গ্রামের দরিদ্র, সুবিধা বঞ্চিত এবং প্রচলিত ধারায় ব্যাংক ঋণ পাওয়ার অযোগ্য মহিলাদের হাতে গত কয়েক বছর ধরে মোবাইল ফোন দিয়ে চলেছে গ্রামীণ টেলিকম। পলস্নীর জন্য বিশেষায়িত বলে সংযোগগুলোর নাম করন হয়েছে 'পলস্নী ফোন'। গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীন ব্যাংকের সহযোগী একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এর গড়া এরকম একাধিক প্রতিষ্ঠান বদলে দিচ্ছে দেশের তথ্য প্রযুক্তি'র পটভূমি। প্রমান করছে যে তথ্য প্রযুক্তি দিয়ে দারিদ্র বিমোচন সম্ভব।
গ্রামীণ ফোন ও গ্রামীণ টেলিকমের জন্ম একই সঙ্গে। এ প্রসঙ্গে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস তার বই "ব্যাংকার টু দি পুওর" এ জানিয়েছেন, 1994 সালের একদিন খালিদ (বর্তমানে গ্রামীণ টেলিকম এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক) আমার রম্নমে আসে এবং ইকবাল নামে একজন ইয়াং বাংলাদেশি বিজনেসম্যান এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। খালিদ আমাকে জানায় যে ইকবাল একটি আইডিয়া নিয়ে এসেছে। আমরা বাংলাদেশে মোবাইল ফোন অপারেটের জন্য লাইসেন্সের আবেদন করতে পারি। তাহলে আমরা দেশের গ্রামগুলোতে সেলুলার টেলিফোনের ব্যবহার শুরম্ন করতে পারবো।
তিনি জানান, এটা শোনার পরে আমার কাছে বাসত্দবসম্মত আইডিয়া মনে হয়েছিলো। কিন্তু আমরা তখনো জানতাম না কীভাবে একটি মোবাইল কোম্পানি চালু করতে হয়। আমরা এটা কিভাবে বাসত্দবসম্মত করবো তাও জানতাম না। যাইহোক এরই মধ্যে ইকবাল মোবাইল কোম্পানি বিষয়ে তার হোম ওয়ার্ক সম্পন্ন করে এবং আমি তাকে একজন স্মার্ট বিজনেসম্যান হিসেবে এই আইডিয়া সফল করার সময় দেই। অবশেষে 1996 সালে বাংলাদেশ সরকার তিনটি মোবাইল লাইসেন্স প্রদান করে, যার একটি আমরা পাই। উক্ত বছরের 11 নভেম্বর আমরা লাইসেন্স এগ্রিমেন্টে সই করি এবং 1997 সালের 26 মার্চ থেকে আমাদের সেবা শুরম্ন করার ঘোষনা দেই। বাংলাদেশের একেবারে হত দরিদ্র থেকে সকল ধরনের মানুষের জন্য চালু করা এই সেবা 26 মার্চ শুরম্ন করাটাই উচিত বলে মনে করেছিলাম আমরা।
প্রফেসর ইউনূস তার বইতে আরো জানিয়েছেন, আমরা সে সময় দুইটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান তৈরি করি। একটি গ্রামীণ ফোন (লাভজনক) এবং অপরটি গ্রামীণ টেলিকম (অলাভজনক)। গ্রামীণ ফোন একটি কনসোর্টিয়াম যার পার্টনার ছিলো চারটি প্রতিষ্ঠান (এখন দুইটি প্রতিষ্ঠান)। গ্রামীণ টেলিকমও গ্রামীণ ফোনের অন্যতম পার্টনার।
এভাবে শুরম্ন হয় গ্রামীণ ফোন ও গ্রামীণ টেলিকমের যাত্রা। দেশের প্রত্যনত্দ অঞ্চলে স্বল্প খরচে টেলিকম সেবা দিতে গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীণ ফোনের কাছ থেকে বাল্ক টক টাইম ক্রয় করে। এরপর তা গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণীদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করে। গ্রামীণ ব্যাংকের যেসব ঋণী মোবাইল ফোনগুলো দিয়ে ব্যবসা করে তাদের বলা হয় 'টেলিফোন-লেডি'। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণী লায়লা বেগম ছিলো বাংলাদেশের প্রথম টেলিফোন লেডি।
1997 সালে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের টেলিফোন ডেনসিটি ছিলো সবচেয়ে কম। 120 মিলিয়ন মানুষের দেশে তখন টেলিফোন ছিলো মাত্র 40 হাজার। এসব সেটের বেশিরভাগই ছিলো ঢাকা শহর ও তার আশেপাশে এবং অনেক সেটই দিনের পর দিন নষ্ট থাকতো। তখন টেলিফোন ছিলো ৰমতা এবং আভিজাত্যের প্রতিক। মানুষ টেলিফোন সেটের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করে বছর খানেক অপেৰা করতো এবং ভাগ্য ভালো থাকলে একটি সেট পেতো।
