এই সম্পর্কীত পূর্ববর্তী আলোচনা সমূহঃ ছায়াতত্ত্ব-২ | ছায়াতত্ত্ব-১
খৃষ্টীয় সাত শতকের অজ্ঞানতার অন্ধকারে বসেও পূর্বেকার আলোচনায় আমরা পৃথিবীর একটি কক্ষপথ সম্পর্কে অবহিত হয়েছি। আমরা জেনেছি কোরআন যে তথ্য দেয় তা হলো সূর্য নয় পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে পরিভ্রমন করে। রাত ও দিনের পরিবর্তনের উপর জ্ঞানতত্ত্বের দাবী কোরআনের সর্বত্র চোখে পড়বার মত। প্রস্তাব করা হয়েছে, এ এক অন্যতম নিদর্শন ও নির্দেশ যা জ্ঞানবানদের জন্য আল্লহর মহিমা বুঝবার একটি সহজ উপায়। রাতের পর দিন আসছে এবং নির্ধারিত নিয়মে দিনরাত্রির পরিবর্তন হচ্ছে, এ অতি সাধারণ ঘটনাটিকে এত বৃহৎ করে দেখবার প্রয়োজন কোথায়- এ জিজ্ঞাসাটি মনের অজান্তেই এসে যেতে পারে। এ প্রশ্নের জবাব খোঁজার প্রচেষ্টাই আমরা করব এ প্রবন্ধে।
পৃথিবীর কক্ষের গতিমূলকে সামনে নিয়ে দাঁড়ালে দেখা যাবে যে সকালে ও সন্ধায় ছায়ারা ডানে ও বামে প্রলম্বিত হয়। আমরা কোরআনের আয়াতকে পাশাপাশি দাঁড় করালে দেখতে পাই যে, সূর্য কখনোই পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করছে না - ফলতঃ সূর্যকে প্রতিদিন সকালে পূর্বদিকে উদিত হতে ও পশ্চিমে অস্ত যেতে দেখার ঘটনাটি দৃশ্যতঃ সত্য বলে মনে হলেও, কোরআনিক তথ্যের ভিত্তিতে এর কোন স্বীকৃতি নেই। কোরআন কখনোই সূর্যের পৃথিবীকেন্দ্রীক উদয়-অস্তকে অনুমোদন করে না। অর্থাৎ আমরা যে সকাল ও সন্ধায় ছায়াদের প্রলম্বন হতে দেখছি, তা সূর্যের ঘূর্ণনের কারনে ঘটছে না, বরং অন্য কোন কারনে ঘটছে-- এই হল কোরআনের তথ্য নির্ভর অনুমোদন। কি হতে পারে সে কারনটি? আমাদের এ প্রশ্নের কেবলমাত্র একটি উত্তর থাকতে পারে। তা হলো সূর্য ও পৃথিবী ব্যবস্থা, যা কোরআন অনুমোদন করে এবং ইতিপূর্বে আমরা যার বিশ্লেষন দিয়েছি, তাতে আমরা দেখেছি যে সূর্য পৃথিবীকে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে আর পৃথিবী নিজ কক্ষে থেকে সূর্যকে প্রদক্ষিন করছে। আমরা সুস্পষ্টভাবেই হৃদয়ঙ্গম করতে পারি যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরার সময় কেবলমাত্র একটি পিঠে চিরকালই রাত এবং অপর পিঠে চিরকালই দিন থাকা উচিত ছিল। কিন্তু কার্যতঃ তা হচ্ছে না। আমরা দেখছি দিন ও রাত ধীরে ধীরে আসে ও ধীরে ধীরে বিগত হয়। একই সাথে ছায়ারা ধীরে ধীরে ছোট ও ধীরে ধীরে বড় হয়। আমাদের জানা আছে যে সূর্য প্রতিদিনের দিন-রাত ঘটাচ্ছে না, কারণ সকাল ও সন্ধায় যেভাবে সূর্যকে উদয়-অস্ত হতে দেখি সে কাজটি কখনোই সূর্য করছে না! তাহলে কেন দিনরাত ও ছায়াদের আকৃতি পরিবর্তনের ঘটনা ঘটছে - যেখানে কেবলমাত্র পৃথিবীর প্রদর্শীত পৃষ্ঠে স্থির সূর্য কিংবা স্থির ছায়া ব্যবস্থা হবার কথা ছিল? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা আমাদের প্রশ্ন হতে পেয়ে যাই যা হল, পৃথিবীর নিজস্ব বলয়ে এমন একটি গতি থাকতেই হবে যে গতিটি কক্ষপথের চলন হতে ভিন্ন এবং যে গতির কারনে পৃথিবীপৃষ্ঠে ধীরে ধীরে আলো প্রকাশিত হয় এবং ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়। এই গতিটি হতে হবে প্রতিদিনের, বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটবার মত একটি ঘূর্ণি গতি যা প্রতিদিন সকাল-সন্ধা সৃষ্টি করে ও ছায়াদের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটায়। মূলতঃ এই একটি মাত্র সিন্ধান্ত ছাড়া এখানে আর কোন সিদ্ধান্তই তৈরী করা সম্ভব নয়। কোরআন আমাদের বিকল্পহীনভাবেই গ্রহণ করতে নির্দেশ দেয় যে, কক্ষগতির বাইরে পৃথিবীর আরো একটি গতি থাকতেই হবে যা পৃথিবী কক্ষের ডানে কিংবা বামে প্রবাহমান! এই বাড়তি গতিটির কারনেই ছায়াদের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। সাত শতকের মানুষ যদি কোরআনের আয়াতকে সতর্কতার সঙ্গে বিশ্লেষন করত – তবে তারা পৃথিবীর কক্ষগতির সাথে সাথে পৃথিবীর যে আরও একটি বাড়তি গতি আছে যাকে আজ আমরা আহ্নিক গতি বলে জেনেছি, তারও সন্ধান লাভ করতে সক্ষম হত। পৃথিবীর যে একটি অক্ষঘূর্ণি থাকতে পারে তার আরও একটি তথ্য কোরআন পেশ করেছে আরও একটি ভিন্ন আয়াতে- “চলমান রাতের শপথ (৮৯।৪), চিন্তাশীল মানুষের জন্য ইহা একটি তথ্যপূর্ণ শপথ নয় কি? (৮৫:৫)"। আমরা দিনকে চলমান দেখতে পাই কারন সূর্যের স্থান পরিবর্তন হয়, ছায়ারা দৈর্ঘের তারতম্য ঘটায়। কিন্তু রাত চলমান হয় কিভাবে? রাতের আকাশে নক্ষত্রদের অবস্থানের পরিবর্তন দেখে এখানেও আমরা অনুভব করতে পারি যে রাতটিও চলমান।
