somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

১০ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৩:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(২)

আমি একটা কুকুর

বন্ধুরা মনে হয় না কারও মনে সন্দেহ আছে,আমার দাঁত,মাড়ি এতই লম্বা যে ওটা মুখের মাঝে কোনরকমে ধরে রাখা সম্ভব না।জানি এটাতে হয়তো আমার চেহারাটা বেশ ভয়ানক মনে হয়,তবে ওটা তো একটা আনন্দের কথাই।আমার দাঁতগুলো এতই বড় যে একটা কসাই একবার বললো, ‘দেখে মনে হয় ওটা কুকুর না,একটা দাঁতাল শূওর’।

আমি তাকে এত জোরে কামড় দিলাম যেন আমার মাড়িটাও তার চামড়া চর্বি মাংস ছেড়ে হাড্ডি পর্যন্ত পৌঁছে গেল।অবশ্য,এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে একটা কুকুরদের তাদের শত্রুকে স্বভাবজাত ভাবে কামড় দিয়ে বেশ আনন্দই পায়।এ রকম ঘটনা ঘটে যখন,শিকার জেনেশুনে বোকার মত শিকারীর সামনে যায়,পরিনতিটা তো জানাই,ঠিক সে ভাবেই আমার দাঁতটা উশখুশ করছিল,আমিও শব্দ করে ঝাপিয়ে কামড় দিলাম।

আমি তো একটা কুকুর,আর তোমরা যারা নিজেদের মানুষ বলো তারা হয়তো আমার দিকে তাকিয়ে ভাবছো, ‘কুকুর আবার কি ভাবে কথা বলে’।‘অথচ তোমরাই বিশ্বাস কর যে একটা গল্প যেটা একটা লাশ বলে যাচ্ছে,আর নানান চরিত্র সাজিয়ে দিচ্ছে।অবশ্যই কুকুর কথা বলে আর সেটা বোঝার ক্ষমতা তাদেরই যাদের শোনার কান আছে’।

এটা অনেক অনেকদিন আগেকার কথা,দূর দূরান্তের কোন এক দেশ থেকে এক দূবৃত্ত মোল্লা আমাদের রাজধানীর মসজিদের দায়িত্ব নিয়ে আসলো,আচ্ছা ঠিক আছে ওটাকে বলা যাক বায়েজীদ মসজিদ।যাকগে আমি ভদ্রতা করে তার আসল নামটা আর্ বলবো না,আমরা তাকে বরং ‘হুসরেত হোজা’, নামেই ডাকি।এর চেয়ে আর বেশি কিছু আমি কেনই বা ঢেকে রাখবো,লোকটা তো আসলে একটা গবেট মোল্লা।সে তার র্নিবুদ্ধিতার মাত্রা ঢেকে রাখতো তার কথার বাহার দিয়ে,আল্লাহ যেন তাকে আরও ক্ষমতা দেয়।প্রতি শুক্রুবারের নামাজে খুতবার সময় কিছু কিছু নামাজী তার কথায় এতই মুগ্ধ হয় যে তারা একেবারে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে।কিন্ত কেউ যেন আমাকে ভুল না বোঝে,সে শুধু খুতবা নিয়েই ব্যাস্ত,কান্নার পালাটা তার নাই।বরং আরও চীৎকার করে সে নামাজীদের আরও কান্নায় উদ্ধুব্ধ করে।সোজা কথায় মালী,বাবুর্চি,দারোয়ান,আর শয়তান মোল্লার দল সবাই তার বেশ ভক্ত হয়ে উঠলো।
ঐ লোকটা কিন্ত কোন কুকুর না-শোনেন,ও রীতিমত একটা মানুষ-আর মানুষ হলেই তার ভুল হবে-সে ভুলের সূযোগ নিবে অনেকে,ঐ লোকদেরকে কান্নায় ভাসিয়ে দিয়ে হোজা ও আনন্দে ভেসে যেত।সে বুঝতে পারলো তার এই ব্যাবসায় প্রচুর টাকাপয়সা উপার্জন করার সূযোগ আছে।

আবার সাহস করে এই কথাগুলোও বলতে তার দ্বিধা ছিল না, ‘জিনিষপত্রের এত দাম,প্লেগ আর যুদ্ধে আমরা একের পর এক যে হেরে যাচ্ছি,তার একমাত্র কারণ আমরা ভুলে গেছি আমাদের মহান পয়গম্বর আর ইসলামের পথ থেকে সরে গেছি।লোকজন কি মহান পয়গম্বরের জন্ম বৃত্তান্ত মৃতদের সামনে বলতো?৪০ দিনের পর কি তখনও কি পালন করতো মৃতদের জন্য সম্মান করে হালুয়া,নানান রকমের ভাঁজা খাবার বিলানো?মহান পয়গম্বরের সময় সবাই কি পবিত্র কোরান গানের সুরে পড়তো?নামাজ কি এমন ভাবে পড়তো সবাই যে উপলক্ষ্য ছিল কার আরবী উচ্চারন কত বিশুদ্ধ?নামাজের আজান মেয়েদের মত কি সুর করে পড়তো,সবাই?আজকাল মানুষ কবরে যেয়ে মাফ চায়,সমঝোতা করার চেষ্টা করে।আজকাল মানুষ সুফী,জ্ঞানীদের কবরে যায়,অনেকটা মুর্তিপূজার মত তাদের পূজায় মত্ত হয়ে যায়।তারা মনের আশা পূরন করার জন্যে এখানে ওখানে কাপড় বেঁধে দেয়।আমাদের মহান পয়গম্বরের সময়ও এ ধরণের দরবেশ পীর ছিল কি?ইবনে আরাবী এটা বলেই বিপদে পড়ে গেল যে অবিশ্বাসী ফেরাউন মারা গেছে একজন বিশ্বাসী হিসাবে।এই সব দরবেশ,পীর,কালেন্দারী যারা নাচ গান করে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের নামাজ পড়ে বলে, ‘আমরা তো নামাজ পড়ছি,অসুবিধাটা কোথায়’?এই যে সব কাফের,দরবেশের আস্তান ধ্বংস করে দেয়া উচিত?তাদের আস্তানা ভিত্তি সব ছুড়ে ফেলা উচিত সমুদ্রের গভীরে।তা হলেই না সত্যিকারের নামাজ সম্ভব’?

