somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আর কখনোই নয়!

২৬ শে মার্চ, ২০১৪ বিকাল ৫:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পোল্যান্ডে গেলে লোকে অসউইটজে যান। সেখানে কাঁটাতারের দেয়ালঘেরা একটা চত্বর আছে, যে চত্বরের ভেতর আছে সারি বাঁধা পরিত্যক্ত, বৈশিষ্ট্যহীন অনেকগুলো দালান। কী আছে দেখার সেখানে? কিচ্ছু নেই। তবু সেখানে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকেন সবাই। কারণ, ওখানে গেলে ওই পরিত্যক্ত দালানগুলোর পেছন থেকে লকলকিয়ে ওঠে এক অদৃশ্য হিমশীতল ইতিহাস। এই সেই দালানের সারি, যার ভেতর জার্মানির নাৎসি বাহিনী লাখ লাখ মানুষকে ঢুকিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল দরজা এবং তারপর ছেড়ে দিয়েছিল বিষাক্ত গ্যাসের স্রোত। কয়েক মুহূর্তে সেসব মানুষ পরিণত হয়েছিল লাশে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিল এই অসউইটজ গ্যাসচেম্বারে। একটা ছবিতে দেখছিলাম অসউইটজ দেখতে এসেছে একদল শিশু। তাদের হাতে প্ল্যাকার্ড, লেখা ‘নেভার অ্যাগেইন’, ‘আর কখনোই নয়’। যুদ্ধাপরাধ নিয়ে যত কথকতা তার নির্যাস হচ্ছে এই। পৃথিবীতে আর কোনো দিনই যেন এ রকম ঘৃণ্যতম ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, দাবি সেটাই। সে দাবি মেটানোর দায়িত্ব কে নেবে? নেবে যুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্ম। যুদ্ধ-পরবর্তী জার্মান জাতি তাদের সেই কলঙ্কিত অতীতের দায়িত্ব নিয়ে সেই কলঙ্কমোচনের পদক্ষেপ নিয়েছে এক এক করে। তারা যে দল সেই ঘৃণিত অপরাধ সংঘটিত করেছে, সেই নাৎসি বাহিনীকে নিষিদ্ধ করেছে চিরতরে, যার নেতৃত্বে সেই হত্যাযজ্ঞ ঘটেছে সেই হিটলারকে জার্মানির মাটি থেকে সমূলে উৎপাটন করার জন্য এমনকি কোনো শিশুর নাম ‘হিটলার’ রাখাকে করেছে আইনত শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং সর্বোপরি নাৎসি বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি মানুষকে পৃথিবীর মানচিত্রের যেকোনো প্রান্ত থেকে তন্নতন্ন করে খুঁজে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে, হচ্ছে। এ কোনো আবেগ, আক্রোশ, প্রতিশোধের ব্যাপার নয়।
এটা অতি সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ইতিহাসের একটা দায়, মানবতার প্রতি দায়। একটা জাতি শুধু রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার, হাইরাইজ বিল্ডিং তৈরি করে তাদের জীবনযাপনের সুষ্ঠু পরিসর তৈরি করে না, তাকে তার জনগোষ্ঠীর জন্য ইংরেজিতে যাকে বলে একটা ‘মোরাল স্পেস’, একটা সুষ্ঠু নৈতিক পরিসরও তৈরি করতে হয়। একটা বড় নৈতিক প্রশ্নকে অমীমাংসিত রেখে কোনো জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবেও এগোতে পারেনি কখনো।

বাংলাদেশও স্বাধীনতার পর পর এমনি একটা বড় নৈতিক প্রশ্ন মোকাবিলা করেছিল। জামায়াতে ইসলামী নামে যে দল বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে শত্রুপক্ষের সঙ্গে যোগ দিয়ে ঘটিয়েছিল অগণিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, সেই দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, যারা এই দলের নেতৃত্ব দিয়েছিল, তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল, যে পাকিস্তানি সেনারা সরাসরি যুদ্ধাপরাধ করেছিল, তাদের বিচার করা হবে সেই শর্তে তুলে দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তান সরকারের হাতে। লঘু অপরাধকে ক্ষমার আয়তায় আনলেও যে বাংলাদেশিরা গুরুতর যুদ্ধাপরাধ করেছিল, তাদেরও শাস্তি দেওয়া হয়েছিল এবং চলছিল তাদের বিচার-প্রক্রিয়া। একটা জাতিগত নৈতিক প্রশ্নকে সর্বাংশে না হলেও বহুলাংশেই মোকাবিলা করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে সেই যুদ্ধাপরাধী দলকে, সেই যুদ্ধাপরাধী ব্যক্তিদের তাদের যাবতীয় ঐতিহাসিক দায় থেকে মুক্তি দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির মূল স্রোতে ক্রিয়াশীল হওয়ার সুযোগ দিয়ে একটা ব্যাপক নৈতিক সংকটের সূচনা করা হয়। একজন অপরাধী তার অপরাধের জন্য কোনো জবাবদিহি ছাড়া, এমনকি ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়া যদি একটা জনপদে অবাধ বিচরণের সুযোগ পায় তবে সেটা একটা ভয়ংকর নৈতিক ভারসাম্যহীনতার জন্ম দেয়।