কোরআনের আয়াত পৃথিবী কিংবা সূর্য সৃষ্টির কেন্দ্র নয় এই তথ্যকে যথার্থ বলিষ্ঠতায় প্রকাশ করেছে। ৩১:২৯, ৩৬:৩৮, ৩৬:৪০, ৫৫:৫ আয়াতগুলিকে পাশাপাশি সাজিয়ে আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি যে- কোরআন কেবল পৃথিবীর জন্য সূর্য কেন্দ্রিক ঘূর্ণনের ব্যবস্থাটি অনুমোদন করেছে। অর্থাৎ সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘোরে- এই শর্তটি পূরণ না হলে গন্তব্যপথে চলমান সূর্য কখনোই পৃথিবীর সাথে স্থান-কালের অপরিবর্তিত সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হত না। যে মুহূর্তে আমরা এ তথ্যটি পেয়ে যাই তার পাশেই ছায়ার প্রস্তাবগুলি আমরা বিশ্লেষন করলে দেখতে পাই, কক্ষঘূর্ণির পাশাপাশি পৃথিবীর একটি নিজস্ব অক্ষ ঘূর্ণি রয়েছে, যা ছায়াদের প্রলম্বন ও সংকোচনের দৃশ্যটি সৃষ্টি করতে পারে। এর পাশে যখন আমরা ৮৯:৪-৫) আয়াত দুটিকে এনে বিবেচনা করি তখন আমরা তথ্য পাই- রাতটিও চলমান; এই চলমান রাত পূর্ব আকাশের নক্ষত্রদেরকে পশ্চিম দিকে সঞ্চালিত হতে দেখায়। অন্যদিকে চলমান দিন ছায়াদেরকে উদয়কালে পশ্চিমদিকে ও অস্তকালে পূর্বদিকে প্রলম্বিত দেখায়। তথ্যগুলি পাশাপাশি সাজালে সহজেই বোঝা যায় যে, পৃথিবীর নিজস্ব শারিরীক ঘূর্ণি আছে, আর এই ঘূর্ণির গতি হলো পশ্চিম হতে পূর্ব দিকে। ফলতঃ দিনে ছায়া হচ্ছে আর ছায়দের বিদায়ের পর রাত হচ্ছে, রাতকে চলমান মনে হচ্ছে, এই দৃশ্যমান তথ্যগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার সূত্র বিরাজ করছে- এই তথ্যগুলিই মুলতঃ ১৬:৪৮, ২৫:৪৫, ৮৯:৪ ও ৮৯:৫ আয়াতসমূহ মানুষের অনুভবের দুয়ারে পৌঁছে দিতে চেয়েছে। আমরা বলতে পারি কোরআন একসাথে মাত্র গুটিকয়েক আয়াতে যে সব সন্ধান দিয়েছে তা হলোঃ
ক) সৃষ্টির সকল বস্তু নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমন করছে।
খ) চন্দ্র, সূর্য ও পৃথিবীর নিজস্ব কক্ষপথ রয়েছে। (যেহেতু তাদের কক্ষপথ রয়েছে সেহেতু তারা কোন না কোন কেন্দ্রকে মধ্যে রেখে তার চারপাশে ঘুরছে)।
গ) সূর্য নিজ কক্ষে ঘোরার সময় আরও একটি বাড়তি চলনের সাথে সংশ্লিষ্ট যা হলো সুর্যের গন্তব্য বা "মুশতাকার"। (যার বর্তমান বৈজ্ঞানিক পরিচয় হলো সোলার এপেক্স বা আলফা লাইরী নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে)।
ঘ) পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে।
ঙ) পৃথিবীর একটি নিজস্ব অক্ষ-চলন আছে যা পশ্চিম হতে পূর্বে গতিমূখী।
চ) পৃথিবীর এই অক্ষ-গতিটি প্রতিপালন ব্যবস্থার সাথে বিসংশ্লিষ্ট।
বিস্ময়করভাবে বিজ্ঞানের সকল প্রাপ্তিই এই কোরআনিক মডেলের সাথে সম্পূর্ণ এক ও অভিন্ন। উল্লেখ্য পৃথিবীর আর কোনো ধর্মগ্রন্থ কিংবা বিজ্ঞান নিজেও ছায়ার কার্যকরী ভূমিকা নিয়ে কোরআনের পূর্বে এমনকি দীর্ঘদিন পরেও কোনো মতবাদ প্রচার করেনি, কোরআনই কেবল এ প্রচারণার ক্ষেত্রে অনন্যতার দাবীদার। কোরআনের এই জ্ঞান-গাম্ভীর্য আমাদেরকে আবারো স্বরন করিয়ে দেয়- “এইগুলি কোরআনের নিদর্শন, যাহা তোমার প্রতিপালকের নিকট হইতে তোমার প্রতি অবতির্ণ হইয়াছে, তাহা সত্য (১৩:১)। বল তোমরা কোরআন বিশ্বাস কর আর নাই কর – যাহাদেরকে ইহার পূর্ণ জ্ঞনা দেওয়া হইয়াছে, তাহাদিগের নিকট যখনই ইহা পাঠ করা হয়, তখনই তাহারা সিজদায় লুটাইয়া পড়ে"(১৭:১০৭)"।
চাঁদ হল আমাদের সবচাইতে নিকটতম সহোদর। চাঁদ ও পৃথিবীর মধ্যে পার্থক্যটুকু এই যে চাঁদ একটি গ্রহকে আবর্তন করে যেখানে পৃথিবী একটি নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিন করছে। এইটুকু পার্থক্য ছাড়া সূর্য হতে দূরত্বে কিংবা প্রকৃতিতে (Characteristics) কিংবা সাদৃশ্যে চাঁদ পৃথিবীর অতি নিকটবর্তী সদস্য। চাঁদকে কোনমতে পৃথিবীর মধ্যাকর্ষন বলয় হতে ঠেলে দিতে পারলে চাঁদ একটি গ্রহ হিসেবে তার অবস্থান সুদৃঢ়তায় গড়ে নিতে সক্ষম। চাঁদের 'লক-ইন-মোশন' সম্পর্কে আমরা অনেকেই হয়তো জেনে থাকব। চাঁদ আজীবন পৃথিবীর প্রতি একটি মুখ প্রদর্শন করে আছে। চাঁদের যে পিঠটি আমরা দেখতে পাই- সবসময় তাকেই দেখি এবং কখনোই সম্ভব নয় যে চাঁদের অন্য পিঠটিতে কোন পৃথিবীবাসীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করা। চাঁদের এই গতিটি যদি পৃথিবীকে দান করা হতো তবে যা ঘটত তা হলো- চাঁদের মত পৃথিবীর আলোকিত পৃষ্ঠটি চিরদিন সূর্যের প্রতি মুখ করে থাকত। ফলতঃ এই আলোকিত পৃষ্ঠে ক্রমে ক্রমে উত্তাপ পূঞ্জিভূত হতে থাকত। এই উত্তাপের প্রকৃতি এমন হত যে ক্রমে ক্রমে তা বেড়েই চলত, এই ক্রমবর্ধিষ্ণু উত্তাপ হয়তো পৃথিবীর মাটিকে পুড়িয়ে তামার মত করে ফেলত, পদার্থরা টগবগ করে ফুটত পানির মতো। আর সেখানে আর একটি ঘটনা ঘটত - বস্তুর ছায়া সেখানে হত স্থির। এমতাবস্থায় সকাল কিংবা সন্ধা বলে কিছুই থাকত না। স্থির ছায়ার এই জগতে কেবল মৃত্যু ছাড়া অন্য কিছু প্রত্যক্ষ করার সুযোগ থাকত না। বুঝি হয়তো এমনি কোন বাস্তবতার প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে কোরআন ছায়ার প্রশঙ্গকে ডেকে এনেছে। বলতে চেয়েছে - “তুমি কি লক্ষ করনা কিভাবে তোমার প্রতিপালক ছায়াকে বিস্তৃত করেন? তিনি ইচ্ছা করিলে উহাকে নিশ্চল রাখিতে পারিতেন (২৫:৪৫)"। চাঁদের বাস্তবতার প্রতি ইঙ্গিতবহ এই আয়াত মূলতঃ আমাদেরকে আমাদের সবচাইতে প্রধান ও নিকটতম প্রতিবেশীর উদাহরণটি হতে শিক্ষা নেবার প্রতি ইঙ্গিত দেয়। জানিয়ে যায় - যে 'লক-ইন-মোশন' চাঁদকে দেয়া হয়েছে যদি তা-ই পৃথিবীকে প্রদান করা হতো তবে পৃথিবীর ছায়ারা ডানে কিংবা বাঁয়ে আর দিক পরিবর্তন করত না। এর ফলাফল হতো ভয়াবহ। জীবন নামক দূর্লভ বস্তু চিরদিনের জন্য পৃথিবী হতে উবে যেত। সম্ভবতঃ এই সত্যের প্রতি দৃষ্টি রেখে মানুষ কৃতজ্ঞ হোক – এটাই আল্লহ চান। তিনি মানুষকে বাস্তব প্রমান দিয়ে দেখিয়ে দিতে চান যে, পৃথিবীর প্রতিটি অস্তিত্ত্ব যারা ছায়া প্রকাশ করে- তাদের ছায়ারা ডানে বা বামে স্থান পরিবর্তন করার ভেতর দিয়ে প্রতিপালকের প্রতি সেজদাবনত হয়, অর্থাৎ ছায়ারা এই পৃথিবীর জীবনময় দুর্লভ পরিবেশ বজায় থাকার বিষয়ে একটি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপক প্রকাশ কিংবা নিদর্শন হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করে। ছায়াদের প্রতিটি স্থান পরিবর্তন যেন মূলতঃ এক একটি কৃতজ্ঞতার স্বীকারোক্তি এজন্য যে, একটি দুর্লভ ব্যবস্থায় ব্যবস্থিত হবার কারনেই কেবল ছায়ারা একটি সূক্ষ পরিমাণগত স্থান পরিবর্তনের নিয়ম পালন করে থাকে। পৃথিবীতে ছায়াদের স্থান বদলানোর ঘটনা যেখানে বিরাজমান, সেখানে এর সবচাইতে নিকটবর্তী সহোদরের জন্য স্থির ছায়ার ব্যবস্থাই হলো প্রকৃতিক ঘটনা। চাঁদে যা ব্যবস্থিত রয়েছে পৃথিবীতে তা নেই- এই করূণার কৃতজ্ঞতাপাশে বাঁধা পৃথিবীর প্রতিটি জড় পদার্থ ও উদ্ভিদ যেন ছায়াদের পরিবর্তনের সাথে সাথে স্রষ্টার কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করে কিংবা এদের প্রতিটি মুহূর্তের স্থান পরিবর্তন যেন প্রতিটি মূহুর্তেই স্রষ্টার প্রতি বিনীত কৃতজ্ঞতার পরিমাপক। আর এই তথ্যটিই যেন ১৬:৪৮ আয়াতটির বাণীজ্ঞাম্ভীর্যে প্রতিফলিত হয়। এই প্রতিফলন মানুষের অনুভূতিতে প্রথিত হোক পরম জ্ঞানে ও শ্রদ্ধায়, সে কারনেই বুঝি দয়াময় মানুষকে জানাতে চান- “সেজদা করে তাহারা আল্লহকে যখন তাহারা আবনত হয়"। সৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ ও বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ এই জীব ও জড়ের সেজদার প্রতি লক্ষ করে আল্লহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুক অনুভূতি আর প্রকৃত জ্ঞানের মাত্রায়, এই আয়াত প্রকারান্তরে আমাদেরকে এই নির্দেশটিই দিয়ে যায়। এখানে এই ঘটনার সাথে আরও একটি বিশেষত্ত্ব জরিয়ে রয়েছে যা প্রকাশ পেয়েছে ২৫:৪৫ আয়াতে। ছায়া যেভাবে সম্প্রসারিত করা হচ্ছে- তার সাথে আল্লহ তায়ালা নিজেকে প্রতিপালক হিসেবে পরিচয় দান করেছেন। ছায়াদের স্থান পরিবর্তন ব্যবস্থার সাথে যে জীব ও উদ্ভিদ জগতের তথা সমস্ত জীবকুলের প্রতিপালনের শর্তটি জড়িয়ে রয়েছে- এই আয়াত তারই প্রকাশক।