আমি গল্প শুনেছি হুসরেত হোজা,কথাগুলো বলার সময় মুখের চারপাশে থুতু ছড়িয়ে বলতো, ‘আমার বিশ্বাসী বন্ধুরা,মনে রেখ কফি খাওয়া একটা বিরাট গুনাহ।আমাদের মহামান্য নবী কোনদিন কফি খাননি,তার জানা ছিল কফি মানুষের বুদ্ধি নষ্ট করে দেয়,আলসার,হার্নিয়া অসুখের প্রকোপ আনে,প্রজন্ম ক্ষমতাও নষ্ট করে।নবীসাহেবের জানা ছিল ওটা আর কিছু না শয়তানের খাবার।আর কফির দোকানে মানুষ বসে সবাই জড়াজড়ি করে কাছাকাছি সব ধরণের অপকর্ম করে বেড়ায়।কফির দোকানে যারা প্রায়ই যাতায়াত করে,তারা এমন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে যে তাদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মায় কুকুর বেজীরা যা বলে সেটাই শোনে।ঐ সব মানুষ যারা আমাকে নিয়ে কথা বলে তারাই হলো সত্যিকারের জানোয়ার’।

সকলের অনুমতি নিয়ে আমি ঐ হুজুরের শেষ মন্তব্যগুলোর কিছু প্রতি উত্তর দিতে চাই।
আমরা সকলেই জানি হাজী,হোজা,ইমাম এরা সবাই কুকুরদের খুবই অপছন্দ করে।আমার মতে ঘটনাটা আমাদের নবী সাহেবের সময়ের কথা,শান্তি বর্ষিত হোক তার উপর।তিনি একসময় নিজের পোষাকের অংশ দিয়ে একটা বিড়াল ঢেকে দিয়েছিলেন।এই সহানুভুতি কুকুরদের পাওয়ার সূযোগ হয়নি,আর কুকুর বিড়ালের চিরন্তন যুদ্ধের কথা ভেবে নিয়ে অবুঝ লোকেরা বলে বেড়ানো আরম্ভ করলো,নবী সাহেব কুকুরদের খুবই অপচ্ছব্দ করতেন।আর এই কারণে মসজিদের আশেপাশে আমাদের দেখলেই ঝাড়ু,লাঠি ছাড়া আর কোন কিছু জোটে না।

যদি আমি সবাইকে সেই গুহার কথা মনে করিয়ে দিতে পারি,পবিত্র কোরানের একটা সুন্দর অংশ,এটা ভেবে আমি বলছি না যে এই কফির দোকানের অনেকেরেই পবিত্র কোরান জানা নেই,আমি শুধু তাদের জানাটাকে একটু ঝালাই করে দিচ্ছি।এই অংশটায় সাতজন তরুণকে নিয়ে যারা অবিশ্বাসীদের মাঝে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে শেষে একটায় গুহায় আশ্রয় নিল,আর সেখানে তাদের অজান্তে তারা তখন গভীর ঘুমে অচেতন।আল্লাহ তাদের কান
(শোনার ক্ষমতা)বন্ধ করে দিলে তারা ওভাবেই প্রায় তিনশ বছর ঘুমেই কাটিয়ে দিল।ঘুম ভাঙ্গার পর একজন বাজারে একটা রুপোর মোহর খরচ করতে গিয়ে বিপদে পড়লো,দেখলো সেটা অচল,তারা এতই অবাক তখন সেটা আর ভাষায় বর্ননা করা যায় না,মোহরটা পুরোনো কোন শাহের আমলের।কোরানের এই অধ্যায়ে বলা মানুষের সাথে আল্লাহর নিকটত্ব।আল্লাহর মহান সুরের অলৌকিক প্রভাব,সময়ের চাকা থেমে ছিল ঘুমের সুরে,যদিও এটা আমার ব্যাখা দেয়ার ক্ষমতা নাই,তবুও বলে নেই আঠার নম্বর সুরায় লেখা আছে এক কুকুরের কথা যে ঐ গুহার মুখ পাহারা দিচ্ছিল যেখানে সাত যুবক ঘুমিয়ে ছিল।আল্লাহর মহত্ব রক্ষা করতে,কুকুর হিসাবে এই পর্বটা আমার কছে গর্বের,তা ছাড়া এটায় আমি ইরুজুমিদের নোংরামিটাকে তুলে ধরতে চাই।

কুকুরদের প্রতি এই অযথার ঘৃনা কেন?কেন সবাই না জেনে বলে কুকুররা সব অপবিত্র,বাড়িতে কুকুর ঢুকলে চারপাশটা সব কিছু রীতিমত পরিষ্কার করতে হবে,না হয় নাপাক থাকবে বাড়ী ঘর।কেন সবাই বলে কুকুরকে ছুঁয়ে দিলে তার অজুটা নষ্ট হয়ে যাবে?কারও আলখেল্লা যদি আমাদের লোম ছুঁয়ে যায়,তবে সেই পোষাক একটা পাগল মহিলার মত সাতবার ধুতে হবে কেন?থালা বাসন তৈরী করে যারা তারাই একমাত্র বলতে কুকুর ছুঁয়ে গেল সেটা কি করতে হবে?বিড়ালদের নিয়ে কোনদিন এ ধরণের কথা হয়নি।

