somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৩ রাত ১:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা







২৪)

‘তা হলে সেকুরের বাবার জবানবন্দী দরকার,ওটা ছাড়া তালাকের অনুমতি দেয়া সম্ভব না’,বদলী হাকিম মন্তব্য করবে।হতাশায়,দুঃখে আমি অনুরোধ করবো,এনিষ্টে এফেন্দী তো অসুস্থ আর আমি তো তারই প্রতিনিধি।বদলী হাকিম প্রশ্ন করবে, ‘তালাকে সেকুরে কি চায়?আর মৃত্যুমুখী একজন বুড়ো মানুষ মেয়ের তালাক নিয়ে এত চিন্তাই বা করবে কেন?যদি এমন হতো একজন যোগ্য স্বামী তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে,তাহলে সেটা আলাদা কথা’।
‘একজন যোগ্য পাত্র আছে,হুজুর’,আমি বলবো।
‘তা হলে,কে সেই লোক;?
‘আমি,হুজুর’।
‘আরে,ঠিক করে বল,তুমি তো অভিভাবকের প্রতিনিধি’,বদলী হাকিম জিজ্ঞাসা করবে, ‘কি কাজ কর তুমি’?
‘আমি পুর্ব কয়েকটা প্রদেশে,কয়েকজন পাশার খাজাঞ্চী,সহকারী নাজির,নাজির হিসাবে অনেক দিন ধরে চাকরী করে দেশে ফিরলাম।পারস্যের যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লেখা আমার লেখা খুব শীঘ্রিই সুলতানের কাছে নিয়ে যাব,ছবি আঁকা,গল্প আর বই এর পাতা অলঙ্কারে বেশ সুনাম আছে,আমার’।
‘তুমি কি মেয়েটার আত্মীয়’?
উত্তেজনায়,উদ্বেগে আমি এত এলেমেলো হতভম্ব হয়ে কথা বলবো,যে আমার নিজেরই লজ্জা লাগবে।
‘ও রকম ভাবে চোখ মুখ লাল না করে,উত্তরটা দিলে ভাল হয়’,বদলী হাকিম মন্তব্য করলো।
‘ও আমার মামার মেয়ে’।
‘হুম।তুমি কি তাকে খুশী করতে পারবে’?
এই প্রশ্নটা করার সময় হাকিম হাত দিয়ে বেশ নোংরা একটা ইঙ্গিত করে দেখাবে,শিল্পী ছবি আঁকার সময় এই পর্বটা বাদ দিলেই ভাল।আমার চোখ মুখ যে ভাবে লাল হয়ে হয়েছিল সেটা তুলে ধরলেই যথেষ্ট।
‘আমার উর্পাজন খুব একটা খারাপ না,বরং ভাল বললেই মানায় বেশি’।
‘আমি যেহেতু সুফী গোত্রের লোক,আর পবিত্র কোরানের আইন হিসাবে,আমাদের গোত্রের নিয়ম হিসাবে সেকুরের তালাক অনুমোদন না করার কোন কারণ দেখছি না।ওর স্বামীর চারবছর ধরে কোন খোঁজ নাই,মেয়েটা কম ঝড়ঝাপটা সামলায় নি’,হাকিম বললো, ‘আমি তালাকের অনুমতি দিলাম,কেন না ওর স্বামীর ফিরে আসার কোন সম্ভাবনা নাই’।

এর পরের ছবিটা গল্পের চতুর্থ অংশ,বদলী হাকিমের তালাকনামা সই করার দৃশ্য,কালো কালির সৈন্যেরা তখন ছোটাছুটি করছে কাগজে।সেকুরে আর আমার বিয়েতে আর আইনের কোন বাঁধা নাই,এই আনন্দটা আদালত ঘরের টকটকে লাল রং ছাড়া,অন্য কোন ভাবেই কোন শিল্পীর পক্ষে তুলে ধরা সম্ভব না।মিথ্যা সাক্ষী আর হাকিমের সামনের লোকজন যারা কেউ বোন,কেউ মেয়েদের তালাকের জন্যে বসে ছিল তাদের পেছনে ফেলে আমি হেঁটে যাচ্ছি।

