ধর্ম নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায় অনেকেই আপত্তি তোলেন, বিধর্ম ী বা কাফের এ-জাতীয় লেবেল এঁটে দিতে পারলে খুশী হন। গাল-মন্দ করেন। সাবধানবানী বা হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন। ধর্ম কি আমাদের সামাজিক জীবনের বাইরের কিছু? ধর্মতো আমাদের শুধু সামাজিক নয়, রাজনৈতিক জীবনকেও প্রভাবিত করছে, বিশেষত যখন ধর্ম-ভিত্তিক রাজনীতির তোড়জোড় চলছে দেশে এবং বিদেশে। শুধু ধর্ম নয়, যে কোনো বিষয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্য অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু যুক্তি-দর্শন ভিত্তিক আলোচনায় আমরা মুসলমানরা কেন এখনও পিছিয়ে আছি? ধর্মের সমাজ-তাত্তি্বক ও রাজনৈতিক বিশ্ল্লেষন করতে গেলে আমরা কেন এত আঁতকে উঠি? আমাদের ভয়টা কোথায়? ভয়কে অতিক্রম করা আমাদের জন্য আজ খুব জরুরী। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, সব ধর্মের মত ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেও সিদ্ধি অর্জনের পথ ও মতে বৈচিত্র্য রয়েছে। সুনি্ন-শিয়া, ওহাবী-সালাফি ইত্যাদি নানা বিভাজনকে আমাদের মানতে হবে। যদি তা-ই হয় তাহলে ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে বাঁধা কোথায়?
খ্রিস্টান ধর্ম-অনুসারিদের এক মধ্যযুগ কেটেছে ধর্মান্ধতা নিয়ে - ধর্মগুরুদের পারষ্পরিক কলহ ও শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করে কেটেছে কয়েক শো বছর। সে সময়ে গ্র ীক সভ্যতার জ্ঞান-বিজ্ঞানকে চিরতরে হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা থেকে উদ্ধার করেছে মুসলমানরা; অনুবাদ করেছে তা নিজেদের ভাষায়, চর্চা করেছে ব্যাপকভাবে, দিগন্ত প্রসারিত করেছে নতুন চিন্তার। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে থাকলো অপার অন্ধকারে। আর পশ্চিম জেগে উঠলো নতুন সম্ভাবনা নিয়ে, সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারাবাহিকতা বহন করে মধ্যযুগীয় চার্চ-কেন্দ্রিক ধর্ম ীয় প্রাধান্য ভেঙে নিয়ে এলো রেনেসাঁ। আর মুসলমানদের অন্ধকার গভীর থেকে গভীরতর হলো। আমরা আজও বহন করছি সেই অন্ধকার।
পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। আমাদের এই ভারত উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম অনুপ্রবেশের যে ইতিহাস তা এই অন্ধকারকে আরো ঘনীভূত করেছে। আসুন প্রয়াত আহমদ ছফার লেখা পাঠ করে একটু বোঝার চেষ্টা করি: "ভারতে ইসলাম প্রচারে মধ্যপ্রাচ্যের সুফী দরবেশদের একটা গৌণ ভূমিকা ছিল বটে, কিন্তু লোদী, খিলজী এবং চেঙ্গিস খানের বংশধরদের সাম্রাজ্য বিস্তারই ইসলাম ধর্মের প্রসারের যে মুখ্য কারণ, তাতে কোনো সংশয় নেই। এই পাঠান-মোগলদের ইসলাম এবং আরবদের ইসলাম ঠিক একবস্তু ছিল না। আব্বাসীয় খলীফাদের আমলে বাগদাদে, ফাতেমীয় খলীফাদের আমলে উত্তর আফ্রিকায় এবং উমাইয়া খলীফাদের স্পেনে যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হয়েছিল, ভারতবর্ষে তা কোনোদিন প্রবেশাধিকার লাভ করেনি। মুসলমান বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকদের যে অপ্রতিহত প্রভাব ইউরোপীয় রেনেসাঁকে সম্ভাবিত করে তুলেছিল, ভারতের মাটিতে সে যুক্তিবাদী জ্ঞাচর্চা একেবারে শিকড় বিস্তার করতে পারেনি। খাওয়া-দাওয়া, সংগীতকলা, স্থাপত্যশিল্প, উদ্যান রচনা এবং ইরান, তুর্ক ীস্থান ইত্যাদি দেশের শাসনপদ্ধতি এবং দরবারি আদব-কায়দা ছাড়া অন্য কিছু ভারতবর্ষ গ্রহণ করেনি।" (আহমদ ছফা, বাঙালী মুসলমানের মন)
অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা হওয়া উচিত তাই সবচেয়ে বলিষ্ঠ; তা-না হলে আমরা অন্ধকারে ডুবে থাকবো আরো কয়েক শো বছর। পিছনে নয়, সামনে তাকাবার সময় এখন। 'মুসলিম ব্রাদারহুড' কিংবা 'হিজবুত তাহরীর' বা 'জামাতে ইসলামী' তাকিয়ে আছে পিছনের দিকে। আসুন, আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যাই কয়েক শো বছর। সে হোক আমাদের রেনেসাঁ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