একটা সার্বভৌম দেশে সে দেশের স্বাধীনতার পক্ষের এবং বিপক্ষের শক্তি একই পরিসরে ক্রিয়াশীল থাকাটা নৈতিকভাবে বিভ্রান্তিকর। এই বিভ্রান্তি টিকিয়ে রেখে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতির মৌল প্রশ্নগুলোর নিষ্পত্তিও যে সম্ভব না, তা প্রমাণিত হয়েছে একাধিকবার। নব্বই দশকের গোড়ায় একবার এই বিভ্রান্তি কাটানোর ঘোর দাবি উঠেছিল। নানা ছলানায় সে দাবিকে উপেক্ষা করা হলেও সে দাবি মানুষের চেতনা থেকে বাষ্প হয়ে উড়ে যায়নি, প্রজন্ম পেরিয়ে সে দাবি আরও ঘনীভূত হয়ে এবার উচ্চারিত হয়েছে শাহবাগে।

স্বাধীনতার পর পর একটা পরগাছা রাজনৈতিক শক্তি জামায়াতে ইসলামীকে উপড়ে ফেলা ছিল সহজ। কিন্তু সেই পরগাছাকে আবার এ মাটিতে পুঁতে সার-পানি দিয়ে যখন একটা বিষবৃক্ষে পরিণত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে তখন সেটাকে উপড়ে ফেলা হয়ে পড়েছে কঠিন। এই মাটিতে দ্বিতীয়বার জন্ম লাভ করে জামায়াত অত্যন্ত সতর্কতা এবং চতুরতার সঙ্গে শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। নানা আন্তর্জাতিক মদদে একটা বিশাল অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি করেছে তারা প্রথম। সেই অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে তারা শুরু করেছে তাদের সাংস্কৃতিক প্রভাববলয়ের প্রক্রিয়া। ব্যক্তিগত পর্যায়ে অর্থনৈতিক সহায়তার মাধ্যমে, আর্থিক শক্তির জোরে প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার স্থাপনের মাধ্যমে তারা তাদের নিজস্ব ধারার ইসলামকে ব্যাপকভাবে প্রচারিত করে একটা সাংস্কৃতিকবলয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও তাদের প্রচারিত ইসলামকে মতাদর্শগতভাবে ঘোর বিরোধিতা করে এ দেশেরই একাধিক ইসলামি দল। অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক শক্তির জোরে জামায়াত যে রাজনৈতিকবলয় তৈরি করেছে, তার জালে তারা আটকে ফেলেছে নানা সুবিধাবাদী ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীকেও। এই জালে তারা বিভিন্ন সময় আটকে ফেলেছে দেশের প্রধান দুই দলকেও। তারা তৈরি করেছে তাদের প্রকাশ্য এবং ছদ্মবেশী বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থক গোষ্ঠীও। ফলে বাহাত্তরে নাজুক জামায়াতকে শুধু রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করাই যথেষ্ট থাকলেও আজ এত দিন পর একে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক—তিনভাবে মোকাবিলার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

কিন্তু কথা এই যে নানা ঘটনার পাকচক্রে একটা বিষবৃক্ষ এই মাটিতে শিকড় গজিয়ে, ডালপালা মেলার সুযোগ পেয়েছে বলেই সেটা এ মাটিতে অবাধে দাঁড়িয়ে থাকার স্থায়ী অধিকার পাবে, তার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। ভোট রাজনীতির কূটতর্কে জামায়াতকে জিইয়ে রাখার সিদ্ধান্ত যে আত্মঘাতী, তা প্রমাণিত হয়েছে বারবার। প্রশ্ন উঠেছে নিষিদ্ধ জামায়াতের গোপন তৎপরতার চেয়ে প্রকাশ্য জামায়াত নিরাপদ কি না। কিন্তু গত চার দশকে জামায়াত-শিবির বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌল চেতনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অবিরাম যে বীভৎস, নৃশংস রাজনীতিচর্চা করেছে, গোপন অবস্থায় এর চেয়ে আর কী ভয়ংকর রূপ তারা নেবে, সেটা বোধগম্য নয়। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে যুদ্ধাপরাধ এবং জামায়াত প্রশ্নটা চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি ঘটিয়ে বাংলাদেশের জন্য জাতিগত একটা ‘নৈতিক পরিসর‘ তৈরির সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়েছে এবার। এবারও যদি আমরা সেই বিষবৃক্ষের মূলোৎপাটনে ব্যর্থ হই তাহলে এ দেশেরই অনাগতকালের নতুন শিশু অবধারিতভাবে আবারও কোনো দিন ‘নেভার অ্যাগেইন’ প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়াবে এবং আমাদের অভিশাপ, ধিক্কার দেবে।

শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১৪ বিকাল ৫:৫৬
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×