বসফারাস নদী পার হয়ে,আমি গেলাম ইয়াকুলটার এলাকায়,যেখানে ইমাম এফেন্দী আর তার ভাই,সেকুরে আর আমার বিয়ের অনুষ্ঠানটা করতে চাচ্ছিল,ওদেরকে কোন ভাবে এড়িয়ে গেলাম,আমার সেকুরের কাছে।মনে হচ্ছিল রাস্তার লোকজন সবাই আমার আনন্দ কেড়ে নেয়ার জন্যে কোন না কোন চক্রান্তে করছে,কাকের দল লাশের খবর পেয়ে ছাঁদে চীৎকার করছিল।এনিষ্টের জন্যে শোক তো দূরের কথা যথাযথ কান্নার সূযোগটাও হয়নি তার,তবে সব কিছুই ঠিকঠাক এগিয়ে যাচ্ছে।

সবকিছুই তাড়াহুড়া করেই আগাচ্ছিলাম,একটা ঢিল বাড়ীর গেটটার দিকে ছুড়লাম,সেখানে না লেগে একপাশে পড়ে গেল,আরেকটা ঢিল ছুড়লাম সেটা গেল একেবারে ছাঁদের দিকে।
দোতালার জানালা খুলে অর্হান মুখটা বের করে দেখছিল,ঐ জানালায় কদিন আগে সেকুরে দাঁড়িয়ে ছিল।সেকুরের ধমকের চীৎকারটা শোনা যাচ্ছিল,সেকুরের সাথে চোখাচোখি হলো,চোখের ভাষায় ছিল, ‘অপেক্ষা কর,আসছি’

সন্ধ্যার অন্ধকার নামেনি তখনও,বাগানে দাঁড়িয়ে আমি বেঁচে থাকার আনন্দ উপভোগ করছিলাম,কিছুক্ষন পর হাইরিয়ে বের হয়ে আসলো,তবে ক্রীতদাসীর পোষাকে না,অনেকটা বাড়ীর কর্ত্রীর পোষাকে।‘আমরা যে ভাবে আলাপ আলোচনা করলাম,ঠিক সে ভাবেই সব কাজ আগাচ্ছে’,তাকে তালাকনামা দেখালাম, ‘আর হ্যা,বিয়ের জন্য আরেক কাজী ঠিক হয়ে গেছে…কিছুক্ষনের মধ্যেই কাজী আসবে,সেকুরে কি তৈরী হয়ে আছে’?
‘যত ছোট অনুষ্ঠানই হোক,সেকুরে চায় বিয়েটা আনুষ্ঠানিক ভাবে হয়,কজন লোকও আসবে,পেশতা বাদাম আর আলু বোখারা দিয়ে পোলাও মাংস রান্না করা আছে’।