মানুষ গ্রাম ছেড়ে যেত শহরের স্থবির আবহাওয়ায়,আর পেছনে ফেলে যেত আমাদের মত কুকুরদের।আরম্ভ করলো কুকুরদের এই নোংরামির ইতিহাস।এটাও তো জানা যে ইসলাম ধর্ম আসার আগে বার মাসের দুটো মাসের নাম কুকুরদের নামেই ছিল।আর এখন কুকুরদের নিয়ে কতই না কুসংষ্কার।আমি আমার নিজের সমস্যা নিয়ে কাউকে বিরক্ত করতে চাই না,আমার রাগটার উদ্ভব ঐ ইমাম সাহেবের বানানো কথাগুলো নিয়ে।

আমি যদি বলি ইজুরুমের ঐ ইমাম একটা নোংরা,জঘন্য চরিত্রের লোক,আর ওর জন্মটাও একটা নোংরা অবস্থা থেকে।এ কথাও তো ওরা আমাকে বলেছে,তুমি কি ধরণের কুকুর?লোকজন হয়তো বলবে যেহেতু তোমার প্রভু একটা ছবি দেখানো গল্পকথক,তাই হিংসায় তুমি ঐ ইমাম সাহেবকে নিয়ে যা তা বলছো? ‘যা যা ভাগ’।তবে আল্লাহর ওয়াস্তে বলছি,আমি এই কফির দোকানগুলোর খুবই ভক্ত,আমার কোন ইচ্ছা নাই ওদের উদ্দেশ্য কোন কাদামাটি ছোঁড়ার।এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যদিও আমার ছবিটা এত করুনভাবে আঁকা,
আর আমি যদিও চারপেয়ে একটা জন্ত,তবে দুঃখ এটাই দুপায়ে বসে আমি কফি খাওয়ার কোন সূযোগ পাই না।আমরাও তো কফি আর কফির দোকানগুলোর জন্যে জীবন দিতে দ্বিধাবোধ করবো না।ছবিতে আঁকা আমার মনিব আমাকে কফি ঢেলে দিচ্ছে।ছবি তো আর কফি খেতে পারে না,ঠিক কি না?তোমরা নিজের চোখেই দেখ কুকুরটা চলে যাচ্ছে।

এ কথাটায় আমার উচ্ছাস আরো বেড়ে গেল,কথাবার্তাও বেশ চৌকশ হয়ে গেল।এখন শোন কথাগুলোঃচীনের সিল্ক,আর চীনের দামী থালাবাসন ছাড়া ভেনিসের দূত নূরহায়াত সুলতানকে আমাদের সম্মানী সুলতানের মেয়েকে উপঢৌকন হিসাবে পাঠিয়েছিল,একটা কুকুর।
ভেনিসের একটা কুকুর যার লোম,চামড়া ছিল সিল্কের চেয়েও মসৃন,আবার ঐ কুকুরী এত বেশী বখে যাওয়া ছিল শুনেছি যে তার আবার লাল সিল্কের পোষাকও ছিল।আমাদের এক বন্ধু তার সাথে আবার যৌনসঙ্গমও করেছে-এভাবেই আমি জানি ঐ পোষাকের ফাক দিয়ে অন্য কিছু করতে তার কোন অসুবিধাও হয় না।ঐ কুকুরীর জগতের সব কুকুরেরা বেশ দামী দামী পোষাকআশাক পরে ঘুরে বেড়ায়।এটাও শুনেছি ভেনিসের ঐ সব এলাকায় পোষাক ছাড়া কোন কুকুর দেখলে তারা চীৎকার করে উঠে, ‘অবিশ্বাস্য,একটা উলঙ্গ কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে’, এভাবে একটা কুকুর নাকি অজ্ঞান হয়ে মারাও গেছে।
ঐ অবিশ্বাসীদের রাজ্যে-যারা ইউরোপিয়ান হিসাবে পরিচিত,মালিক ছাড়া কোন কুকুর নেই।নিরীহ কুকুরগুলোর গলায় দড়ি দিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় লোকজন,অনেকটা নীচুদরের ক্রীতদাসদের যে ভাবে গলায় শেকল দিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো।এই সব লোকজন আবার নিরীহ জন্তগুলোকে বাড়ীতে শুধু রাখে না,রাতে তাদের বিছানায়ও নিয়ে ঘুমাতে কোন দ্বিধা করে না।কুকুরেরা কিন্ত একে অন্যের সাথে ঘুরে বেড়াতে পারে না,একে অন্যকে শুকে শুকে আনন্দও খুঁজে নিতে পারে না।ঐ যন্ত্রনার দেশে,কুকুরেরা গলার শেকলে শুধু একে অন্যের দিকে তাকিয়ে দেখে যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে যায়।ইস্তাম্বুলের কুকুরের দল স্বাধীনভাবে একসাথে ঘুরে বেড়ায়,যেখানে ইচ্ছা যায়,এমন কি মাঝে মাঝে মানুষদেরকে ঘেউ ঘেউ করে অস্থির করতেও দ্বিধা করে না।রাস্তার যেখানে সেখানে গুটলি হয়ে শুয়ে থাকতেও কুকুরদের অসুবিধা হয় না ইস্তাম্বুলে,মানুষকে মাঝে মাঝে কামড়ও দেয়,অবিশ্বাসীদের রাজ্যে কোনদিনই যা সম্ভব না।এমন না যে আমি ভাবিনি এগুলোয় হয়তো কারণ যে,ইরুজুমির ইমামের চেলাচামুন্ডারা কুকুরদের জন্যে কোন কিছু খাওয়াদাওয়া তো দূরের কথা কোন কিছুই করতে রাজী না।তারা যদি আমাদের শত্রু হিসাবে গন্য করে,তা হলে তাদের মনে করে দিতে চাই যে আমাদের শত্রু মনে করায় তারা অবিশ্বাসী হিসাবেই গন্য হবে।আশা করি যেন ভবিষ্যতে যখন জল্লাদ তাদের টুকরো টুকরো করবে,আমার জল্লাদ বন্ধুরা তাদের মাংসের স্বাদ যেন আমাকে একটুঁ দেয়।

