্রুত পুরো একতলা বিলিডংটিতে আগুন ধরিয়ে দিল। যখন এসব ঘটছিল তখন কিছু দূরে রাস্তায় প্রায় পনের জন যুবককে দেখা গেল। তারা স্লোগান দিল। সেনারা তাদের দিকে মেশিনগান তাক করে গুলি করতে শুরু করল। তারা ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ল। ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ও ‘নারায়ে তকবির’ ধ্বনি দিয়ে সৈন্যরা গলির মধ্যে তাদেরকে তাড়া করল।
সেনারা যখন দলবদ্ধভাবে এসব করছিল তখন তাদের দিকে কোনো দিক থেকেই কোনো গুলি বর্ষিত হয়নি, কেউ আহতও হয়নি। লড়াই শুরু হতে পারত কারণ তারা ছাদে মানুষের আভাষ পেয়েছিল। তাদের এই কাজ শেষ হলো। যত্ন করে আগুন দেয়া দুটো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দাও দাও করে জ্বলতে থাকল এবং বিল্ডিংয়ের একটা ব্লক বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝড়া হয়ে গেল। একটি রাস্তার মোড়েই যদি এতকিছু ঘটতে পারে তাহলে সহজেই অনুমান করা যায় গতরাত ১১টার দিকে যেসব স্থানে জনতা ব্যারিকেড দিয়েছিল সেখানে কী ঘটেছে।
একজন সাংবাদিক এক নৈশভোজে যোগদান শেষে হোটেলে ফেরার পথে দেখতে পান বিমানবন্দরের আশেপাশের মোড়গুলোতে ততক্ষণে জনতা রোডব্লক তৈরি করেছে। তার বাহন লক্ষ্য করে ইট ছোঁড়া হয়। রাত তিনটার দিকে সে অঞ্চলে ব্যাপক আগুন জ্বলতে দেখা যায়। সকাল ৭টার দিকে রাস্তা থেকে সব ট্যাংক উধাও, তার পরিবর্তে দেখা গেল ক্রেন। সম্ভবত রোডব্লক সরিয়ে ফেলার জন্যই ক্রেন নামানো হয়। রাতে সবচেয়ে তীব্র গুলিবর্ষণের শব্দ আসছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর দিক থেকে। মহসিন হল এবং মেয়েদের হোস্টেলের দিকে অন্তত এক ডজন ট্যাংকের গোলা বর্ষণ করা হয়েছে। রাত ২:৩০টার দিকে ইকবাল হল দাও দাও করে জ্বলে উঠতে দেখা যায়।
রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টারের দিক থেকেও গুলিবর্ষণের শব্দ পাওয়া যায়। এর আগে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে টেলিফোনে জানানো হয়েছিল যে তাদের বিল্ডিং সেনাবাহিনী ঘেরাও করে রেখেছে। সঠিকভাবে হতাহতের সংখ্যা নিরুপণ করা দুরূহ। তবে এ সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই হাজার অতিক্রম করে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছে বলে যে অনুমান করা হয়েছিল, হয়ত দেখা যাবে এর পরিবর্তে তারা স্কুলের বালক ক্যাডেটদের মতো খেলনা রাইফেল ও বাঁশের লাঠি নিয়েই প্রশিক্ষণ নিয়েছে।
সেনাবাহিনী এখন প্রদেশটির উপর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে বলে বিশ্বাস করছে। একজন ক্যাপ্টেন আজ সকালে এভাবে বললেন, “এখন অবস্থার উন্নতি ঘটবে। এখন আর কেউ সামনে এসে কথা বলতে পারবে না। প্রথমদিকে আমরা বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দিইনি, কিন্তু এখন খুবই গুরুত্ব দিচ্ছি।” অন্য একজন ক্যাপ্টেন আমাদেরকে হোটেলের সামনের আঙ্গিনা দিয়ে লবির দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “আমার নিজের লোকদের যদি আমি হত্যা করতে পারি, তাহলে আমি আপনাকেও হত্যা করতে পারি। এক সেকেন্ডের মধ্যেই আপনার ব্যবস্থা করতে পারি।” তিনি আমাকে সেই সামরিক জনসংযোগ কর্মকর্তার উক্তি স্মরণ করিয়ে দিলেন যিনি দু’সপ্তাহ আগে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, “আমরা যদি নির্দেশ পাই তাহলে এভাবে গুঁড়িয়ে দিতে পারি।”
আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে এটা স্পষ্ট হওয়ার সাথে সাথেই সেনাবাহিনী পদক্ষেপ নিয়েছিল। বুধবার সকালে ঢাকায় জেনারেলদের এক মিটিংয়ের পরই অভিযানের প্রস্তুতি নেয়া হয়। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে সামরিক বাহিনী একটি সুসমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে অভিযান চালায় এবং অন্যদিকে শেখ মুজিবকে সুকৌশলে আলোচনা চালিয়ে যেতে প্ররোচিত করা হয়। চট্টগ্রাম এবং ঢাকার উত্তরে অবস্থিত রংপুর জেলার সৈয়দপুরের ঘটনাবলী অবস্থার অবনতি ঘটায়। চট্টগ্রাম বন্দরে ব্যারিকেড নির্মাণের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে কার্গো খালাস করতে বাধা দেয়ার ঘটনা পুরো শহরটিকে অচল করে দেয় এবং ঢাকার সাথে চট্টগ্রামের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম এবং সৈয়দপুর উভয় জায়গাতেই সৈনিকদের সাথে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন লোক মারা যায়। দেখে মনে হচ্ছে, সেনাবাহিনীর প্রধান টার্গেট ছিল রাজনৈতিক মহল, বাঙালি সামরিক জওয়ান ও প্রেস। আজ সকালে মার্শল ’ল কর্তৃপক্ষ ঢোল পিটিয়ে সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কাঠের লাঠির মতো অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে চলাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং কঠোর সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়েছে।
অন্যান্য বিদেশী সাংবাদিকের সাথে আমাকেও আজ করাচির উদ্দেশ্যে প্লেনে উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। একজন সেনা মুখপাত্র আমাদেরকে দেশ ত্যাগের জন্য মার্শাল ’ল কর্তৃপক্ষের অনুরোধ পৌঁছে দিল। তিনি বললেন, সেনাবাহিনীকে খুব সামান্যই প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছে। রকেট লাঞ্চারের অধিকাংশ গোলাবর্ষণই করা হয়েছে ব্যারিকেড লক্ষ্য করে। কিন্তু যখন আমি দেশটি ত্যাগ করি তখন আকাশে ব্যাপক ধোঁয়ার কুণ্ডলী ভেসে বেড়াচ্ছিল। পুরনো ঢাকার যে অঞ্চলে বস্তিগুলো সেদিক থেকে ঘন ধোঁয়া ভেসে আসছিল। সেনা মুখপাত্রটি বলল, তাদের জানা ছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তোলা হয়েছে। তাই সে এলাকা থেকে ব্যাপক বিষ্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম ‘সত্যিই কি?’ আমি হাতের আঙ্গুল মটকে হত্যার ইঙ্গিত করে আরও জিজ্ঞাসা করলাম, “এভাবেই তাদের ব্যবস্থা করলেন?” সে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হল, বলল: “হ্যাঁ। তারা অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তুলেছিল।” সে আরো বলল, “আমাদের উদ্দেশ্য ছিল মূলত একটি অনৈতিক ডিফ্যাক্টো সরকার উৎখাত করা।”
সৈনিকরা ‘দেখামাত্র গুলি করো’ কৌশল নিয়েছে
প্রায় নিরস্ত্র জনগণের ওপর সামরিক বাহিনীর হামলা শুরু করার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর আমি এবং অন্যান্য বিদেশী সাংবাদিক যখন ঢাকা ত্যাগ করছি তখনও শহরটি জ্বলছিল। ভোরের আবছাঁয়া সরিয়ে পৌর ভবনগুলোর দক্ষিণ দিক থেকে দুই সারি কালো গভীর ধোঁয়া ঢাকা শহরের আকাশ ছেয়ে যাচ্ছিল। একজন বাঙালি অনুমানের ওপর জানালো যে পুরনো ঢাকার বস্তি এলাকা থেকে এই ধোঁয়া উঠছে। এই এলাকা থেকেই শেখ মুজিবের নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ বিপুল একনিষ্ঠ সমর্থক পেয়েছিল। বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে আমরা আরও অগ্নিসংযোগের প্রমাণ পেলাম। পতিত জমিতে অনেকগুলো বাঁশের চালাঘর তখনও একটু একটু জ্বলছিল। আয়তক্ষেত্রাকার একটি মার্কেটের দোকানগুলোতে কিছুক্ষণ আগেই আগুন দেয়া হয়েছে।
