somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ধর্মহীনদের দেশে সিয়াম সাধনের উপলব্ধি

০৬ ই জুন, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ফাস্টিং? না খেয়ে থাকবে ? এতো সময় ?? ১ মাস! বিস্ময়ে বেরিয়ে আসা চোখ আর হা হওয়া মুখ স্বাভাবিক হতে কয়েক ঘণ্টা লাগে। যে কোন ধর্মহীন, বিশেষত যারা ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জানেনা, তাদের কাছে তো বটেই একজন অমুসলিমের কাছেও সবচেয়ে বড় বিস্ময় এক মাসের সিয়াম সাধন। - কী করে এতক্ষণ না খেয়ে থাকবে? কাজ করতে পারবে? হাঁটা চলা করতে পারবে ? - সূর্যাস্তের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত ননস্টপ খেতেই থাকবে?

শেষ প্রশ্নটা নিজের কাছেও ছোটবেলায় যৌক্তিক ছিল। এমনকি এখনো অন্যসব পূর্ণ বয়স্ক মানুষের মতই মনে হয় ইফতার ভেঙে আজান দিয়ে খাব। কিন্তু পাকস্থলী তার বরাদ্দকৃত জায়গার বাইরে আর কিছুই ঢুকাতে দেয়না। কাজেই দ্রুত রণে ভঙ্গ দিতে হয়। ইউরোপ, আমেরিকায় এখন প্রচুর মুসলমান। চাহিদা অনূযায়ী অনেক মুসলিম রেস্টুরেন্ট, তৈরি খাবারের দোকান, হালাল পণ্যের বাজার। আমেরিকার জ্যাকসন হাইটস বা ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট লন্ডন তো বাঙালি পল্লীই । খাবার কেন, সবই মেলে। এলাকা জুড়েই বাঙালিয়ানা। এলাকার বাতাস, ঘ্রাণ ,চেহারা সবই পাল্টে বাঙালি রূপ ধারণ করেছে। এছাড়া মুসলিম দেশগুলির চিত্র তো কম বেশি একই। পুরো রোজায় অফিস, আদালত, রাস্তা সর্বত্র রোজার আমেজ, ইফতার আর ঈদ পণ্যের সমাহার। ব্যাতিক্রম জাপানের মত ধর্মহীন, নামমাত্র বিদেশিদের দেশে। খোদ চায়নাতেও উইগুরস্তানের অধিবাসীদের দরুন তারা ইসলাম,মুসলিম দুটোই ভাল চেনে। ওদের অনলাইন সাইটে মুসলিমার পোশাকও পাওয়া যায়। তফাৎ হলো চায়নায় কোন প্রকাশ্যে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের অনুমতি নেই। আমার এক ছাত্র ছিল উইগুরস্তানের মুসলিম, দিলশাদ। তার কাছেই বিশদ শুনতাম। তার বাবা- মা এবং সে বরাবরই রোজা পালন করে। অফিসে বিধিনিষেধ হল রোজা রেখে কাজে যেন কোন বিঘ্ন না ঘটে কিংবা ইফতার বা অন্য কিছুর জন্য নির্দিষ্ট সময় না চাওয়া হয় কাজের ব্যস্ততার মাঝে।

