নবীন রাস্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের সংবিধানের মত আর কোন দেশ এতবার তাদের সংবিধানের পরিবর্তন করেনি অথবা পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় নি। কেন সংবিধান এতবার পরিবর্তনের প্রয়োজন হল সেটা অনুধাবন করতে হলে যতটুকু না আইনের দখল থাকা প্রয়োজন তারচাইতে রাজনৈতিক জ্ঞান প্রয়োগ করাটা বেশী জরুরী। অর্থব্যবস্থার মেরুকরনের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের এই সংবিধান ঐতিহাসিকভাবেই বেশী জোর দিয়েছে সিভিল ও পলিটিক্যাল অধিকার বাস্তবায়নের বিষয়ে; সমাজন্তন্ত্রের প্রতি একধরনের প্যারানয়া থেকেই অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের প্রতি এক ধরনের ঐদাসিন্য দেখা দেয় সংবিধানের প্রায়োগিক পরিপ্রেক্ষিতে। আর এই লিগ্যাসিকে ধারন করে সাম্য ও ন্যায়বিচারের বাস্তবতা-বিবর্জিত এক ইউটোপিয়ান রাস্ট্রীয় দলিল হিসেবে আমাদের সংবিধানের পথচলা স্বাধীন বাংলাদেশে। যার সাথে পরবর্তীতে যুক্ত হয় দেড় যুগের বেশি সময়ের দুঃসহ একনায়কতান্ত্রিকতার পথ চলা।
ঠিক যেই মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিলো, তার একটা বাস্তব ও নিরেট প্রতিফলন এই সংবিধানের শুরুতেই দেখা যায়। শোষনবিহীন সমাজব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে যেখানে বিবৃত হয় এই মর্মে যে রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে। ভালো করে খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে আমাদের ৭১'এর স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলচেতনা কিন্তু বৈষম্যবিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতিই জোর দিয়েছে। যদিও পুজিবাদী সমাজব্যবস্থায় এই ধরনের সমাজ ইউটোপিয়ান চিন্তাভাবনার প্রতিফলন হিসেবে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও কিন্তু একধরনের সাম্য বা সাম্য ধারনার স্থিতিবস্থা ধরে রাখা সম্ভব ছিলো। ধনতান্ত্রিক অনেক রাস্ট্রই এই ধারনাকে সামনে রেখে তাদের রাস্ট্রীয় নীতি ও কর্মকান্ড পরিচালনা করেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সেটা কেন সম্ভব হয় নি তা সামাজিক ও রাজনৈতিক গবেষণার বিষয়বস্তু, সেই বিতর্কে এই পোস্টের মাধ্যমে জড়াতে চাই না। এই সাম্যের ধারনার প্রতিফলন আমরা আবারো দেখতে পাই সংবিধানের ২৭ ও ২৯ অনুচ্ছেদে যেখানে রাস্ট্র তার জনগনের নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় এই মর্মে যে সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং প্রজাতন্ত্রের চাকুরীতে সমতা নিশ্চিত করা হবে।
এই অনুচ্ছেদের ফলশ্রুতিতে যদিও সরকারি চাকুরিতে সমতার দাবী করা যায়, কিন্ত তার বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আরেকটি অনুচ্ছেদ (২৯.৪) যেখানে বলা হয়েছে যে নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না। এই অনুচ্ছেদের সমস্যা হচ্ছে এই যে অনগ্রসর অংশ বলতে ঠিক সমাজের কোন অংশকে বোঝানো হচ্ছে তা সুস্পস্ট করে কিছুই বলা হয় নি। এই অস্পস্টতার সুযোগ নিয়েই যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে এই নিয়মতান্ত্রিক বৈষম্যের ইতিহাস। আর মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রজন্মদের যদি অনগ্রসর অংশ হিসেবে ধরেই নেয়া হয় তাহলে তার ঐতিহাসিক দায় কার উপর বর্তাবে সেই প্রশ্ন এক অমিমাংসীত ও তিক্ত বাস্তবতার মুখোমুখি আমাদের দাড় করিয়ে দেয়। আর রাস্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠা এই বৈষম্যকে মুক্তিযোদ্ধারা কি আদৌ সমর্থন করেছেন কি না তা জনসমীক্ষা ছাড়াই মেনে নেয়া বড্ড কঠিন। জনসমীক্ষার বাইরে গিয়ে আমরা যদি সাধারন নৈতিকতার মানদন্ডে বিচার করি সেখানেও এই অসমতাকে খুব বেশি প্রাধান্য দেয়ার উপায় নেই।