যাইহোক জন্মের পরবতর্ী চার বছরে গ্রামীণ ফোন সারা দেশে 4 লাখ মোবাইল ফোন গ্রাহক তৈরির টার্গেট করে। তাদের এই টার্গেট অনেকটাই সফল ছিলো। 2001 সালে গ্রামীন ফোনের কল রেট ছিলো বিশ্বের যেকোন দেশের মোবাইল কল রেটের চেয়ে সাশ্রয়ী। সেসময় পিক আওয়ারে প্রতি মিনিট কল রেট ছিলো 9.0 ইউএস সেন্টস এবং অফপিকে এই কলরেট ছিলো 6.7 সেন্টস প্রতি মিনিট।
মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রথম থেকেই গ্রামীন টেলিকমের মোবাইল কলরেট গ্রামীণ ফোনের স্বাভাবিক কল রেটের চেয়ে প্রায় 50 শতাংশ কম। বিশেষায়িত এই মোবাইল নাম্বারগুলো জোন ভিত্তিক এবং শুধুমাত্র গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণীরাই ব্যবসা করার শর্তে এসব নাম্বার কিনতে পারে। তারা সংযোগসহ সেটের মূল্য কিসত্দির মাধ্যমে এক বছর সময়ের মধ্যে পরিশোধ করে। একটি এলাকায় কোন কোন ঋনী টেলিফোন-লেডি হবে তা নির্ধারন করে গ্রামীণ ব্যাংক। বিক্রিত সংযোগগুলো দিয়ে ব্যবসার বাইরে অন্য কোন কাজে লাগানো হচ্ছে কিনা তা তদারকির দ্বায়িত্বেও রয়েছে গ্রামীণ ব্যাংক।
2006 সালের নভেম্বরে এসে গ্রামীণ ফোনের গ্রাহক হয়েছে প্রায় 95 লাখ। এ বছর প্রথম নয় মাসে গ্রামীণফোনের মোট মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে 47 কোটি 80 লাখ ডলার। তবে চলতি বছরই তারা নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছে 20 কোটি 70 লাখ ইউএস ডলার। বর্তমানে গ্রামীণ টেলিকমেরও আছে 2 লাখ 53 হাজার মোবাইল গ্রাহক যা টেলিফোন লেডিদের দ্বারা পরিচালিত। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতি 10 জন মানুষের একজনের মোবাইল ফোন আছে। এ প্রসঙ্গে গ্রামীণ টেলিকম এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর খালিদ শামস এক বিবৃতিতে জানান, গ্রামাঞ্চলে তথ্য ও যোগাযোগ ভিত্তিক প্রযুক্তি প্রচলনের দায়িত্ব নিয়ে গ্রামীণ টেলিকমের পলস্নী ফোন কর্মসুচী দেশে এক নীরব বিপস্নব ঘটিয়েছে। আনত্দর্জাতিক কল করার সুবিধাসহ সব ধরনের সংযোগসহ পলস্নী ফোনগুলো পুরো বিশ্বকে এক একটি গ্রামের সাথে সংযুক্ত করেছে।
ইউনূসের চিনত্দা ধারা সবসময়ই সুদুর প্রসারী। আর তার প্রমান মেলে 'ব্যাংকার টু দি পুওর' বইটিতে। 2001 সালে প্রকাশিত বইটিতে তিনি জানিয়েছেন, এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে ভবিষ্যতেও টেলিফোন লেডিরা শুধু ফোন ব্যবসাই করবে। প্রযুক্তি এবং এনার্জি সোর্সের যে ক্রমবর্ধমান পরিবর্তন হচ্ছে তাতে একসময় পলস্নী অঞ্চলেও পৌঁেছ যাবে ইন্টারনেট। তখন টেলিফোন লেডিরা সাধারন মানুষদের অর্থের বিনিময়ে ফ্যাক্স, ই-মেইল, ইন্টারনেট ইত্যাদি সেবা দেবে। যা পরিণত হবে ডোর টু ডোর কমিউনিকেশন সেন্টারে। এভাবে ফোন লেডিরা টেকনোলজি ব্যবসার মধ্যেই থাকবে।
2006 সালে এসে ইউনূসের ভবিষ্যতবানীর বাসত্দব পরিস্ফুটন হতে চলেছে। সম্প্রতি সারা দেশে 500 কমিউনিটি তথ্যকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে গ্রাম পর্যায়ে সসত্দায় ইন্টারনেট সুবিধা দেবার ঘোষনা দিয়েছে গ্রামীণফোন। এর ফলে প্রথমবারের মতো দেশে দুই কোটি মানুষ ইন্টারনেট সুবিধার আওতায় আসতে পারবে। জিএসএম অ্যাসোসিয়েশনের উন্নয়ন তহবিলের সাথে তথ্যকেন্দ্র স্থাপনে পরীৰামূলক সফলতার পর গ্রামীণফোন 2006 সালের মধ্যেই সারা দেশে কমিউনিটি তথ্যকেন্দ্র স্থাপনে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের নিয়ে যৌথভাবে কাজ শুরম্ন করবে।