উত্তেজনায় হাইরিয়ে হয়তো আরও কি কি রান্না করা আছে সেটাও বলতে চাচ্ছিল,তবে আমি সূযোগ না দিয়ে অন্য বিষয়ে কথা বলা আরম্ভ করলাম।‘বিয়েতে এত ঘটা হলে,
হাসান তো শুনবেই আর সে লোকজন নিয়ে গন্ডগোল করার সূযোগ নিশ্চয় ছাড়বে না।
বিয়ে তো দূরের কথা কোন কিছুই করা যাবে না,আমাদের সব চেষ্টাই পানিতে ভেসে যাবে,আর এনিষ্টের খুনীর কথা কি আমরা ভুলে যাচ্ছি?তোমাদের ভঁয় হচ্ছে না’?
‘ভঁয় পাচ্ছি না,মানে’?বলেই হাইরিয়ে কান্না আরম্ভ করলো।
‘কাউকে কিছু বলো না’,আমি বললাম,‘এনিষ্টেকে রাতের পোষাক দিয়ে বিছানায় শোয়াবে,
তবে এমন ভাবে যেন দেখে মনে হয় সে খুবই অসুস্থ।বিছানার পাশে ওষুধের বোতল আর পানির গেলাস থাকে যেন,জানালা সব বন্ধ থাকে যেন।ঘরে কোন বাতি না থাকে যেন,
পরিবেশটা এমন হবে যে এনিষ্টে অভিভাবক হিসাবে বিয়েতে যোগ দিতে পারে।বরযাত্রী বা আনুষ্ঠানিকতার কোন প্রশ্নই আসে না,শেষের দিকে আশে পাশের দুই একজন প্রতিবেশীকে ডাকা যেতে পারে।প্রতিবেশীদের কাছে এনিষ্টের শেষ ইচ্ছার কথা বলতে পার…,তবে কোন ভাবেই এটাতে হাসিখুশী আনন্দের কোন সুর যেন না থাকে।আমরা যদি কোন ভাবে এ ব্যাপারটার ঠিকমত সুরাহা না করতে পারি,তা হলে একই সাথে আমরাও সবাই শেষ হয়ে যাব,যারা ক্ষতি করার জন্যে বসে আছে তাদেরই জয় হবে,এটা নিশ্চয় বুঝতে পারছো’।

মাথা নেড়ে হাইরিয়ে আবার কান্না আরম্ভ করলো আর বেশী কিছু না বলে সাদা ঘোড়ায় চড়ে বিয়ের সাক্ষী জোগাড়ের জন্যে বের হলাম,হাইরিয়েকে বলে গেলাম সেকুরে যেন প্রস্তত থাকে,আমিও আসার সময় নাপিতের কাছে যাব।কথা বলার সময় সব কিছু ছবির মত ভেসে আসছিল অনেকটা যেন যুদ্ধের সময়কার একটা পরিস্থিতি।আমার বিশ্বাস আল্লাহ আমাকে প্রতি পদক্ষেপেই সাহায্য করবে,সবকিছুই আল্লাহর অনুগ্রহে যথাযথ ভাবে সম্পূর্ন হবে।এটা তো জানাই এই অনুভুতি যখন মনে আসবে,আল্লাহ তোমার উপর নজর রাখছে।

চার পাঁচটা পাড়া ছেড়ে ইয়াকুলটার এলাকার ইয়াশিন পাশার মসজিদের কালো দাঁড়িওয়ালা ইমামের সাথে দেখা করতে গেলাম,ইমাম তখন রাস্তার কুকুরগুলোকে ঝাড়ু দিয়ে তাড়াতে ব্যাস্ত।আমি তাকে আমার অসুবিধার কথা জানালাম,এটাও বললাম এনিষ্টের সময় প্রায় শেষ,তার ইচ্ছা মেয়ের বিয়েটা দিয়ে যেতে।আমি এনিষ্টের মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছি,
হাকিমের তালাকনামাও হয়ে গেছে।ইমাম বললো ইসলামী আইনমতে তালাকের পরে একটা মেয়েকে অন্তত এক মাস অপেক্ষা করতে হবে,আমি তাকে বললাম সেকুরের স্বামীর চার বছর আগে যুদ্ধ গিয়ে আর ফিরে আসে নি,ঐ একমাস অপেক্ষার কারণ সে গর্ভবতী কিনা,সেটার কোন দরকার নাই।