অভ্যন্তরীন এই বিষয়গুলো ছাড়াও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইনের অধীনেও বাধ্য রাস্ট্রীয় পর্যায়ে সমতা নিশ্চিতকরনে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশনের রাস্ট্রীয় সদস্য হিসেবে অনুচ্ছেদ ২.২ এর অধীনে সকল ক্ষেত্রে সাম্য নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ নৈতিক ও আইনগতভাবে বাধ্য। সমস্যা ঠিক এখানেই যে রাস্ট্র যেখানে সাংবিধানিকভাবে বৈষম্যকে লালন-পালন করে তাকে এক মহীরুহের আকার দিয়েছে সেখানে আন্তর্জাতিক আইন ঠিক কতটুকু অসহায় হতে পারে তা আমাদের সকলেরই বোধগম্য।
এই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েও আমাদের সরকারগুলো অনেকটাই উটপাখীর বালুতে মুখ গুজে থাকার মত আচরন করে চলছে। এই ৩০% কোটার বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী প্রজন্ম যে সম্মানের জায়গাটি হারাচ্ছে তা নীতি-নির্ধারকরা একবারও ভেবে দেখার প্রয়োজন মনে করছেন না। ব্যক্তিগতভাবে, একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আমি কখনোই রাস্ট্রের কাছে এই করুণা ভিক্ষা করতে চাই নি ও চাইবো না। যে স্বাধীন রাস্ট্রে আমার পিতা বা তার সহযোদ্ধাদের জীবন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো অদৃশ্য কারো ইশারায়, সেই রাস্ট্রই যখন কোটার নাম করে তাদের ধারন করা আদর্শ-চেতনাকে ভূলুন্ঠিত করে প্রতিনিয়ত সেই রাস্ট্রের ভিক্ষের চালের নামান্তরে কোটাকে আমি অস্বীকার করি। যে রাস্ট্রে রাজাকারদের গাড়িতে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়তে পারে আর রাজাকারের সন্তানদের শয্যাসঙ্গিনী হয় চেতনার দন্ডধারকদের সন্তানরা, সেই রাস্ট্রের দেয়া কোটাকে আমি অস্বীকার করি। যে রাস্ট্রে কয়েক লাখ টাকার বিনিময়ে দালিলিকভাবে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার জন্ম হয়, সেই রাস্ট্রে শুধু আমি নই, আমার পরবর্তী প্রজন্মও লজ্জা পাবে নিজেকে পুর্বসুরীকে খাটি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উপস্থাপনের ইঁদুর দৌড়ে। খুব ব্যক্তিগতভাবে যদি বলি, যেই খাতা-কলম ছেড়ে আমার পিতা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন, স্বাধীন রাস্ট্রের দায়িত্ব ছিল তাকে সমাজে পুনর্বাসিত করে আবার হাতে কলম তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করা। কলম-পেষা কেরানি হওয়ার জন্য নয়, স্বাধীন দেশে মাথা উচু করে বাচিয়ে রাখার দায়িত্বে ব্যর্থ হয়ে যারা কোটার মত আত্ববিদ্ধংসী ব্যবস্থা চালু করেছেন তাদের জন্য শুধুই করুণা হয়। আমি আমার পিতার অর্জিত একটুকরো কাগজকে অবলম্বন করে কখনো বাচতে চাই নি কখনোই, চেয়েছি তার আত্বত্যাগের আদর্শকে ধারন করে সম্মান-মর্যাদার সাথে আর অন্য সবার সাথে সুষম প্রতিযোগীতার মাধ্যমে আমি যা চেয়েছি তা অর্জন করতে। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও কোটার নামে করুনা ভিক্ষা চাই নি, চেয়েছি স্বাধীন দেশে মাথা উঁচু করে দাড়াতে, নিজের পায়ে নিজে দাড়াতে। সমতা যদি না হয়, তবুও সাম্য যেন কায়েম হয়। যে চেতনাকে লালন করে আমার পিতা ও তার সহযোদ্ধারা মুক্তির সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন ১৯৭১ সালে, সেই আত্বত্যাগ ও মহান আদর্শের অবমূল্যায়ন করার অধিকার এই রাস্ট্রের নাই। যেই রাস্ট্রের স্বপ্ন তারা দেখেছিলেন সেটা আমরা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছি। এই ব্যর্থতার দায়কে যত দ্রুত আমরা মেনে নিতে পারবো, ঠিক তত দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান হবে আলোকিত বাংলাদেশের পথে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৫:৩১