শেষ করার আগে কটা কথা বলতে চাই,আমার আগের মনিব ছিল সত্যি সত্যিই একজন ভাল মানুষ,যখন রাতে থিবসের দিকে যেতাম,দুজনা দুজনার ওপর বেশ নির্ভরশীল ছিলাম।আমি চীৎকার করে ঘেউ ঘেউ করতাম আর তার কাজ ছিল শিকারের গলা কেটে ফেলা।শিকারের চীৎকার আমার চীৎকার ছাপিয়ে কোনদিনই আশেপাশের কারও কাছে পৌছাতো না।আমার পুরস্কার ছিল খুন করা মানুষদের সিদ্ধ মাংস।আমি কাঁচা মাংস পছন্দ করি না,আল্লাহর অনুগ্রহে যদি ঐ শয়তান ইজুরুমের ইমামের মাংস খাওয়ার সূযোগ হয়,ঐ মাংসে আমি পেট খারাপ করতে চাই না।







আমাকে সবাই বলবে ‘খুনী’

না,আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছি না,কারও জীবন নেয়া সম্ভব আমার পক্ষে,ঐ গর্দভকে খুন করার আগেও কেউ আমাকে বললেও বিশ্বাস হতো না,আমার,তাই অপরাধবোধ বিদেশী সৈন্যদের মত ঘোড়ায় চড়ে ছুটে গেছে আমার কাছ থেকে।আমার মনে হয় কোন অপরাধ করিনি,আমি।দিন চারেক আগে যাকে ভাই বলে ডাকতাম,তাকে খুন করেছি,এখন সেটা মেনে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে আমাকে।
যদি অন্য কোন ভাবে সমস্যটার সমাধান করা যেত সেটা হতো সবচেয়ে ভাল,কিন্ত তা হয়নি।সবকিছু নিজের হাতে নিয়ে আমাকে তখনই এটার একটা হিসেব নিকেশ করতে হলো,আমি একটা মূর্খ লোককে অযথার কতগুলো অপবাদে সম্পূর্ন অঙ্কনশিল্পী সমাজকে কলঙ্কে জর্জরিত করতে দিতে পারি না।

যাকগে,খুনী হিসাবে নিজেকে মেনে নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে,তবু ওটাই এখন সত্যি।বাড়ীতে চুপচাপ বসে থাকা একেবারে অসহনীয়,বের হয়ে রাস্তার দিকে গেলাম।বোনের বাড়ীটা এড়িয়ে গেলাম,তার সঙ্গ একেবারেই অসহ্য আমার,এ রাস্তা ছেড়ে অন্য আরেক রাস্তা অযথাই এ ভাবেই ঘুরে বেড়ালাম বেশ কিছুক্ষন।লোকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম সবাই নিজেকে নিরীহ ভাবে,তবে কারও জানা নেই খুন করার সূযোগ হলে,কে কি করবে।এটা আমার বিশ্বাস,শুধু ঘটনা চক্রেই বেশীর ভাগ মানুষই একটা নিরপরাধী চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে,এই সব নির্দোষ চেহারা হয়তো খুনীই হতো সূযোগ পেলে।ইস্তাম্বুলে চারদিন ধরে হেঁটে হেঁটে ঘুরতে ঘুরতে বুঝলাম,সব মানুষই একটা সুখী চোখমুখ নিয়ে তাদের খুনী চেহারাটাকে ঢেকে রাখছে।শুধু নির্বোধ মানুষই হয় নির্দোষী।

আজকে ক্রীতদাস বাজারের পেছন দিকের কফির দোকানে গল্পকথকের ছবি ঝুলিয়ে কুকুরের গল্প বলার পর্বে আমি সম্পূর্ন ভুলে গেলাম,আমার সমস্যার কথা।হঠাৎ মনে হলো পাশে বসে থাকা লোকটাও খুনী।যদিও সে গল্পকথকের কথায় বেশ হেসে যাচ্ছিল,তবুও আমার অনুভুতি ওর কফির কাপ ধরার ভঙ্গীতে,হয়তো বা ওর বসে থাকা না হয় অন্য কিছু একটা জানান দিচ্ছিল তার আসল চেহারাটা,নিঃসন্দেহে লোকটা একজন খুনী।চোখাচোখি হওয়ার সাথে সাথে লোকটার মুখচোখ একটু কুঁচকে উঠলো।লোকজন কমে যাওয়ার পর,ঐ লোকটার এক সাথী এসে বললো, ‘নুসরেত হোজার লোকজন কখন যে এসে সবকিছু তছনছ করে দেবে’।

ভুরুর ইঙ্গিতে লোকটা তার সঙ্গীকে চুপ করতে বললো।তাদের ভঁয়ের স্রোত আমাকেও ভাসিয়ে নিয়ে গেল।কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না,সবাই যেন অপেক্ষা করে আছে কে কাকে যে খুন করে ফেলবে।