‘ইমাম সাহেব এই বিয়েতে কোন বাঁধা হওয়ার কারণ নাই,আমরা মামাতো ভাই বোন’।ইমামকে এটাও বললাম,পাড়ার উপস্থিত লোকজনের সামনে এই বাবা হারানো ছেলেদের,আর এক বিধবার পবিত্র কাজে সাহায্য করলে আল্লাহও খুশী হবে।ইমাম এফেন্দী সোনার মোহর নিয়ে ঠিকই কাজটা কি সম্পুর্ন করবে,পেশতা বাদাম আর আলু বোখারার পোলাও,মাংস কি খেয়ে কি একটু হাসাহসি করবে?
কাজটা করবে যদিও ইমাম এফেন্দী,তবে মনে হলো রাস্তার কুকুর তাড়ানো শেষ না করে সে যাচ্ছে না।মোহর নিয়ে ইমাম বললো,পোষাক বদলে কিছুক্ষনের মধ্যেই সে পৌঁছে যাবে অনুষ্ঠানে,ঠিকানা আর যাওয়ার রাস্তাটাও জিজ্ঞাসা করলো ইমাম সাহেব।যত তাড়াতাড়িই বিয়ে হোক না কেন-বারটা বছর যে বর অপেক্ষা করে ছিল,তার আকাশের অনেক কিছুই বদলে গেছে,বদলায়নি বিয়ের আগে চুল আর দাঁড়ি কাটার আনুষ্ঠানিকতার পর্বটা।নাপিতের দোকান আঁকসারায়,এনিষ্টের পুরোনো বাড়ীর কাছে,একসময় এনিষ্টে,সেকুরে ঐ পাড়ায় থাকতো।ইস্তাম্বুলের ফিরে আসার প্রথম দিনটায়,সেই দিন পাঁচেক আগে এই নাপিতের সাথে দেখা হয় আমার।আমাকে জড়িয়ে ধরে পুরোনো গুরুর মত ইস্তাম্বুলে ফেলে যাওয়া বার বছর নিয়ে সে আমাকে অনেক গল্পকথা উপদেশ দিতে ভুলে যায় নি।

বয়স হয়ে গেছে,ক্ষুর ধরা হাতটা দাঁড়ি কাটার সময় কাপছিল নাপিতের,গল্পে গল্পে বললো আজকাল আর মদ খায় না,আর বেশ সুন্দর চেহারার এক শিষ্য আছে তার।পুরোনো বেসিনটা তখন ঝুলছিল একই ভাবে,গরম পানি দিয়ে চুলটা ধূয়ে,ফসেটের পানি দিয়ে মুখটা ধুয়ে দিল আমার পুরোনো নাপিত।শিষ্যের ছোঁয়ায় দোকানের চেহারা সুরত বেশ বদলে গেছে,সবুজ একটা কোট ছিল তার গায়ে,যত দূর মনে পড়ে বার বছর আগেও এই কোটটাই পরে থাকতো সে,আমি অবশ্য একসময় সাবান আর দাঁড়ি কামানোর আনন্দে ভেসে গেলাম।ভাবছিলাম বিয়ে মানুষের জীবনে কত পরিবর্তনই আনে,শুধু তার কাজে না এমন কি চলনে,চিন্তাধারায়ও।