বিক্ষিপ্ত গুলিবর্ষণ
সামরিক বাহিনীর অভিযান সম্পূর্ণ সফল হয়েছে দাবি করা সত্ত্বেও সারাদিন ধরে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের বিক্ষিপ্ত গুলিবর্ষণের শব্দ শোনা যায়। আর, মাঝে মাঝে আবার ভারী গোলাবর্ষণের শব্দও পাওয়া যায়। যাওয়ার পথে আমরা ক্যান্টনমেন্ট ও ঢাকা শহরের মধ্যকার প্রধান সড়কে জনতার ব্যারিকেড দেয়ার করুণ প্রচেষ্টা দেখতে পেলাম। কিছু গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে ব্যারিকেড দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। ট্যাংক কিংবা বুলডোজার দিয়ে সেগুলো রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলার চিহ্ন দেখা গেল।
যে কেউই নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে ঢাকা শহর দখলে নিতে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে এবং প্রতিশোধ নিতে কিছু টার্গেট আগে থেকেই চিহ্নিত করা হয়েছিল। যেমন ‘গণকণ্ঠ’ সংবাদপত্র টার্গেট করা হয়েছিল। দেখামাত্র গুলি চালিয়ে তারপর জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারেও আগে থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া ছিল। সেনাবাহিনীর আচরণ থেকে বুঝা গেল যে তারা নিরীহ কোনো গলি দিয়ে যাওয়ার সময়ও নিরাপত্তার জন্য ব্যাপক গুলিবর্ষণ করতে করতে অগ্রসর হয়েছে। এটাও সত্য যে কিছু কিছু ভবনে উদ্দেশ্যেমূলকভাবে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী সরাসরি না করলেও শুক্রবার দুপুরে কারফিউ চলাকালে আগুনের বেগ আরও বেড়ে গিয়েছিল। একজন সরকারি মুখপাত্র দাবি করলেন, জনগণ ব্যারিকেডগুলোর আশেপাশে কেরোসিন জমা করে রেখেছিল সৈনিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য। তাই অনেক জায়গায় আগুন ধরে গেছে। কিন্তু এই দাবি অবিশ্বাস্য।
নির্বিচার
গণকণ্ঠ সংবাদপত্রের বেলায় এমন দাবি খাটে না- পত্রিকাটির প্রথম পাতায় ছাপা আদর্শবাণী ‘জনগণকে সবসময় তুমি বোকা বানাতে পারো না।’ মার্কেটের দোকানগুলো সম্পর্কেও এমন দাবি সত্য নয় বলে আমার বিশ্বাস। সেখানে এখন কোনো লোক নেই, একেবারেই পরিত্যাক্ত হয়েছে। বেসামরিক জনগণের সাথে সেনাবাহিনী কী আচরণ করছে তা পরিমাপ করা দুরূহ। একজন রাশিয়ান সাংবাদিক গাড়ি চালিয়ে হোটেলে ফিরে জানালো, সৈন্যভর্তি কিছু জিপ থেকে বাড়িগুলোর জানালা লক্ষ করে নির্বিচারে মেশিনগানের গুলি চালাতে দেখেছে সে। রাস্তার সব লোকের উপর সেনাবাহিনী গুলি চালাচ্ছে কিনা এক ব্রিগেডিয়ারকে এই প্রশ্ন করা হলে উত্তর দিলেন, “নারী এবং শিশুদের ওপর নয়।”
শুক্রবার পূর্ব পাকিস্তান সময় বিকেল ৫:৩০টার মধ্যে মার্শাল ’ল কর্তৃপক্ষ আমাকে এবং অন্যান্য প্রায় ৩০ জন বিদেশী সাংবাদিককে ঢাকা ত্যাগ করার অনুরোধ করলো। তখনও ঢাকার আকাশে দুই সারি ভারি ধোঁয়া উঠছিল এবং গুলিবর্ষণ চলছিল। সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সালিকের কাছে ব্যাখ্যা চাইলে বললেন, “কিছু কিছু অনুরোধ আছে যা পালন করা বাধ্যতামূলক”! শেষ পর্যন্ত আমি তার ব্যাখ্যাকেই সঠিক ধরে নিলাম। কারণ গত ছয় সপ্তায় ভারত ও পাকিস্তানে আমি রিপোর্ট করার জন্য যে সব নোট নিয়েছি সেগুলো; বেশ কিছু বই ও প্যামপ্লেট, কিছু বন্ধুর ঠিকানা, ডেইলি মিরর এর একটা কাটিং যার বিষয়বস্তু ছিল সম্ভবত ‘অভিবাসীর জন্য ক্রিড়াবিদ হিসেবে পোজ দিয়েছি’ বা এরকম উদ্ভট বিষয় সবই এখন মার্শাল 'ল কর্তৃপক্ষ বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে। আর এই মার্শাল ’ল কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিদের সাথে আমাকে গত ৪৮ ঘণ্টার ১৩ ঘণ্টাই কাটাতে হয়েছে। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না কেন আমাদেরকে ঢাকা থেকে বহিষ্কার করা হলো। হতে পারে যে কর্তৃপক্ষ আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিল। দু’একবার ফটোগ্রাফাররা ফটো তোলার জন্য জানালার বাইরে ক্যামেরা তাক করতে গেলেই সৈনিকরা গুলি করার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের দাবিদার সেনাবাহিনীর আমাদেরকে নিয়ে এতো ভয় পাওয়া উচিত ছিল না। আবার মনে হয় তাদের এই সতর্কতার কারণ হলো তারা পূর্ব পাকিস্তানে আজ যা ঘটছে সে সম্পর্কে বিশ্বাবাসীকে জানতে দিতে চায় না।
রাত ৮:১৫টায় আমাদেরকে আর্মি ট্রাকে করে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়া হলো। বেশ কিছু অ-বাঙালি পরিবারের সাথে ভোর চারটে পর্যন্ত আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হলো। অ-বাঙালি পরিবারগুলোকে আমাদের চেয়েও বেশি ভীত সন্ত্রস্থ দেখা গেল। তারা তাদের দেশেরই একটা অংশ ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। শুধুমাত্র বাঙালি না হওয়ার কারণেই এখানে তাদের জীবন নিরাপদ নয় বলে তারা মনে করছে। রাত ১টা থেকে বিমানবন্দর পানিশুন্য। একজন সুইপার তার নিজের পকেটের পয়সায় আমাদেরকে দু’টো করে বিস্কুট খেতে দিল। আর্টিলারির একজন ক্যাপ্টেন আমাদের প্রত্যেকের কাগজ-পত্র আধাঘণ্টা ধরে পরীক্ষা করল। আমার কাছ থেকে দিনের ঘটনাবলি লেখা একটা নোটবুক, একটা ফর্ম এবং বাংলার পুঁজি বিকাশের উপর একটি লেখা বাজেয়াপ্ত করা হলো।
ছয় ঘণ্টা বিমান ভ্রমণের পর সকাল ১১:৩০টায় আমরা করাচি পৌঁছালাম। কলম্বোয় যাত্রাবিরতিকালে আমাদের ছয়জন বিমান থেকে পালিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। করাচি বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পরই আমাদেরকে কাস্টমস্ পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হলো। ৩টা নাগাদ যখন ছাড়া পেয়ে বেরোলাম তখন আমার পকেট থেকে এবং আমার লাগেজের বিভিন্ন জায়গায় যে নোটগুলো ছিল সব বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে। এমনকি পাকিস্তানের নাম উল্লেখ আছে এমন সব পেপারই হারাতে হয়েছে। ভারতের সেনাবাহিনীর আকার সম্পর্কে একটা ভাষ্য দীর্ঘক্ষণ লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলাম। যখন কাস্টমস অফিসার সেই কাগজটি পেল তখন আনন্দে চিৎকার করে উঠে বলল, “এযে দেখছি মেশিনগান তাক করে আছ!!” আমার সব সহকর্মীর ক্ষেত্রেই এমন ঘটনা ঘটলো। এমনকি একজনের স্ত্রীকে বিবস্ত্র হয়ে দেখাতে হলো সে কোনো ডকুমেন্ট লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে না। ফ্রান্স টেলিভিশনকে কলম্বিয়া থেকে আনা ৮০০০ ডলারের অব্যবহৃত ফিল্ম হারাতে হলো। এবিসি টেলিভিশনের ক্ষতি হলো ২০০০ ডলার।
দ্য গার্ডিয়ান
২৬ মার্চ, ১৯৭১
মুক্তযুদ্ধের প্রতিবেদন ১
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ২
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৩
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:২৮