শী্তটাও বেশ একটুঁ বেড়ে গেছে,রাস্তার ধারে ধারে,দালানগুলোর পাশে পাশে বরফের ছোয়ার আভাস।অন্ধকারে ঢাকা রাতটা যদিও তবু ছোট ছোট গলি দিয়ে রাস্তা খুঁজে নিতে কোন কষ্ট হলো না আমার হাতের ছোঁয়ায় ছোঁয়ায়।মাঝে মাঝে কোন কোন কাঠের দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরের বাতির আলো সাদা বরফকে ঝকঝকে করে তুলছিল,তবে সেটা খুবই অল্পসময়ের জন্য।বেশীর ভাগ রাস্তাটাই আমি খুঁজে নিলাম রাতের চৌকিদারের লাঠির শব্দে আর আমার অনুভুতিতে।মাঝে মাঝে আশেপাশের বুড়ো ঝুনো লোকদের প্রচন্ড কাশির শব্দটাও ছুটে আসছিল,সাথে কোন কোন বাড়ীর স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া চীৎকার আর বাচ্চাদের ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কান্না।

বেশ কটা রাত্রি যাওয়া আরম্ভ করলাম কফির দোকানটায়,সময়ের চাকা পেছনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম,খুঁজছিলাম আমার খুনী হওয়ার আগের পর্বের মানুষটাকে,মনটা ভাল করে নেয়ার সুযোগ আর গল্প কথকের কথায় ভেসে যাওয়া।আমার বেশীর ভাগ অঙ্কনশিল্পী সহকর্মীদের যাতায়াত ছিল এই কফির দোকানে।আমার ছেলেবেলার ঐ জঘন্য মানুষটা যাকে আমি একসময় বন্ধু ভাবতাম,তাকে শেষ করে দেয়ার পর অঙ্কনশিল্পীদের সঙ্গটা একেবারেই অসহয় ছিল,আমার।সহকর্মীদের কথা মনে করলেই অবাক লাগে,ওদের আর কিছু করার নেই,শুধু মানুষের বদনাম করা,তা ছাড়া ঐ কফি দোকানের আনন্দের সুরে হারিয়ে যাওয়া।আমি ঐ গল্পকথকের কটা ছবিও এঁকেছি,তারা যেন আমাকে অহংকারী না ভাবে,তবুও তাদের ঈর্ষার মাত্রাটা একটুও কমেনি।

অবশ্য তাদের ঈর্ষার কারণটা একেবারেই যে যুক্তিযুক্ত না,তা না,তাদের মধ্যে একজনও নেই যে রং এর পোঁচে,গল্পকে তুলে ধরার মত স্কেচ,বই এর পাতা সাজিয়ে দেয়ায় আমার সমকক্ষ।কেঊ পারবে না,যুদ্ধ দৃশ্য,শিকার দৃশ্য,জন্ত জানোয়ার,সুলতান,প্রেমিকের দৃশ্য,আমার মত তুলে ধরতে।আমি এটা গর্ব করে বলছি না,ওটাই সত্যি।সময়ে শিল্পীদের জীবনে ঈর্ষাটাই একটা বিরাট অংশ হয়ে দাঁড়ায়।

অস্থিরতায় যখন অযথা হেঁটে বেড়াতাম,আমি বেশ কবার একজন সত্যিকারের ধার্মিক লোকের সঙ্গ পেয়েছিলাম,অদ্ভুত একটা খেয়াল এসেছিল আমার মাথায়।কেন জানি মনে হচ্ছিল আমি যে খুনী হয়তো লোকটা আমার চেহারা দেখেই বুঝে ফেলবে।তাই আমার চেষ্টা ছিল আমার চিন্তাধারাকে অন্য কোন দিকে নিয়ে যেতে,ভুলে যেতে আমি একটা খুনী।

আশা করি সবাই বুঝতে পারছে আমার সমস্যাটা,কেন এত ব্যাখা করছি,কেন না এ সব কিছুই জড়িত আমার এই দূরবস্থার সাথে।কোন কারণে যদি আমি কিছু প্রকাশ করতে চাই এ খুনের ব্যাপারে,তা হলে সবাই আমাকে নাম,ঠিকানা ছাড়া একজন আসামী না ভেবে,
ভাববে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি দোষ স্বীকার করে,শাস্তির জন্য,যাতে আমার অপরাধে শিরচ্ছেদের জন্যে অপেক্ষা করে আছি।চেষ্টা করছি আমাকে তেমন কিছু বলতে না হয়,কিছু কিছু ঘটনা এড়িয়ে যেতেই হবে।আমার কথাবার্তা থেকে বোঝার চেষ্টা করো না আমি কে,তোমাদের মত বিজ্ঞ মানুষ অনেক সময় সবকিছু বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারবে হয়তো,আমি কে।কথায় কথায় ছবি আঁকার পদ্ধতির কথা কিছুটা এসেই যায়।একজন অঙ্কন শিল্পীর কি নিজের একটা ষ্টাইল থাকে,বা সেটা থাকার কথাই?রং এর বাহার,প্রকাশের ভাষায় একেকজন এক একটা চরিত্র।

প্রখ্যাত শিল্পী বিহাজাদের,কিছু ছবি নিয়ে আলোচনা করা যাক,যাকে বলে যায় অঙ্কন শিল্পের ফেরেশতা।তার একটা বিখ্যাত ছবি আঁকা বই যা একটা খুনের ঘটনা অদ্ভুত পারদর্শিতায় তুলে ধরা।হেরাত স্কুলের পদ্ধতির প্রায় ৯০ বছরের পুরোনো বইটা অতুলনীয়।এটা পারস্যের এক শাহজাদার লাইব্রেরীতে ছিল,যাকে খুন করা হয় উত্তরাধিকার স্বত্বের গোলমালে।বইটার কাহিনী হুসরেভ আর শিরিনকে নিয়ে,নিজামীর হুসরেভ,শিরিন-ফেরদৌসীর শাহনামার কাহিনীর না।