বেশ কিছুটা সময় কেটে গেছে,নাপিতের চেয়ারে ঝিমোতে ঝিমোতে ভাবছিলাম,অনেক যন্ত্রনা,টানাপোড়েন শেষ করে জীবনের আনন্দ পর্বের দিকে এখন যাওয়ার পালা আমার।
দুঃখ হচ্ছিল এনিষ্টের জন্যে,আমার এক সময়ের পচ্ছন্দের মানুষটা ছিন্ন ভিন্ন রক্তাত্ত শরীরে পড়ে আছে বাড়ীতে,ঐ বাড়ীর মনিব হবো আমিই আর ক দিন পরেই।নাপিতের দোকান থেকে বের হচ্ছি,দেখলাম বাইরে বেশ হৈচৈ আর চীৎকার,একপাশে দাঁড়িয়েঃসেভকেত।
স্বভাবজাত আত্মবিশ্বাস নিয়ে একটা চিরকূট দিল,সেভকেত,লেখা পড়ে আমার স্বপ্নের আগুনে কে যেন পানি ঢেলে দিলঃ
‘বরযাত্রী না আসলে বিয়ে হচ্ছে না,মনে রাখবে,সেকুরে’।
সেভকেতকে কোলে তুলে নিলাম,লেখার ইচ্ছা ছিল,‘প্রিয় সেকুরে,তুমি যা বলবে সেটাঈ হবে’।তবে নাপিতের দোকানে কাগজ কলমের জায়গা কোথায়।তাই অনেকটা হিসাব করে ফিসফিস করে ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার নানা কেমন আছে’?
‘নানা ঘুমাচ্ছে’।
মনে হলো,সেভকেত,আমার নাপিত,এমন কি অন্যান্যরা সবাই এনিষ্টের মৃত্যু নিয়ে কিছু একটা সন্দেহ করছে।সেভকেতকে জোর করে একটা চুমু দিলাম,বেশ রেগে সেভকেত দৌড়ে বাড়ীর দিকে চলে গেল।বিয়ের অনুষ্ঠানে ঈদের কাপড় পরেছিল সেভকেত,তবে আমার দিকে তাকিয়েছিল রাগে।সেকুরে তো ওর বাবার বাড়ী ছেড়ে যাচ্ছে না,আমাকেই ওদের বাড়ীতে যেতে হবে,আর বরযাত্রীর শোভাযাত্রাটা অবশ্যই দরকার।স্বাভাবিক ভাবেই আমার প্রতিপত্তিশালী বন্ধুবান্ধবদের সবাইকে ডেকে বলা সম্ভব ছিল না,যেন ঘোড়ায় সবাই গেটের সামনে দাঁড়ানো।তবু আমি আমার দুজন বন্ধুকে বললাম(একজন আমার মতই সরকারী কাজ করে,আরেকজন হাম্মামের মালিক),ওদের সাথে দেখা দিন পাঁচেক আগে,আর হ্যা আমার নাপিতকেও দাওয়াত করতে ভুলিনি,বিয়ের কথা শুনে সে কেঁদে কেঁদে আমাকে অনেক দোয়া করলো।

সাদা ঘোড়ায় সেকুরের বাড়ীর গেটে পৌছালাম,অনেকটা যেন সেকুরেকে একটা নতুন পরিচ্ছন্নতায় আরেক জীবনে বাড়ীতে নিয়ে যাচ্ছি।গেট খুলে দিল হাইরিয়ে,নিয়মমত নেমে ওর হাতে কিছু বখশিশ দিলাম।সেকুরের গায়ে ছিল একটা লাল কামিজ,গোলাপী ওড়না মাথা থেকে পায়ে ঝুলছিল(আমার সাথের আরেকটা সাদা ঘোড়ায় ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিল সেকুরে,শেষ মুহুর্তে তাড়াহুড়া হলেও নাপিত ঢোল আর বাশী জোগাড় করতে ভুলে যায়নি,
তেমন সুরেলা না হলেও সেটাতেই শুরু হলো বিয়ের শোভাযাত্রা।

ধীরে ধীরে বাড়ীর পর বাড়ীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল আমাদের শোভাযাত্রা,বুঝতে পারলাম চালাক সেকুরের সব কিছুই হিসেব করে করা।বিয়েটা পাড়াপড়শীরা সকলের যেন জানা থাকে,ভবিষ্যতে কোন ধরণের অভিযোগের উৎস যেন তৈরী না হয় কোনভাবে।তবে এটাও ঠিক এ ভাবে জানাজানি করে বিয়ে করে,সেকুরে তার স্বামীর আত্মীয়স্বজনের সাথে শত্রুতাটা আরো জোরালো করলো।আমার পরিকল্পনা ছিল,চুপচাপ বিয়েটা সেরে নিয়ে জানাজানির ব্যাপারটা পরে করতে,কিন্ত সেটা হলো না।