পৃথিবীর দিন-রাত্রি সংগঠিত হচ্ছে যে গতির কারনে তাকে আমরা আহ্নিক গতি বলে জেনেছি। এই দিন-রাত্রির পরিবর্তন এক সীমাহীন নিয়ামক। এই দিন-রাত্রির সৃষ্টি রহস্যে সমস্ত জীবকুলের ইতিহাস রচিত হয়েছে। জীবন ও জীবনময় পরিবেশ সৃষ্টির পেছনে এই দিন-রাত্রির সৃষ্টি এক বিকল্পহীন শর্ত। এই দিন-রাত্রি সূচিত হয় সেই দূর্বোধ্য চলন আহ্নিক গতি দ্বারা যা প্রকারান্তরে ছায়াসমূহকে ডানে ও বাঁয়ে চালিত করে কিংবা এদের পরিমাপক হয় এবং এদের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটায়। ঘুরিয়ে বললে বলতে হয়- এই ছায়াদের হ্রাস-বৃদ্ধি কিংবা ডানে-বাঁয়ে সঞ্চালনের মূলে জীবনের সকল রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। তাই এই ছায়াদের স্থান পরিবর্তনের বিষয়টি প্রতিপালন ব্যবস্থারই একটা বিধান প্রকাশক বিধায় ছায়া সম্প্রসারনের ভূমিকায় স্রষ্টা নিজেকে প্রতিপালক বিধান হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেছেন। তিনি ছায়াকে স্থির না রেখে জীবন ব্যবস্থাকে সুগম করেছেন এবং এই ছায়ারা তাঁর প্রতিপালন ব্যবস্থারই সাক্ষ্য দিচ্ছে- এ সত্যটিই কেবল ২৫:৪৫ আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। “অনন্তর আমরা সূর্যকে করিয়াছি ইহার নির্দেশক" এই আয়াতাংশও রবুবিয়াতের সম্প্রসারিত ব্যাবস্থার সাথে বিসংশ্লষ্ট। আমরা ছায়াদের সম্প্রসারনের দ্বারা জীবন প্রতিপালন ব্যবস্থার চিত্র পাই, আর এই চিত্রের মূলে যে অস্তিত্ত্বটি সকল জীবনীশক্তির যোগান দেয়- তা হলো কেবল সূর্য। সালোক্সংশ্লেষনে খাদ্যভান্ডার তৈরী না হলে জীবন কখনোই পৃথিবীতে টিকতে পারত না। আর এর পেছেনে যত কৃতিত্ব সবটাই হলো সূর্যের। 'অনন্তর আমরা সূর্যকে করিয়াছি ইহার নির্দেশক' – এই আয়াতাংশটি মূলতঃ রবুবিয়াতের প্রতিপালন ব্যবস্থায় আহ্নিক গতির হিসাব করা সঞ্চালনের সাথে খাদ্যভান্ডার তৈরীর বিষয়ে সূর্যের ভূমিকার প্রতিও ইঙ্গিতবহ। এই আয়াতাংশ ইঙ্গিতবহ পুরো সালোকসংশ্লেষন ব্যবস্থার! এই ব্যবস্থার একটি এবং একমাত্র নির্দেশক হল সূর্য- যার কোন বিকল্প হয় না, আর সূর্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হলো ছায়াদের পরিমিত ও নির্ধারিত স্থান পরিবর্তনের ঘটনা। এই ঘটনার সামান্য ব্যতিক্রম, সামান্য পরিবর্তন, সামান্য ক্রুটি এই সুন্দর পৃথিবীকে নারকীয় রাজ্যে পরিণত করে দিতে পারে। প্রতিপালক আল্লহ রব্বুল আলামিন সামান্য ছায়াদের প্রসঙ্গ টেনে জীবন প্রতিপালন ব্যবস্থার প্রতি এবং এর উপর সূর্যের ভূমিকার প্রতি ইঙ্গিত করে রেখেছেন- যা অতি বিষ্ময়কর প্রকাশ।
“তুমি কি লক্ষ করনা কিভাবে তোমার প্রতিপালক ছায়াকে বিস্তৃত করেন? তিনি ইচ্ছা করিলে উহাকে নিশ্চল রাখিতে পারিতেন। অনন্তর আমরা সূর্যকে করিয়াছি ইহার নির্দেশক (২৫ঃ৪৫)"। আপনি জানেন কি এরই মাঝে আরো কত ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত রয়ে গেছে? আপনি জানেন কি যে এর মধ্যে পৃথিবীর জীবনালো নির্বাপনের মহাদুর্যোগময় দুঃসংবাদ গোপনে আমাদেরকে বলে যায়- সাবধান! “আসন্ন ঘটনা আগত প্রায়(৫৩:৫৭) মহাপ্রলয় তো হঠাতই উপস্থিত হইবে(৬:৩১)”। ইনশআল্লহ যদি কখনো সুযোগ হয় তবে পরবর্তিতে 'কিয়ামত' অধ্যায়ে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
জিওসেন্ট্রিক কিংবা হেলিওসেন্ট্রিক তত্ত্ব যেখানে কেবলমাত্র সূর্য ও পৃথিবীর অবস্থান এবং কে কাকে ঘিরে প্রদক্ষিন করে এই মীমাংসায় পৌঁছার প্রয়াসে দুই-ই ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে কোরআন সামান্য ছায়ার প্রসঙ্গ টেনে সূর্য-পৃথিবী ব্যবস্থার শুধু সঠিক তথ্যই দেয়নি, তাদের সকল গতি চরিত্রকে বিজ্ঞানের সূক্ষতায় প্রকাশ করে রেখেছে। বিস্ময়করভাবে আল্লহপাক একটি ছায়ার প্রশঙ্গ দিয়ে এই পৃথিবীর অবস্থান ও গতি, সূর্যের গতি ও গন্তব্য, আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি, পৃথিবীতে জীবন ও সূর্যের সম্পর্ক এবং রবুবিয়াতের বিস্ময়কর প্রতিপালন ব্যবস্থায় এই গতিসমূহের ভূমিকা ইত্যাদি গুরুতর তথ্যগুলি একসাথে প্রকাশ করে রেখেছেন। ফলতঃ এ হলো অনেকগুলি তত্ত্বর এক সামষ্টিক চিত্র। আমরা (লেখক) এই তত্ত্বের কোরআনিক নামকরণ করতে চাই "ছায়াতত্ত্ব"।