দুই প্রেমিকের মিলন হয় জীবনের অনেক ঝড় ঝাপটা সরিয়ে,তবে শয়তান শিরিউয়ে,
হুসরেভের আগের পক্ষের সন্তান এক মুহুর্তের জন্যও তাদের শান্তিতে থাকতে দেয়নি।
শাহজাদা শিরিউয়ের নজর ছিল শুধু তার সিহাংসনের দিকে না,তরুণী সৎ মা শিরিনের দিকেও।নিজামীর ভাষায় শিরিউয়ের,মুখে ছিল সিংহের গন্ধ,শয়তানি চক্রে নিজের বাবাকে বন্দী করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল।রাতের বেলায় একদিন বাবা আর শিরিনের শোবার ঘরে অন্ধকারে ঘুমন্ত বাবার বুকে চাকু মেরে চুপিচাপি বের হয়ে গেল,শিরিউয়ে।সারা রাত্রি ধরে রক্ত ক্ষরণের পর সকালে মারা গেল,হুসরেভ,পাশে শুয়ে ছিল সুন্দরী শিরিন শান্তিতে সব কিছুই তার অজান।

এই দৃশ্যটা খ্যাতনামা অঙ্কন শিল্পী বিহজাদের এমন সুন্দর করে আঁকা যে কোন দর্শকের চোখেমুখে সেই খুনের দৃশ্যের একটা জীবন্ত,ভয়াবহ অনুভুতি নিয়ে আসে।ছবিটা আমার সাথে অনেকদিন ধরেই আছে,রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি একজন আততায়ী খুন করতে এগিয়ে যাচ্ছে,সুন্দর রংএ সাজানো দেয়াল,কাজকরা জানালার ফ্রেম,মেঝের কার্পেটের হাতের কাজের লাল ফুল,চীৎকার করার রং এর পোঁচ,আততায়ীর নোংরা পায়ের নীচে পড়ে থাকা অপরুপ বিছানার কম্বল,পুরো কাহিনীটাই যেন বলে দিচ্ছে।ঘরের সৌন্দর্যের সাথে সাথে আরও বলে দেয়,এই তুমি এখানে আছ আবার এখান থেকেই তুমি চলে যাবে মরনলোকে।ছবির সৌন্দর্য আর মরলোকের একাকীত্ব,যদিও প্রিয়জন আছে পাশে,এই অভাবনীয় দৃশ্য যে কোন মানুষকে দুঃখে অভিভূত করে দেয়।

‘এটা বিহজাদের’,বৃদ্ধ খ্যাতনাম শিল্পীর বছর বিশেক আগের কথা,কাঁপা কাঁপা হাতে আমরা নেড়েচেড়ে দেখছিলাম।তার চোখেমুখ উজ্জল ছিল বাতির আলোতে না,দেখার আনন্দে।‘এটা বিহজাদের ধরণ’।

বিহজাদের জানাই ছিল তার আঁকা ছবিতে সে কোন সময় কোন কিছুই তুলে ধরতে ভুলে যায় নি,ছবির কোন অংশেই না।আর বৃদ্ধ ওস্তাদ শিল্পীর মতে,শিল্পীর নিজের নাম বা চিহ্ন ছবিতে আঁকা কিছুটা লজ্জাজনক।সতিকারের শিল্পী যখন তার মনের অনুভুতি ছড়িয়ে দেয় তার ছবিতে,সেখানে তার নিজের পরিচয়ের কোন অংশ না রাখলেও কিছু যায় আসে না।

নিজের জীবনের ভঁয়ে,আমি আমার অজানা শিকারকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করেছি।আমি এই যে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়াচ্ছি আগুনে বিধ্বস্ত জায়গাটা,কোন সুত্র পড়ে আছে নাকি খুনের,খুনের সৌন্দর্য,পদ্ধতি আমার মাথার মধ্যে ঘোরাঘুরি করছিল।আসলে ভাবছিলাম বিশেষ কোন ভাবে খুন না হওয়ার কারণে হয়তো সহজেই ধরা পড়ে যাবে কে দায়ী।

বরফের এই ঔজল্য ছাড়াও আমি সহজেই খুঁজে নিতে পারতাম,শহরের এই আগুন বিধ্বস্ত জায়গাটা যেখানে আমি বছর পচিশের এক সহকর্মীর জীবনের যবনিকা টেনে দিলাম।তুষারপাতের প্রচন্ডতায় কোন সূত্র যদি থেকেও থাকে,এখন আল্লাহর অনুগ্রহে সবকিছু হারিয়ে গেছে নিশ্চয়।আমরা কোন জঘন্য অপকর্ম করিনি একটা বই এর বিস্তারিত ছবি এঁকে,ঐ অপদার্থ লোকটা দিন চারেক আগে যে ভাবে বলছিল,আল্লাহর দেয়ার প্রতিভার অপব্যাবহার করিনি।

সে রাতে আমি আর সুদর্শনীয় এলেগান্ট এফেন্দী যখন এলাম,তখনও তুষারপাতের প্রভাবটা এত বেশী ছিল না।দূরের কুকুরের চীৎকার কানে ভেসে আসছিল।‘দোয়া,না কি কারণে এখানে আসা আমাদের’?হতভাগা লোকটা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘রাতের এই অন্ধকারে কেন আমাকে এখানে আনলে’?