শোভাযাত্রার প্রথম দিকে ছিল রুপকথার পক্ষীরাজের মত আমার ঘোড়া,কিন্ত আমার মন ভরা উৎকন্ঠা,হাসান লোকজন নিয়ে কোথায় যে আঁত পেতে বসে আছে কে জানে,যে কোন সময় আক্রমন করতে পারে,বেস বেশ ভঁয়ে ভঁয়ে ছিলাম।বাড়ীর জানালা দিয়ে হাত বের করে লোকজন অভিনন্দন জানাচ্ছিল,তাদের তো আর জানা নাই কি ঝড়ঝাপটা বয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবনে।দেখলাম হিসেব,বুদ্ধি করে সেকুরের আগে থেকেই সব কিছু ঠিকঠাক করা ছিল,তালাক নেয়া,বিয়ে আর কায়দা করে পাড়াপড়শীদের সম্মতি নেয়ার ব্যাবস্থা করাটাও।সেটা বুঝতে পারলাম,পাড়ার সবজী ফলমুলের ব্যাবসায়ী এগিয়ে আমাদের সাথে বেশ কিছুদুর হেঁটে বললো,‘আল্লাহ তোমাদেরকে সুখী করুক’,দেখলাম রুটিওয়ালাও দোকান থেকে হাসি মুখে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানাতে ভুলেনি।কিন্ত আমার চোখ কান দুটোই খোলা ছিল, কোন কিছু একটা বিপদ থেকে প্রতিরক্ষার জন্যে।রাস্তার ছেলেমেয়েরা যারা বাজার থেকে আমাদের পেছনে টাকা নেয়ার জন্যে যখন ছোটাছুটি করছিল তাতেও কোন বিরক্তি হইনি,মেয়েদের হৈচৈ আর হাসাহাসিতে মনে হচ্ছিল,হৈচৈ ছোটাছুটি একভাবে আমাদের সাহায্যই করছে।

বেশ সর্তক হয়ে পর বাড়ীর দিকে ফিরে যাচ্ছি,মনটা ভঁরে ছিল সেকুরে আর তার মনের কান্নায়।সেকুরের দূর্ভাগ্য তার বাবার মৃত্যু দিনই তাকে বিয়ে করতো হলো,বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা আর হৈচৈ যা যে কোন মেয়ের স্বপ্ন,তাও জুটলো না সেকুরের ভাগ্যে,ঐ সাজনো সবকিছু দিয়ে লোক দেখানো ছাড়া আর কিছু না।আমার মনের রানী সেকুরের প্রাপ্য ছিল এর চেয়ে অনেক বেশী,তার প্রাপ্য ছিল রুপা দিয়ে সাজানো ঘোড়ার জিন,
সাথে সিল্কের কাপড় পড়া সওয়ারীর দল,গাড়ী গাড়ীতে ভরা উপঢৌকন।সেকুরের প্রাপ্য ছিল পাশা,সুলতানের মেয়েদের মত গাড়ী গাড়ী ভঁরা উপঢৌকন,আর গাড়ীতে হারেমের মেয়েরা যারা হাসাহাসি করে পুরোনো দিনের বিয়ের প্রাচুর্যতার কথা আলোচনা করছে।
কিন্ত সেকুরের বিয়েতে লাল পর্দা ঝুলানো পাল্কী নিয়ে চারজন লোক তো দূরের কথা, পাল্কী তো ছিলই না,এক জন লোকও ছিল না,শোভাযাত্রায় সোনা দামি পাথরে সাজানো ফলমুলের ঝুড়ি ছিল না,আনুষ্ঠানিক মোমবাতি নিয়ে যাওয়ার জন্যে কেউ ছিল না।আরও দুঃখ লাগলো,লোকের ভিড় না দেখে একসময় ঢোল আর বাশীটাও থেমে গেছে।দলের মধ্যে কেউ চীৎকার করে বলে নি,‘কনে আসছে’।বাড়ীর কাছাকাছি পৌঁছেই সেকুরেকে দেখে,খুব একটা মনমরা মনে হলো না।অন্যান্য যে কোন বরের মত সেকুরেকে ঘোড়া থেকে কোলে করে নামালাম,আনুষ্ঠানিক রীতিতে সেকুরের মাথায় অনেকগুলো রুপার মোহর ঢেলে দিলাম।ছেলেমেয়েরা যখন ছুটে মোহর নেয়ার জন্যে কাড়াকাড়ি করছে,তখন সেকুরে আর আমি বাড়ীতে ঢুকে গন্ধে একটু হতবাক হয়ে গেলাম।