এই 'ছায়াতত্ত্ব' আমাদেরকে জিয়োসেন্ট্রিক ও হেলিওসেন্ট্রিক তত্ত্বের ভুলগুলি কোথায় তা যেমন দেখিয়ে দেয়, সঠিক তত্ত্বটি কি হওয়া উচিত তাও জানিয়ে যায়। এই তত্ত্বে আজ হতে ১৫০০ বৎসর পূর্বে প্রকাশিত হয়েছিল যে, সূর্য বা পৃথিবী এদের কোনটিই মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়, তারা সকলেই নিজ কক্ষপথে ঘুরছে, পৃথিবীর ঘূর্ণি সূর্যকে কেন্দ্র করে, সূর্য ঘুরছে অন্য অজ্ঞাত কেন্দ্রের চারপাশে, সে নিজ গন্তব্যের দিকেও চলছে অদৃশ্যের তাড়নায়। চলছে সে তার সর্বশেষ পরিণতি সোলার এপেক্সের পানে, তার জন্য যা হলো "মুশতাকার" বা গন্তব্য; এমন এক গন্তব্য যেখানে তার মৃত্যুর ফাঁদ পাতা রয়েছে। এই সাথে 'ছায়াতত্ত্ব' আমাদেরকে আরো জানায় যে পৃথিবী কক্ষপথে চলার (বার্ষিক গতি) পাশাপাশি নিজ অক্ষেও ঘুরছে (আহ্নিক গতি); আর তার সূক্ষ পরিমাপ নির্ণীত রয়েছে এই পৃথিবীর সকল জীবনের অস্তিত্ত্বের সাথে। ছায়াতত্ত্বের আরো একটি নির্দেশ হল যে, সৃষ্টিকুল আল্লহর এই বিশাল করুণার স্বীকৃতি জ্ঞাপন করছে প্রতিটি মুহূর্তে ছায়াদের স্থান পরিবর্তনের সম্ভাব্যতাটিকে প্রদর্শিত করে।
“অতঃপর আমি উহাকে (ছায়া) আমার দিকে ধীরে ধীরে উঠাইয়া আনি (২৫:৪৬)"। আমরা ধীরে ধীরে ছায়াদের অন্তর্হিত হতে দেখি- তা আল্লহপাকের নিজের দিকে উঠাইয়া নেয়ার কথা বলা হল কেন? আমরা বুঝতে পারি, আল্লহ অদৃশ্যজাত এবং ছায়ারাও অদৃশ্য হয় সূর্যের অস্তগমনের পরে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- আমাদের দিকে উঠাইয়া আনি, এই প্রস্তাবের মূল বক্তব্য কি? সম্ভবতঃ এই – আলোকের প্রকাশই পৃথিবীতে বস্তুদের ছায়ার সৃষ্টি করে। ছায়াটি বাস্তব। এই বাস্তবতাটি কেবলমাত্র আলোকময় পরিবেশেই অবলোকনযোগ্য। অদৃশ্য আল্লহ, যিনি রবুবিয়াতের মহাব্যবস্থাকে এবং যিনি এতবড় ব্যবস্থাপনার সূচনা করেছেন একটি বাস্তব ছায়া ব্যবস্থাকে জুড়ে দিয়ে এবং যে ছায়াটির অস্তিত্ব সমস্ত পৃথিবী জোড়া 'রিযিক' বা সালোকসংশ্লষণের বাস্তবতার একমাত্র সূচক - সে ছায়াটি যেমন 'আলোক' না থাকলে অবলোকন করা যায় না, তেমনি কোরআনের আধ্যাত্মিক আলো না হলে আল্লহপাকের অস্তিত্বকে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব নয়। জ্ঞান বিহীনতার কারণে মানব মনে আল্লহ পাকের অস্তিত্বটি এমনি বিলীন হয়ে যায়। ছায়াকে দর্শন করার জন্য যেমন সূর্যের আলোকের প্রয়োজন হয় - তেমনি দয়াময়কে দর্শন করতে হলে হৃদয়কে সত্যের অর্থাৎ কোরআনের আলোকে উদ্ভাসিত করতে হবে একান্তভাবেই। মানুষ যেন বিনীত ছায়াদের দর্শন পূর্বক প্রকৃত বাস্তবতাটি উপলব্ধি করে আর ছায়াদের মতো বিনীত হয় জগতসমূহের প্রভু দয়াময় আল্লহ পাকের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
“কোরআন তোমাদিগের জ্ঞানচক্ষু হিসাবে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হইতে আসিয়াছে- সুতরাং যে ব্যক্তি উহা দেখিতে পাইল সে নিজেরই মঙ্গল সাধন করিল (৬:১০৫)। যখন কোরআন পাঠ করা হয়, উহা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর এবং (সম্মানস্বরূপ) চুপ করিয়া থাক। ইহাতে তোমরা অনুগৃহীত হইবে (৭:২০৪) বল তোমারা কোরআন বিশ্বাস কর কিংবা না কর- যাহাদেরকে ইহার পূর্ণ জ্ঞান দেওয়া হইয়াছে, তাহাদিগের নিকট যখনই ইহা পাঠ করা হয়, তখনই তাহারা বিনীত হইয়া সেজদায় লুটাইয়া পড়ে (১৭:১০৭)”।
পূর্ববর্তী আলোচনা সমূহ (উল্টাক্রমানুসারে):
- |আল কোরআনঃ এক রত্নভান্ডার - ৩ (ছায়াতত্ত্ব-২)
- আল কোরআনঃ এক রত্নভান্ডার - ২ (ছায়াতত্ত্ব)
- আল কোরআনঃ এক রত্নভান্ডার
----------------------------------------------------------------------------
>> আমার লেখাতে "আল্লাহ" এর পরিবর্তে "আল্লহ" লেখা হয়েছে। কারন মূল আরবি এর উচ্চারনে "লাম" কে মোটা করে উচ্চারন করতে হয়, আরবিতে "যবর" বা বাংলায় "আ-কার" উচ্চারন হয় না। "আল্লাহ" এর পরিবর্তে "আল্লহ" লিখলে সঠিক উচ্চারন সহজ হয়।
>> এটি কোরআনকে বিজ্ঞান দ্বারা বা বিজ্ঞানকে কোরআন দ্বারা প্রমাণ করার কোন চেষ্টা নয় বরং বিজ্ঞানের কল্যানে এখন পর্যন্ত অর্জিত জ্ঞান দ্বারা পবিত্র কোরআনের কিছু আয়াতকে বুঝবার চেষ্টা মাত্র।