‘ঐ সামনে যে একটা কূয়া দেখছো,তার দশ পা দূরে আমার জীবনের সমস্ত সঞ্চয় পুঁতে রেখেছি’ আমি বললাম, ‘আমি তোমাকে যা বলছি,তুমি যদি সব কিছু গোপন রাখতে পার,
আমি আর এনিষ্টে এফেন্দি এটুকু বলতে পারি,ঠিকভাবে পুরষ্কৃত হবে,তুমি’।

বেশ উত্তেজিত হয়ে লোকটা বললো, ‘তা হলে তোমরা আগে থেকেই একটা পরিকল্পনা করে রেখেছ’।
‘অস্বীকার করছি,না’,মিথ্যা করেই উত্তরটা দিলাম।
‘তা হলে তুমি বলতে চাচ্ছ,তোমার আঁকা ছবিটা একটা বিকৃত ছবি,ঠিক কি না?কোন সম্মানিত ব্যাক্তির এ ধরণের জঘন্য অপকর্মে কোনভাবেই জড়িত হওয়া উচিত না।তুমি তো নরকে আগুনে ধুকে ধুকে পুড়বে,আর যন্ত্রনা হবে চিরন্তন,এ ভাবে আমাকে তোমার অন্যায়ের সঙ্গী করলে,তুমি’।

তার কথাগুলোয় এটুকু বুঝলাম,তার কথার ওজন আর গভীরতায় মানুষ ইচ্ছা হোক বা অনিচ্ছায় হোক শুনবে,এটুকু আশা লুকোনো ছিল তবুও সত্যিটা উদঘাটন করার সূযোগটা হবে তাদের।এনেষ্টে এফেন্দীকে নিয়ে অনেক গুজব ছিল চারপাশে,তার গোপন বই এর গুজব-অস্বাভাবিক টাকাপয়সা খরচ করার কাহিনী,বইটার ছবি আর বই এর পাতার অলঙ্কার,বাঁধাই এর জন্য-ওস্তাদ শিল্পী ওসমানের কাছে ছিল সেটা একটা নোংরা জঘন্য ঘটনা,এনিষ্টে এফেন্দী ছিল তার ঘৃনা আর অবজ্ঞার পাত্র।

মনে হলো আমার ভাই এলেগান্ট, স্বভাবজাত শয়তানী বুদ্ধিতে,ঘটনাটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বিরাট এক অপবাদের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।জানিনা কতটুকু সততা ছিল তার কথায়?

আমি আবার তাকে কথাগুলো বলার জন্যে বললাম,যার বেশীর ভাগটাই অন্যান্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ,বলার সময় কিন্ত সাবলীল ভঙ্গীতে বলে গেল সে সবকথা।সে যেন ইচ্ছা করেই বললো আমার ছোটবেলার কথা,যখন ওস্তাদ ওসমান তার শিষ্যদের উপর অত্যাচার করেই আনন্দ পেতেন তাদের ভুল শুধরে দেয়ার সময়।সে সময় তার মনোযোগ আমার কাছে ছিল ঈর্ষার ব্যাপার।আমার মনটা বেশ কঠোর হয়ে উঠলো ভেবে সকলের কাছে সবকিছু প্রকাশ করে দিচ্ছে,সে।

রাগে কিছুটা চীৎকার করেই বললাম, ‘আমার কথা শোন’।আমরা ছবির সুরে ঘটনার চিত্র তুলে ধরি,পাতার বর্ডার অলঙ্কারিত করি,রং এর বাহারে ছবিগুলোকে আরও সুন্দর করে তুলি,সোনালী সুরে পাতাগুলো ফুটে উঠে।বছরের পর বছর ওটাই ছিল আমাদের কাজ।
লোকজনের কথামত আমরা জাহাজ এঁকে সাজিয়ে দেই,ঘোড়ায় ছুটে যাওয়া বা বসে থাকা পাগড়ীর সুলতান ছোট্ট একটা ফ্রেমের মধ্যে নিয়ে আসি,বিশেষ পদ্ধতিতে পাখী,বিশেষ আকারের যে কোন কিছু-গল্পের কোন একটা অংশ নাও,এটা ওটা ছেড়ে এটা এঁকে দাও,যার যা বলা সেই কথামত আমরা ছবি এঁকে দেই।এনেষ্টে এফেন্দী আমাকে বললো, ‘শোন এখানে তোমার মনের সাজানো একটা ঘোড়া এঁকে দাও’।তিনদিন ধরে শিল্পের মাহাত্যে নিজেকে ভাসিয়ে ঘোড়ার ছবিগুলো সমরখন্দ থেকে আসা কাগজে এঁকে গেলাম।

আমি স্কেচগুলো এলেগান্টকে নিয়ে দেখালাম,সে বেশ কৌতুহল নিয়েই দেখলো স্কেচগুলো,সাদা কালো ঘোড়াগুলোকে হাল্কা চাঁদের আলোয় পরখ করা আরম্ভ করলো।সিরাজ আর হেরাতের পুরোনো ওস্তাদদের মতে যা বলা, ‘আল্লাহর তৈরী ছোট্ট একটা ঘোড়ার সৌন্দর্য তুলে ধরার জন্যে একজন শিল্পীকে কমপক্ষে পঞ্চাশ বছর শুধু ঘড়ির ছবি এঁকে যেতে হবে।ঐ ওস্তাদদের সবচেয়ে ঘোড়ার ছবি আঁকা হবে অন্ধকারে,কেননা পঞ্চাশ বছর ঘোড়ার ছবি আঁকতে আঁকতে যে কোন শিল্পীই অন্ধ হয়ে যাবে,তাই তার ছবিটা হবে স্মৃতিতে যা আছে ধরা’।

এলেগান্টের নিরীহ দৃষ্টি আর ভাব,ছেলেবেলার অভিজ্ঞতা থেকেই বলে দিল,সে সত্যি সত্যিই ছবিটা নিয়ে বেশ চিন্তা করছে।
‘ওরা আমাদের বলে ছবি আঁকতে,আর আমরা তুলে ধরি এমন একটা ছবি যা মানুষের কাছে মনে হয়,অভাবনীয়,অনেকটা সেই পুরোনো ওস্তাদদের মত।এ ছাড়া আর কিছু না।
আমাদের আঁকা ছবি ছাড়া আর অন্য কিছুর জন্যে তো আমরা দায়ী,না’।