চীন-জাপানের কালচারে সরকার বা রাষ্ট্রব্যাবস্থার বিরুদ্ধে কোন কিছুতে তারা প্রায় মুখ খুলতেই শেখেনি। তাই এর বাইরে দিলশাদ আমায় কিছু জানায়নি। আর জাপানে কারো কোন কিছুতে বাধা নেই, যতক্ষণ না অন্যের ক্ষতি করে কিছু করা হচ্ছে। আর, চায়নার মতই জাপানে ধর্মীয় কোন ছুটি ছাটা নেই। বিশেষ উল্লেখ্য, বড়দিন। কয়েক মাসব্যাপী বড়দিনের বিশেষ সেল। বছরের সবচেয়ে বড় সেল চলে তখন, কালচারাল প্রোগ্রাম হবে, পার্টি হবে, কিন্তু বড়দিনের সরকারি বেসরকারি কোন ছুটিই নেই। অফিস পৌনে ছটায় ছুটি হলেও আমার ৭টার আগে বের হওয়া হয় কেবল এই মাসেই। হুড়মুড় করে ঘরে ফিরে কোনমতে কিছু বানিয়ে সাড়ে ৭টায় ইফতার ধরা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সমগ্র জাপান ৪টা অংশে বিভক্ত, দক্ষিণ থেকে উত্তরে কিউশ্যু , হংশু , শিকোকু , হোক্কাইডো। এর ভেতরে আমরা থাকি দক্ষিণে, কিউশ্যুতে। অত্র অঞ্চলের সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে বড় মসজিদ আমাদের শহর ফুকুওকায় স্থাপিত। মূলত বিখ্যাত কিউশ্যু বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরেই। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে কম বেশি ৩০টি মুসলিম দেশের ছাত্র-ছাত্রী, এর পুরানো ক্যাম্পাসের কাছেই এটি স্থাপিত। মসজিদে মোয়াজ্জিন একজন গানার মুসলিম। তিনি ছাড়া অস্থায়ী কিছু খাদেম আছেন বিভিন্ন কমিউনিটির। এর বাইরে স্বয়ং ইমামও অস্থায়ী। বর্তমানে প্রায় ৩ বছর ধরে আছে লিবিয়ান ড. নূর, ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংএর পোস্ট ডক্টরাল ফেলো , কিউশ্যু ইউনিভার্সিটি। আগেই উল্লেখ করেছি, কারো বিরক্ত উদ্রেক গ্রাহ্য করা হবে না। তাই আজানের মাইক্রোফোন মসজিদের ভেতরেই বলবৎ, আওয়াজ বাইরে যেতে পারবেনা।

বড় কমিউনিটির ভিত্তিতে রমজানের শনি-রবি ছুটির দিনে সেই কমিউনিটির খাবারে পরিবেশিত গ্রান্ড ইফতার হয়। শনি রবিবার সেই হিসেবে অনেক রোজদার সমবেত হন। প্রায় ৫০০ লোকের ইফতার হয় সেদিন মসজিদে। পুরুষদের নামাজের স্থান ১ম তলা । রান্নাঘর, আহার ও বিশ্রাম গ্রাউন্ড ফ্লোরে, বেইজম্যান্টে । মেয়েদের নামাজ ২য় তলায়, আহার বিশ্রাম, রান্না ঘর ৩য় তলায়। সারা বছর মসজিদ কমিউনিটির ইসলামের দাওয়াতসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। নারী-পুরুষ সব কমিউনিটি লিডার এবং প্রতিনিধি মিলেই আয়োজন করে। আমিও দক্ষিণ এশীয় মহিলাদের লিডার । এবং এই আয়োজনে ডা. জাকির নায়েকও ২০১৫ সনের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জাপান সফরকালে এসেছিলেন। তবে মোটের ওপর গোটা রোজার মাসের প্রথম ২০ দিন ইফতার ও রাতের খাবারে ফলমূল ও পাকিস্তানি কমিউনিটির রান্না করা বিরিয়ানী পরিবেশিত হলেও শেষ ১০ দিন ইতেকাফকারীরা রাত্রিযাপন করেন বলে সেহরিও পরিবেশিত হয়। এর জন্য মসজিদে অনুদানও থাকে। ঈদের দিন বৃহত্তম জামাত। নারী পুরুষের সবার। ঈদের আগের রাতে সব কমিউনিটি মিলে মসজিদ ভাল মতন পরিষ্কার করে সুসজ্জিত করে। পরদিন সব কমিউনিটি থেকে যে যার মত খাবার নিয়ে ঈদের নামাজে যান। বাচ্চাদের কেরাত প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন আয়োজনের পুরষ্কার প্রদান ঈদের দিনেই হয়। সেদিন বিশেষ দায়িত্বে থাকেন সব কমিউনিটির কিছু স্বেচ্ছাসেবক যেন কেউ মসজিদের বাইরে এসে আড্ডা দিতে না পারে। আড্ডা দিতে হলে পার্শ্ববর্তী পার্কে যেতে হবে। কয়েকবার ঈদের দিন পুলিশ এসে উপস্থিত হয়েছিল এতো লোকের জমায়েত দেখে। স্থানীয়রা অনিরাপদ বোধ করে অভিযোগ করেছিল।