>> এই সিরিজ লেখাটি মেজর কাজী জাহান মিয়া রচিত "আল-কোরআন দ্যা চ্যালেঞ্জঃ মহাকাশ পর্ব ১ ও ২" হতে সংগ্রহ করা হয়েছে। লেখাটি উক্ত বই থেকে প্রায় হুবহু তুলে দিয়েছি। পোষ্টের কলেবর সংক্ষিপ্ত রাখার উদ্দেশ্যে কিছু স্থানে সংক্ষেপ করা হয়েছে এবং মাঝে মাঝ আমি দু-একটা লাইন জুড়ে দিয়েছি, তবে আমার জুড়ে দেওয়া লাইনগুলো চিহ্নত করা হয়নি (আগামী পর্বগুলোতেও একই পদ্ধতি অনুসরন করা হবে)। আর এই সবই করা হয়েছে লেখকের অনুমতিক্রমে।
----------------------------------------------------------------------------
এই সম্পর্কীত পূর্ববর্তী আলোচনা সমূহঃ ছায়াতত্ত্ব-২ | ছায়াতত্ত্ব-১
খৃষ্টীয় সাত শতকের অজ্ঞানতার অন্ধকারে বসেও পূর্বেকার আলোচনায় আমরা পৃথিবীর একটি কক্ষপথ সম্পর্কে অবহিত হয়েছি। আমরা জেনেছি কোরআন যে তথ্য দেয় তা হলো সূর্য নয় পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে পরিভ্রমন করে। রাত ও দিনের পরিবর্তনের উপর জ্ঞানতত্ত্বের দাবী কোরআনের সর্বত্র চোখে পড়বার মত। প্রস্তাব করা হয়েছে, এ এক অন্যতম নিদর্শন ও নির্দেশ যা জ্ঞানবানদের জন্য আল্লহর মহিমা বুঝবার একটি সহজ উপায়। রাতের পর দিন আসছে এবং নির্ধারিত নিয়মে দিনরাত্রির পরিবর্তন হচ্ছে, এ অতি সাধারণ ঘটনাটিকে এত বৃহৎ করে দেখবার প্রয়োজন কোথায়- এ জিজ্ঞাসাটি মনের অজান্তেই এসে যেতে পারে। এ প্রশ্নের জবাব খোঁজার প্রচেষ্টাই আমরা করব এ প্রবন্ধে।
পৃথিবীর কক্ষের গতিমূলকে সামনে নিয়ে দাঁড়ালে দেখা যাবে যে সকালে ও সন্ধায় ছায়ারা ডানে ও বামে প্রলম্বিত হয়। আমরা কোরআনের আয়াতকে পাশাপাশি দাঁড় করালে দেখতে পাই যে, সূর্য কখনোই পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করছে না - ফলতঃ সূর্যকে প্রতিদিন সকালে পূর্বদিকে উদিত হতে ও পশ্চিমে অস্ত যেতে দেখার ঘটনাটি দৃশ্যতঃ সত্য বলে মনে হলেও, কোরআনিক তথ্যের ভিত্তিতে এর কোন স্বীকৃতি নেই। কোরআন কখনোই সূর্যের পৃথিবীকেন্দ্রীক উদয়-অস্তকে অনুমোদন করে না। অর্থাৎ আমরা যে সকাল ও সন্ধায় ছায়াদের প্রলম্বন হতে দেখছি, তা সূর্যের ঘূর্ণনের কারনে ঘটছে না, বরং অন্য কোন কারনে ঘটছে-- এই হল কোরআনের তথ্য নির্ভর অনুমোদন। কি হতে পারে সে কারনটি? আমাদের এ প্রশ্নের কেবলমাত্র একটি উত্তর থাকতে পারে। তা হলো সূর্য ও পৃথিবী ব্যবস্থা, যা কোরআন অনুমোদন করে এবং ইতিপূর্বে আমরা যার বিশ্লেষন দিয়েছি, তাতে আমরা দেখেছি যে সূর্য পৃথিবীকে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে আর পৃথিবী নিজ কক্ষে থেকে সূর্যকে প্রদক্ষিন করছে। আমরা সুস্পষ্টভাবেই হৃদয়ঙ্গম করতে পারি যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরার সময় কেবলমাত্র একটি পিঠে চিরকালই রাত এবং অপর পিঠে চিরকালই দিন থাকা উচিত ছিল। কিন্তু কার্যতঃ তা হচ্ছে না। আমরা দেখছি দিন ও রাত ধীরে ধীরে আসে ও ধীরে ধীরে বিগত হয়। একই সাথে ছায়ারা ধীরে ধীরে ছোট ও ধীরে ধীরে বড় হয়। আমাদের জানা আছে যে সূর্য প্রতিদিনের দিন-রাত ঘটাচ্ছে না, কারণ সকাল ও সন্ধায় যেভাবে সূর্যকে উদয়-অস্ত হতে দেখি সে কাজটি কখনোই সূর্য করছে না! তাহলে কেন দিনরাত ও ছায়াদের আকৃতি পরিবর্তনের ঘটনা ঘটছে - যেখানে কেবলমাত্র পৃথিবীর প্রদর্শীত পৃষ্ঠে স্থির সূর্য কিংবা স্থির ছায়া ব্যবস্থা হবার কথা ছিল? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা আমাদের প্রশ্ন হতে পেয়ে যাই যা হল, পৃথিবীর নিজস্ব বলয়ে এমন একটি গতি থাকতেই হবে যে গতিটি কক্ষপথের চলন হতে ভিন্ন এবং যে গতির কারনে পৃথিবীপৃষ্ঠে ধীরে ধীরে আলো প্রকাশিত হয় এবং ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়। এই গতিটি হতে হবে প্রতিদিনের, বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটবার মত একটি ঘূর্ণি গতি যা প্রতিদিন সকাল-সন্ধা সৃষ্টি করে ও ছায়াদের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটায়। মূলতঃ এই একটি মাত্র সিন্ধান্ত ছাড়া এখানে আর কোন সিদ্ধান্তই তৈরী করা সম্ভব নয়। কোরআন আমাদের বিকল্পহীনভাবেই গ্রহণ করতে নির্দেশ দেয় যে, কক্ষগতির বাইরে পৃথিবীর আরো একটি গতি থাকতেই হবে যা পৃথিবী কক্ষের ডানে কিংবা বামে প্রবাহমান! এই বাড়তি গতিটির কারনেই ছায়াদের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। সাত শতকের মানুষ যদি কোরআনের আয়াতকে সতর্কতার সঙ্গে বিশ্লেষন করত – তবে তারা পৃথিবীর কক্ষগতির সাথে সাথে পৃথিবীর যে আরও একটি বাড়তি গতি আছে যাকে আজ আমরা আহ্নিক গতি বলে জেনেছি, তারও সন্ধান লাভ করতে সক্ষম হত। পৃথিবীর যে একটি অক্ষঘূর্ণি থাকতে পারে তার আরও একটি তথ্য কোরআন পেশ করেছে আরও একটি ভিন্ন আয়াতে- “চলমান রাতের শপথ (৮৯।