‘আমার মনে হয় না এ কথাটা সম্পুর্ন ঠিক,আমাদেরও একটা দায়িত্ব আছে’,এলেগান্ট মন্তব্য করলো, ‘আমাদেরও দায়িত্ব আছে,আমাদের মনের ইচ্ছটা জড়ানো সেখানে।আমি আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভঁয় করি না।আল্লাহর দেয়া ক্ষমতায় আমরা বিচার করবো ভাল-মন্দের পার্থক্যটা’।

ওটা ছিল একেবারে যথাযথ উত্তর।

‘আল্লাহ দেখে সবকিছু,জানে সবকিছু’,আমি আরবীতে বললাম।আল্লাহর তো জানা তুমি আর আমি এই কাজটা করেছি,হয়তো সম্পুর্ন না জেনেই।কার কাছে তুমি অভিযোগ করবে এনিষ্টে এফেন্দীকে নিয়ে।তোমার কি জানা নেই এ সব কিছুর পেছনে আছে আমাদের সুলতানের হাত’।

চুপচাপ,বেশ একটা নিস্তব্ধতা।

আমি জানি না সে কে সত্যি সত্যিই এক নির্বোধ,নাকি হঠাৎ আল্লাহর ভঁয়ে একেবারেই সত্যবাদী আর একনিষ্ঠ হয়ে পড়েছে।

আমরা ধীরে ধীরে কূয়াটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।আমি অন্ধকারে দেখতে পেলাম তার চোখ দুটো ভঁরা এক অজানা ভয়,কিছুটা দয়াই হলো আমার।তবে বেশ দেরী হয়ে গেছে তখন,
আমি আল্লাহর কাছে মনে মনে দোয়া করছিলাম,যেন একটা সংকেত পাই যাতে বুঝতে পারি,সামনে দাঁড়ানো মানুষটা সত্যিই নির্বোধ-কাপুরুষতা আর লজ্জার এক চিত্র,ঐ অবস্থান যার যাওয়া ফিরে আসা নেই তার আর।

‘বারটা পা হেঁটে গিয়ে গর্ত খোঁড়া আরম্ভ কর’।
‘তারপর,আমি কি করবো’?
‘আমি সবকিছু বুঝিয়ে বলবো এনিস্টে এফেন্দীকে,তারপর ছবিগুলো সে পুড়িয়ে ফেলবে।এ ছাড়া আর কি উপায় আছে,কি বল?যদি নুসরেত হোজার কোন অনুসারী যদি এ ধরণের কোন অভিযোগের কথা শোনে,তবে শুধু বই ছবি না,সাথে আমাদের ছবি আঁকার ষ্টুডিওর অস্তিত্বটাও শেষ হবে।তোমার সাথে ইরজুরুমিদের কার ও সাথে জানাশোনা আছে?এ মোহরগুলো তুমি নাও,তা হলে আমি নিশ্চিত হবো,যে তুমি আমাদের সমন্ধে কাউকে বলবে না’।
‘মোহরগুলো কিসে লুকানো’?
‘ওখানে ৭৫টা ভেনিসের সোনার মোহর আছে,একটা পুরোনো আঁচারের বোয়ামে লুকানো’।
ভেনিসের সোনার মোহর ঠিক আছে,তবে ঐ পুরোনো আঁচারের বোয়ামের কথাটা আমার মাথায় কোথা থেকে আসলো,কে জানে?সত্যি বলতে কি ভেনিসের সোনার মোহর বা ঐ ধরণের কোন কিছুই লুকানো ছিল না ওখানে!আমি ঐ গর্দভের জন্য কোন টাকা নিয়ে বসে নেই যে আমাদের ধ্বংস ডেকে আনার চেষ্টা করছে।হঠাৎ কেন জানি মনে হলো ঐ গবেটটাকে আদরে জড়িয়ে ওর গালে কটা চুমু দেই,অনেকটা আমাদের ছোটবেলার ওস্তাদের কাছে শেখার সময়ের মত,কিন্ত সময় আমাদের মাঝে এসে দাঁড়ানো।তা ছাড়া আমার মনজুড়ে শুধু একটাই চিন্তা গর্তটা কেমন করে খুঁড়বো?নখ দিয়ে,ঐ মানসিক টানাপোড়েন কয়েকটা মুহুর্তই ছিল মাত্র।

ভঁয়ে কূয়ার পাশে পড়ে থাকা পাথরটা হাতে তুলে নিলাম।তখন বোধহয় গোটা পাঁচ কি ছয় পা যাওয়া এলেগান্টের,আমি তার কাছাকাছি পৌঁছে আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে মারলাম তার মাথায়।
এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল সবকিছু,আমি নিজেই হতভম্ব,আঘাতটা ছিল যেন আমার নিজের মাথায়।আমি নিজেও অনুভব করছিলাম যন্ত্রনাটা।

বেশী চিন্তা ভাবনা না করে ঘটনায় যবনিকা টানা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না,আমার।
মাটিতে পড়ে এলেগান্টের শরীরটা তখন হাত পা ছোঁড়াছুড়ি করছে,আমার ভঁয়ের মাত্রাটাও তখন সীমা হারানো।তার শরীরটাকে কূয়ায় ফেলে দেয়ার পর,মনের যুদ্ধ চলছিল এটা কি এক শিল্পীর যুক্তিযুক্ত কাজ হলো,এই নিষ্ঠুরতা,এই অপকর্ম।


সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৩:২৯
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×