এ প্রসঙ্গে গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এরিক অস বার্তাসংস্থাকে জানায়, পরীৰামূলক প্রকল্পের মাধ্যমে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, দেশের গ্রাম পর্যায়ে ইন্টারনেটের ব্যাপারে যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদা পূরণের জন্য মোবাইল নেটওয়ার্ক হচ্ছে উৎকৃষ্ট উপায়। আমাদের তথ্যকেন্দ্রগুলো ইন্টারনেটকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সামর্থের মধ্যে নিয়ে আসবে। এর মাধ্যমে স্থানীয় উদ্যোক্তাদেরও ভালো আয়ের ব্যবস্থা হবে। ইন্টারনেটের ব্যাপক বিসত্দার বাংলাদেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রভাব ফেলবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
স্থানীয় উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে পরিচালিত প্রত্যেকটি তথ্যকেন্দ্রের কম্পিউটারের সাথে গ্রামীণফোনের বিদ্যমান জিএসএম মোবাইল নেটওয়ার্কের সংযোগ থাকবে। তথ্য সঞ্চালনের গতি প্রতি সেকেন্ডে 128 কিলোবাইটে উনি্নত করতে ইডিজিই প্রযুক্তির মাধ্যমে এটিকে আরও উন্নত করে তোলা হবে। প্রত্যেকটি উপজেলায় এই তথ্যকেন্দ্র এমন ভাবে স্থাপন করা হবে যাতে আশপাশের 15 টি গ্রামের 40 হাজার বাসিন্দার মধ্যে ইন্টারনেট সুবিধা পেঁৗছে দেওয়া যায়।
জিএসএমএ'র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রব কনওয়ে বার্তাসংস্থাকে জানান, গ্রামীণ ফোন জিএসএম মোবাইল প্রযুক্তির যে যুগানত্দকারী ব্যবহার দেখিয়েছে তাতে উন্নয়নশীল বিশ্বে শত শত কোটি মানুষের কাছে ইন্টারনেট ও ই-মেইল সুবিধা পৌছে দেওয়ার ৰেত্রে বাংলাদেশ একটি মর্যাদাপূর্ণ নাম হিসেবে আবিভর্ূত হয়েছে। এ বিষয়টি ফিক্সড টেলিফোন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সম্ভব ছিল না।
বাংলাদেশের লোকজন ব্যবসায়িক এবং ব্যক্তিগত বিভিন্ন প্রয়োজনে এসব তথ্যকেন্দ্রে আসে। তারা স্বাস্থ্য ও কৃষি সম্পর্কিত তথ্য এবং সরকারি সেবাসহ বিদেশে অবস্থানকারী তাদের আত্মীয়-স্বজনের সাথে ভিডিও কনফারেন্সিং করে থাকে। কীভাবে ই-মেইল একাউন্ট খুলতে হয় এবং ইন্টারনেটের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হয় গ্রামীণফোন সে বিষয়টি জনগণকে জানানোর জন্য উদ্যোক্তাদের প্রশিৰণ দিয়ে থাকে। ইন্টারনেট ব্যবহারের বিনিময়ে গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে যতদূর সম্ভব কম টাকা রাখার জন্য উদ্যোক্তারা গ্রামীণফোনের অন্যান্য সেবার ব্যবস্থাও রাখেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে পেফোন এবং প্রিপেইড মোবাইল একাউন্ট রিচার্জ করার ব্যবস্থা।
2006 সালে শানত্দির জন্য নোবেল পুরষ্কার পেয়েছে প্রফেসর ড. ইউনূস। বিশ্বের কাছে আরেকবার মাথা উঁচু করে দাড়িয়েছে বাংলাদেশ। দারিদ্র বিমোচনে তথ্য প্রযুক্তি'র ব্যবহারের উৎকৃষ্ট উদাহরন গ্রামীণ ফোন ও গ্রামীণ টেলিকম। বাংলাদেশের মোবাইল খাতেও ইউনূস একজন পাইওনিয়ার। শুভেচ্ছা প্রফেসর মুহম্মদ ইউনূসকে। ( লেখক: মো. আরাফাতুল ইসলাম )
ঃঃ দৈনিক ইত্তেফাক ঃ 06.11.2006 ঃঃ
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