৪), চিন্তাশীল মানুষের জন্য ইহা একটি তথ্যপূর্ণ শপথ নয় কি? (৮৫:৫)"। আমরা দিনকে চলমান দেখতে পাই কারন সূর্যের স্থান পরিবর্তন হয়, ছায়ারা দৈর্ঘের তারতম্য ঘটায়। কিন্তু রাত চলমান হয় কিভাবে? রাতের আকাশে নক্ষত্রদের অবস্থানের পরিবর্তন দেখে এখানেও আমরা অনুভব করতে পারি যে রাতটিও চলমান।
কোরআনের আয়াত পৃথিবী কিংবা সূর্য সৃষ্টির কেন্দ্র নয় এই তথ্যকে যথার্থ বলিষ্ঠতায় প্রকাশ করেছে। ৩১:২৯, ৩৬:৩৮, ৩৬:৪০, ৫৫:৫ আয়াতগুলিকে পাশাপাশি সাজিয়ে আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি যে- কোরআন কেবল পৃথিবীর জন্য সূর্য কেন্দ্রিক ঘূর্ণনের ব্যবস্থাটি অনুমোদন করেছে। অর্থাৎ সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘোরে- এই শর্তটি পূরণ না হলে গন্তব্যপথে চলমান সূর্য কখনোই পৃথিবীর সাথে স্থান-কালের অপরিবর্তিত সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হত না। যে মুহূর্তে আমরা এ তথ্যটি পেয়ে যাই তার পাশেই ছায়ার প্রস্তাবগুলি আমরা বিশ্লেষন করলে দেখতে পাই, কক্ষঘূর্ণির পাশাপাশি পৃথিবীর একটি নিজস্ব অক্ষ ঘূর্ণি রয়েছে, যা ছায়াদের প্রলম্বন ও সংকোচনের দৃশ্যটি সৃষ্টি করতে পারে। এর পাশে যখন আমরা ৮৯:৪-৫) আয়াত দুটিকে এনে বিবেচনা করি তখন আমরা তথ্য পাই- রাতটিও চলমান; এই চলমান রাত পূর্ব আকাশের নক্ষত্রদেরকে পশ্চিম দিকে সঞ্চালিত হতে দেখায়। অন্যদিকে চলমান দিন ছায়াদেরকে উদয়কালে পশ্চিমদিকে ও অস্তকালে পূর্বদিকে প্রলম্বিত দেখায়। তথ্যগুলি পাশাপাশি সাজালে সহজেই বোঝা যায় যে, পৃথিবীর নিজস্ব শারিরীক ঘূর্ণি আছে, আর এই ঘূর্ণির গতি হলো পশ্চিম হতে পূর্ব দিকে। ফলতঃ দিনে ছায়া হচ্ছে আর ছায়দের বিদায়ের পর রাত হচ্ছে, রাতকে চলমান মনে হচ্ছে, এই দৃশ্যমান তথ্যগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার সূত্র বিরাজ করছে- এই তথ্যগুলিই মুলতঃ ১৬:৪৮, ২৫:৪৫, ৮৯:৪ ও ৮৯:৫ আয়াতসমূহ মানুষের অনুভবের দুয়ারে পৌঁছে দিতে চেয়েছে। আমরা বলতে পারি কোরআন একসাথে মাত্র গুটিকয়েক আয়াতে যে সব সন্ধান দিয়েছে তা হলোঃ
ক) সৃষ্টির সকল বস্তু নিজ নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমন করছে।
খ) চন্দ্র, সূর্য ও পৃথিবীর নিজস্ব কক্ষপথ রয়েছে। (যেহেতু তাদের কক্ষপথ রয়েছে সেহেতু তারা কোন না কোন কেন্দ্রকে মধ্যে রেখে তার চারপাশে ঘুরছে)।
গ) সূর্য নিজ কক্ষে ঘোরার সময় আরও একটি বাড়তি চলনের সাথে সংশ্লিষ্ট যা হলো সুর্যের গন্তব্য বা "মুশতাকার"। (যার বর্তমান বৈজ্ঞানিক পরিচয় হলো সোলার এপেক্স বা আলফা লাইরী নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে)।
ঘ) পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে।
ঙ) পৃথিবীর একটি নিজস্ব অক্ষ-চলন আছে যা পশ্চিম হতে পূর্বে গতিমূখী।
চ) পৃথিবীর এই অক্ষ-গতিটি প্রতিপালন ব্যবস্থার সাথে বিসংশ্লিষ্ট।
বিস্ময়করভাবে বিজ্ঞানের সকল প্রাপ্তিই এই কোরআনিক মডেলের সাথে সম্পূর্ণ এক ও অভিন্ন। উল্লেখ্য পৃথিবীর আর কোনো ধর্মগ্রন্থ কিংবা বিজ্ঞান নিজেও ছায়ার কার্যকরী ভূমিকা নিয়ে কোরআনের পূর্বে এমনকি দীর্ঘদিন পরেও কোনো মতবাদ প্রচার করেনি, কোরআনই কেবল এ প্রচারণার ক্ষেত্রে অনন্যতার দাবীদার। কোরআনের এই জ্ঞান-গাম্ভীর্য আমাদেরকে আবারো স্বরন করিয়ে দেয়- “এইগুলি কোরআনের নিদর্শন, যাহা তোমার প্রতিপালকের নিকট হইতে তোমার প্রতি অবতির্ণ হইয়াছে, তাহা সত্য (১৩:১)। বল তোমরা কোরআন বিশ্বাস কর আর নাই কর – যাহাদেরকে ইহার পূর্ণ জ্ঞনা দেওয়া হইয়াছে, তাহাদিগের নিকট যখনই ইহা পাঠ করা হয়, তখনই তাহারা সিজদায় লুটাইয়া পড়ে"(১৭:১০৭)"।