সাড়াশব্দহীন বোবা জাতির দেশে আমাদের কোলাহল বড়ই কর্কশ ও অভব্য। তো আমার কলিগ ও অন্যান্যদের আরো মজার মজার প্রশ্নবানের মধ্যে আছে, - পানিও খাওয়া যাবে না? সিগারেটও না? লুকিয়ে যদি খাও? যদি শাওয়ারে ঢুকে পানি খাও? অনেক হেসে ফের জবাব দেই, - শাওয়ারে ঢুকে লুকিয়ে কেন খাবো? আমার ছেলেরা স্কুলে থাকে, আমি তো ইচ্ছা করলে বিরিয়ানী রেধেই বসে বসে খেতে পারি! ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্কুল, বাস্কেটবল ক্লাব করে আমার ছেলেরা সেই ১০ বছর থেকেই এভাবে গোটা মাস ধরে রোজা করে। এতে আমরা অভ্যস্ত। তখন শুরু হয় বিস্ময়ের আরেক ধাপ! - কেন খাও না? অদৃশ্য খোদা বলেছেন বলে? তিনি দেখতে পাবেন বলে? তোমাদের এতো সংযম! এতো আত্ম নিয়ন্ত্রণ!! তবে তো নিশ্চয়ই তোমাদের দেশে কেউ মিথ্যা বলে না, কেউ পাপ করেনা।! পুলিশও লাগে না! স্তব্ধ হয়ে যাই । এর কি জবাব হতে পারে? এত সংযম, এত নিয়ন্ত্রণ, তবে কেন এত মিথ্যা, এত পাপ, এত অপরাধ, এত দুর্নীতি অবিচার! একই মানুষ আমরা, একই মনে একই চরিত্রে ,অভ্যাসে এত ভিন্নতা, দ্বৈততা কেন? কারণ, আমাদের বেড়ে ওঠা, আমাদের পারিপার্শ্বিক শিক্ষা। রোজাপালন আমাদের বেড়ে ওঠার সময়কালীন গড়ে দেয়া অভ্যাস। তবে এভাবেই আমরা পাপমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত কেন হতে পারব না যখন সিয়াম সাধনার মতন এমন অসাধ্য সংযম আমরা করতে পারি? কেন তাদের এই জিজ্ঞাসাগুলির মুখে বিব্রত না হয়ে শিনা টান করে বলতে পারিনা , হ্যাঁ আমরা সবকিছুতেই তাই। আমরা অনেকেই সারা বছর নফল রোজা করি। কিন্তু বেশতী ভালমানুষী, শুদ্ধতা, জীবে দয়ার চর্চা তো দূর বেসিকটাই কয়জন করি? ইফতারে এসে সংযমের বাঁধ না ভেঙে প্রয়োজনের অতিরিক্ত দিয়ে কয়েকজন ভুখা মানুষকে কজন খাওয়াই, ঈদের একাধিক দামী জামা না কিনে কটা বস্ত্রহীনকে দেই? রমজান মাস আসে যায়, আমাদের স্মৃতি ভারী হয় সেহরি, ইফতার, ঈদের জামা কেনার বাহুল্য দিয়ে; জীবের প্রতি দয়ায় বা জীবনের সবক্ষেত্রে সংযম আর বিশুদ্ধতার চর্চায় না। ক্লান্ত হতাশ হয়ে চাঁদরাতে ক্ষীণকায় চাঁদটা প্রশ্ন রেখে যায়, ‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ / মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’

লেখক : তানজীনা ইয়াসমিন,
কলামিস্ট, প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়, বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।
[email protected]
সংগ্রহঃ http://www.jagonews24.com
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:১৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×