আমরা তিন বাল্যসঙ্গী যে ঘরে শয়ন করিতাম তাহার পাশের ঘরের দেয়ালে একটি আস্ত নরকঙ্কাল ঝুলানো থাকিত । রাত্রে বাতাসে তাহার হাড়গুলা খট্খট্ শব্দ করিয়া নড়িত । দিনের বেলায় আমাদিগকে সেই হাড় নাড়িতে হইত । আমরা তখন পণ্ডিত-মহাশয়ের নিকট মেঘনাদবধ এবং ক্যাম্বেল স্কুলের এক ছাত্রের কাছে অস্থিবিদ্যা পড়িতাম । আমাদের অভিভাবকের ইচ্ছা ছিল আমাদিগকে সহসা সর্ববিদ্যায় পারদর্শী করিয়া তুলিবেন । তাঁহার অভিপ্রায় কতদূর সফল হইয়াছে যাঁহারা আমাদিগকে জানেন তাঁহাদের নিকট প্রকাশ করা বাহুল্য এবং যাঁহারা জানেন না তাঁহাদের নিকট গোপন করাই শ্রেয় ।
তাহার পর বহুকাল অতীত হইয়াছে । ইতিমধ্যে সেই ঘর হইতে কঙ্কাল এবং আমাদের মাথা হইতে অস্থিবিদ্যা কোথায় স্থানান্তরিত হইয়াছে অন্বেষণ করিয়া জানা যায় না ।
অল্পদিন হইল একদিন রাত্রে কোনো কারণে অন্যত্র স্থানাভাব হওয়াতে আমাকে সেই ঘরে শয়ন করিতে হয় । -অনভ্যাসবশত ঘুম হইতেছে না । এপাশ ওপাশ করিতে করিতে গির্জার ঘড়িতে বড়ো বড়ো ঘন্টাগুলো প্রায় সব কটা বাজিয়া গেল । এমন সময়ে ঘরের কোণে যে তেলের সেজ জ্বলিতেছিল সেটা প্রায় মিনিট পাঁচেক ধরিয়া খাবি খাইতে খাইতে একেবারে নিবিয়া গেল । ইতিপূর্বেই আমাদের বাড়িতে দুই-একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে । তাই এই আলো নেবা হইতে সহজেই মৃত্যুর কথা মনে উদয় হইল। মনে হইল এই-যে রাত্রি দুই প্রহরে একটি দীপশিখা চিরান্ধকারে মিলাইয়া গেল , প্রকৃতির কাছে ইহাও যেমন আর মানুষের ছোটো ছোটো প্রাণশিখা কখনো দিনে কখনো রাত্রে হঠাৎ নিবিয়া বিস্মৃত হইয়া যায় , তাহাও তেমনি ।
ক্রমে সেই কঙ্কালের কথা মনে পড়িল । তাহার জীবিতকালের বিষয় কল্পনা করিতে করিতে সহসা মনে হইল, একটি চেতন পদার্থ অন্ধকারে ঘরের দেয়াল হাতড়াইয়া আমার মশারির চারি দিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে , তাহার ঘন ঘন নিশ্বাসের শব্দ শুনা যাইতেছে । সে যেন কী খুঁজিতেছে , পাইতেছে না, এবং দ্রুততর বেগে ঘরময় প্রদক্ষিণ করিতেছে । নিশ্চয় বুঝিতে পারিলাম, সমস্তই আমার নিদ্রাহীন উষ্ণ মস্তিষ্কের কল্পনা এবং আমারই মাথার মধ্যে বোঁ বোঁ করিয়া যে রক্ত ছুটিতেছে তাহাই দ্রুত পদশব্দের মতো শুনাইতেছে । কিন্তু, তবু গা ছম্ছম্ করিতে লাগিল । জোর করিয়া এই অকারণ ভয় ভাঙিবার জন্য বলিয়া উঠিলাম , “ কেও। ” পদশব্দ আমার মশারির কাছে আসিয়া থামিয়া গেল এবং একটা উত্তর শুনিতে পাইলাম , “ আমি । আমার সেই কঙ্কালটা কোথায় গেছে তাই খুঁজিতে আসিয়াছি । ”
আমি ভাবিলাম , নিজের কাল্পনিক সৃষ্টির কাছে ভয় দেখানো কিছু নয় — পাশবালিশটা সবলে আঁকড়িয়া ধরিয়া চিরপরিচিতের মতো অতি সহজ সুরে বলিলাম , “ এই দুপুর রাত্রে বেশ কাজটি বাহির করিয়াছ । তা , সে কঙ্কালে এখন আর তোমার আবশ্যক ? ”
অন্ধকারে মশারির অত্যন্ত নিকট হইতে উত্তর আসিল , “ বল কী । আমার বুকের হাড় যে তাহারই মধ্যে ছিল । আমার ছাব্বিশ বৎসরের যৌবন যে তাহার চারি দিকে বিকশিত হইয়াছিল — একবার দেখিতে ইচ্ছা করে না ? ”
আমি তৎক্ষণাৎ বলিলাম , “ হাঁ , কথাটা সংগত বটে । তা , তুমি সন্ধান করো গে যাও । আমি একটু ঘুমাইবার চেষ্টা করি । ” (চলবে)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