চাঁদ হল আমাদের সবচাইতে নিকটতম সহোদর। চাঁদ ও পৃথিবীর মধ্যে পার্থক্যটুকু এই যে চাঁদ একটি গ্রহকে আবর্তন করে যেখানে পৃথিবী একটি নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিন করছে। এইটুকু পার্থক্য ছাড়া সূর্য হতে দূরত্বে কিংবা প্রকৃতিতে (Characteristics) কিংবা সাদৃশ্যে চাঁদ পৃথিবীর অতি নিকটবর্তী সদস্য। চাঁদকে কোনমতে পৃথিবীর মধ্যাকর্ষন বলয় হতে ঠেলে দিতে পারলে চাঁদ একটি গ্রহ হিসেবে তার অবস্থান সুদৃঢ়তায় গড়ে নিতে সক্ষম। চাঁদের 'লক-ইন-মোশন' সম্পর্কে আমরা অনেকেই হয়তো জেনে থাকব। চাঁদ আজীবন পৃথিবীর প্রতি একটি মুখ প্রদর্শন করে আছে। চাঁদের যে পিঠটি আমরা দেখতে পাই- সবসময় তাকেই দেখি এবং কখনোই সম্ভব নয় যে চাঁদের অন্য পিঠটিতে কোন পৃথিবীবাসীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করা। চাঁদের এই গতিটি যদি পৃথিবীকে দান করা হতো তবে যা ঘটত তা হলো- চাঁদের মত পৃথিবীর আলোকিত পৃষ্ঠটি চিরদিন সূর্যের প্রতি মুখ করে থাকত। ফলতঃ এই আলোকিত পৃষ্ঠে ক্রমে ক্রমে উত্তাপ পূঞ্জিভূত হতে থাকত। এই উত্তাপের প্রকৃতি এমন হত যে ক্রমে ক্রমে তা বেড়েই চলত, এই ক্রমবর্ধিষ্ণু উত্তাপ হয়তো পৃথিবীর মাটিকে পুড়িয়ে তামার মত করে ফেলত, পদার্থরা টগবগ করে ফুটত পানির মতো। আর সেখানে আর একটি ঘটনা ঘটত - বস্তুর ছায়া সেখানে হত স্থির। এমতাবস্থায় সকাল কিংবা সন্ধা বলে কিছুই থাকত না। স্থির ছায়ার এই জগতে কেবল মৃত্যু ছাড়া অন্য কিছু প্রত্যক্ষ করার সুযোগ থাকত না। বুঝি হয়তো এমনি কোন বাস্তবতার প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে কোরআন ছায়ার প্রশঙ্গকে ডেকে এনেছে। বলতে চেয়েছে - “তুমি কি লক্ষ করনা কিভাবে তোমার প্রতিপালক ছায়াকে বিস্তৃত করেন? তিনি ইচ্ছা করিলে উহাকে নিশ্চল রাখিতে পারিতেন (২৫:৪৫)"। চাঁদের বাস্তবতার প্রতি ইঙ্গিতবহ এই আয়াত মূলতঃ আমাদেরকে আমাদের সবচাইতে প্রধান ও নিকটতম প্রতিবেশীর উদাহরণটি হতে শিক্ষা নেবার প্রতি ইঙ্গিত দেয়। জানিয়ে যায় - যে 'লক-ইন-মোশন' চাঁদকে দেয়া হয়েছে যদি তা-ই পৃথিবীকে প্রদান করা হতো তবে পৃথিবীর ছায়ারা ডানে কিংবা বাঁয়ে আর দিক পরিবর্তন করত না। এর ফলাফল হতো ভয়াবহ। জীবন নামক দূর্লভ বস্তু চিরদিনের জন্য পৃথিবী হতে উবে যেত। সম্ভবতঃ এই সত্যের প্রতি দৃষ্টি রেখে মানুষ কৃতজ্ঞ হোক – এটাই আল্লহ চান। তিনি মানুষকে বাস্তব প্রমান দিয়ে দেখিয়ে দিতে চান যে, পৃথিবীর প্রতিটি অস্তিত্ত্ব যারা ছায়া প্রকাশ করে- তাদের ছায়ারা ডানে বা বামে স্থান পরিবর্তন করার ভেতর দিয়ে প্রতিপালকের প্রতি সেজদাবনত হয়, অর্থাৎ ছায়ারা এই পৃথিবীর জীবনময় দুর্লভ পরিবেশ বজায় থাকার বিষয়ে একটি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপক প্রকাশ কিংবা নিদর্শন হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করে। ছায়াদের প্রতিটি স্থান পরিবর্তন যেন মূলতঃ এক একটি কৃতজ্ঞতার স্বীকারোক্তি এজন্য যে, একটি দুর্লভ ব্যবস্থায় ব্যবস্থিত হবার কারনেই কেবল ছায়ারা একটি সূক্ষ পরিমাণগত স্থান পরিবর্তনের নিয়ম পালন করে থাকে। পৃথিবীতে ছায়াদের স্থান বদলানোর ঘটনা যেখানে বিরাজমান, সেখানে এর সবচাইতে নিকটবর্তী সহোদরের জন্য স্থির ছায়ার ব্যবস্থাই হলো প্রকৃতিক ঘটনা। চাঁদে যা ব্যবস্থিত রয়েছে পৃথিবীতে তা নেই- এই করূণার কৃতজ্ঞতাপাশে বাঁধা পৃথিবীর প্রতিটি জড় পদার্থ ও উদ্ভিদ যেন ছায়াদের পরিবর্তনের সাথে সাথে স্রষ্টার কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করে কিংবা এদের প্রতিটি মুহূর্তের স্থান পরিবর্তন যেন প্রতিটি মূহুর্তেই স্রষ্টার প্রতি বিনীত কৃতজ্ঞতার পরিমাপক। আর এই তথ্যটিই যেন ১৬:৪৮ আয়াতটির বাণীজ্ঞাম্ভীর্যে প্রতিফলিত হয়। এই প্রতিফলন মানুষের অনুভূতিতে প্রথিত হোক পরম জ্ঞানে ও শ্রদ্ধায়, সে কারনেই বুঝি দয়াময় মানুষকে জানাতে চান- “সেজদা করে তাহারা আল্লহকে যখন তাহারা আবনত হয়"। সৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ ও বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ এই জীব ও জড়ের সেজদার প্রতি লক্ষ করে আল্লহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুক অনুভূতি আর প্রকৃত জ্ঞানের মাত্র
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১১ রাত ১১:২৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