লোকজনের ভিড় কমে গেছে,সেকুরে,মুরুব্বীরা,মহিলা,ছেলেমেয়েরা(অর্হান একপাশ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল),কেউ কোন কিছু সন্দেহ করেনি,কিন্ত আমার নাকে,রক্ত মাখানো কাপড়চোপড়,আর লাশের গন্ধ ভেসে আসছিল।হাইরিয়েকে এনিষ্টে এফেন্দীর কথা জিজ্ঞাসা করলাম,বাড়ীর মনিব হিসাবে ওটা তখন আমার দায়িত্বের মধ্যে।

‘আপনার কথামত তোষকে চাদর বদল করলাম,ঘরটা অন্ধকার করা আছে,আর কাপড় চোপড় পরে এনিষ্টে বিছানায় শুয়ে আছে,একটা কাথা দিতেও ভুলে যাইনি।বিছানার পাশে টেবিলে ওষুধ,পানির গ্লাস সব কিছুই আছে,যে গন্ধটা আসছে সেটা ঘর গরম করার গামলার জন্যে,আর কিছু না’,হাইরিয়ে একটু ভেজা গলায় উত্তর দিল।

হয়তো হাইরিয়ের অজান্তে দু এক ফোটা চোখের পানি রান্নার খাসির মাংসেও পড়ে গেছে, হাইরিয়ে কান্নার ধরণ দেখে বোঝা যাচ্ছিল এনিষ্টের সাথে তার সম্পর্কের গভীরতা,হয়তো তার চোখে ভেসে বেড়াচ্ছিল রাত্রের এনিষ্টের কথাগুলো।একপাশে দাঁড়িয়ে এসথার মুখের খাবার চিবাচ্ছিল।

‘সেকুরেকে খুশী রাখার চেষ্টা করো’,এসথার আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,‘ওর মত মেয়ে কজনের ভাগ্যে জোটে’।রাস্তা থেকে বাশীর শব্দ ভেসে আসছিল,অনেকটা আমার ইস্তাম্বুলে প্রথম দিন ফেরার স্মৃতি।ঐ সুরে শুধু দুঃখ কান্নায় ছড়ানো ছিল না,ছিল আনন্দের স্রোতের উচ্ছাস,বাশিটা কানে ভেসে আসলো আবার,ইমাম এফেন্দীর আমাদের বিয়ে পড়াচ্ছিল যখন।

হাইরিয়ে ঘরের বাতিটা একপাশে বেশ কায়দা করে রেখে দিতে ভোলেনি,এনিষ্টেকে দেখে বলা সম্ভব ছিল না,সে অসুস্থ না মারা গেছে।বিছানায় শোয়া এনিষ্টের শরীরটা হলও সেকুরের অভিভাবক,আমার নাপিত আর বাঁচাল এক পড়শী,দুজন বিয়ের সাক্ষী।অনুষ্ঠান শেষ হতেই বাঁচাল পড়শী এনিষ্টের সাথে হাত মেলানোর জন্যে এগিয়ে যেতেই,আমি ছুটে এনিষ্টের হাত ধরে চীৎকার করে বললাম,‘কোন চিন্তা করবেন না,ওস্তাদ এনিষ্টে।আমি সেকুরে আপনার নাতিদের সাধ্যমত আয়েসে রাখবো,কোনদিন কোন কষ্ট হবে না,তাদের’।

আমার কানটা এনিষ্টের মুখের কাছে নিয়ে তার কথা শোনার ভানও করলাম,যেন অসুস্থ ওষুধের প্রভাবের বুড়ো মানুষের ফিসফিস করে বলা কথা শুনছি,আমি।ইমাম এফেন্দী আর পড়শী বুড়ো লোকটা আমার ব্যাবহারে এতই খুশী হয়ে গেছে তখন,যে তারা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে গেছে,এখন নিশ্চয় আর কারও মনে সন্দেহ হওয়ার কথা না,খুনের ব্যাপারে আমি কোন ভাবে জড়িত নাই।
ঘরে বসে থাকা লোকজনকে বললাম,এনিষ্টে বেশ ক্লান্ত,একটু বিশ্রাম নিতে চাচ্ছে।সবাই পাশের ঘরে চলে গেল,যেখানে হাইরিয়ের পোলাও আর খাসির মাংস সাজানো ছিল(আমার কাছে এ অবস্থায় জিরা,ধনিয়া দেয়া মাংসের সাথে লাশের গন্ধের সাথে কোন তফাৎ ছিল না তখন)।বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দেখলাম সেকুরে মেয়েদের মাঝখানে বসে আছে,সেকুরেকে ডেকে বললামঃ‘তোমার বাবা ডাকছে।এখন আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে,
নিয়মমত বাবার হাতে চুমু দাও’।

০০০০০০০০০০০
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৩ রাত ১:৩৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কবিতাঃ হে বলবান

লিখেছেন ইসিয়াক, ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৪০

কে আছিস বলবান!
হ্ আগুয়ান।
দে সাড়া দে ত্বরা।
ধরতে হবে হাল,বাইতে হবে তরী, অবস্থা বেসামাল।

জ্বলছে দেখ প্রাণের স্বদেশ
বিপর্যস্ত আমার প্রিয় বাংলাদেশ।
মানবিকতা, মূল্যবোধ, কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতির বাতিঘর।
সর্বত্র আজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

জুলাইয়ের তথাকথিত আন্দোলন পুরোটা ছিল মেটিকিউলাস ডিজাইন

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:১৬

জুলাইয়ের তথাকথিত আন্দোলনের পুরোটা ছিল মেটিকিউলাস ডিজাইন

লালবদর নীলা ইস্রাফিল এখন বলছেন ও স্বীকার করছেন যে—
জুলাইয়ের সবকিছুই ছিল মেটিকিউলাস ডিজাইন।
মুগ্ধের হত্যাও সেই ডিজাইনের অংশ।

অভিনন্দন।
এই বোধোদয় পেতে দেড় বছর লাগলো?

আমরা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

তারেক ৩০০০ কোটী টাকার লোভেই দেশে ফিরেছে

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:১০



তারেক এসেছে, বলেছে, I have a plan; তারেকের প্ল্যানটা কি? এই মহুর্তে তার প্ল্যান হতে পারে, নমিনেশন বাণিজ্য করে কমপক্ষে ৩০০০ কোটি টাকা আয়। ৩০০ সীটে গড়ে ১০... ...বাকিটুকু পড়ুন

বই : টক অব দ্য টাউন

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:০৮

বই : টক অব দ্য টাউন



একটি বই হঠাৎ করে এতটা আলোচনায় আসবে আমরা কি ভাবতে পেরেছি ?
বাংলাদেশের মানুষ অতি আবেগপ্রবন , বর্তমান রাজনৈতিক অস্হিরতার মধ্যে ও
বাঙালীর স্বভাবসুলভ অনুসন্ধানী... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকার মানুষের জীবন

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪


ঢাকাতে মানুষ বড় বিচিত্র ভাবে বেঁচে থাকে। নিয়মিত ঢাকার রাস্তার ঘুরে বেড়ানোর কারণে এই রকম অনেক কিছু আমার চোখে পড়ে। সেগুলো দেখে মনে হয় মানুষ কত ভাবেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×