অনেকে মনে করেন পুতুল নাচ থেকে নাট্য সাহিত্যের উৎপত্তি হয়েছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন ছায়া-নৃত্য থেকেই এর উৎপত্তি।
বাংলা নাটকের উদ্ভব দুইশত বৎসরেরও পূর্বে। পাশ্চাত্য রঙ্গমঞ্চের অনুকরণে বাংলা রঙ্গমঞ্চ স্থাপিত হওয়ার ফলেই বাংলা নাটক বিদেশী নাটকের মৌল-ধর্ম, অবলম্বন করেই আত্মপ্রকাশ করেছে। ১৮৯২ খৃ: বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম মৌলিক দু’খানি নাটক “কীর্তিবিলাশ” ও “ভদ্রার্জুন” রচিত হয়। যোগেশ চন্দ্র গুণের “র্কীতিবিলাশ” বিষদাত্মক নাটক আর তারাশংকর শিকদারের “ভদ্রার্জুন” মিলনাত্মক নাটক, উভয় নাটকই পাশ্চাত্য নাট্য রীতির অনুসরণে লিখিত।
মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিকে আমরা রক্তাক্ত প্রান্তর ও কবর নাটকের মধ্য দিকে বাংলা নাটকের সাথে পরিচিত হই। এই পোষ্টে আমি বাংলা সাহিত্যের ৫ টি বিখ্যাত নাটক নিয়ে আলোচনা করব যেগুলোর নাম কম বেশি সকলেই জানি।
১। রক্তকরবী - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'রক্তকরবী' বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ নাটক। নাটকটি বাংলা ১৩৩০ সনের শিলং-এর শৈলবাসের সময়ে রচিত। তখন এর নামকরণ ছিল 'যক্ষপুরী'। রক্তকরবী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাংকেতিক নাটক। মানুষের অসীম লোভ কীভাবে জীবনের সব সৌন্দর্য ও স্বাভাবিকতাকে অস্বীকার করে মানুষকে নিছক যন্ত্র ও উৎপাদনের প্রয়োজনীয় উপকরণে পরিণত করেছে এবং এর ফলে তার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ কীরূপ ধারণ করেছে এরই প্রতিফলন ঘটেছে এ নাটকটিতে। এ নাটকের সংক্ষিপ্ত কাহিনী- যক্ষপুরীর রাজার রাজধর্ম প্রজা-শোষণ; তার অর্থলোভী দুর্দম। তার সে লোভের আগুনে পুড়ে মরে সোনার খনির কুলিরা। রাজার দৃষ্টিতে কুলিরা মানুষ নয় তারা স্বর্ণলাভের যন্ত্রমাত্র, তারা ৪৭ক, ২৬৯ফ মাত্র, যক্ষপুরীর লোহার জালের বাইরে প্রেম ও সৌন্দর্যের প্রতীক নন্দিনী সবাইকে হাতছানি দিয়ে ডাকল; এক মুহূর্তে মুক্ত জীবনানন্দের স্পর্শে সবাই চঞ্চল হয়ে উঠল। প্রেম ও সৌন্দর্যকে এভাবে লাভ করা যায় না। তাই রাজা নন্দিনীকে পেয়েও পাননি।
২। কৃষ্ণকুমারী - মাইকেল মধুসূদন দত্ত

মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ট্রাজেডি নাটক/ নাটকটি ১৮৬০ সালে রচিত হলেও প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের কৃষ্ণকুমারী নাটকে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন কৃষ্ণকুমারী নিজে/। রাজা ভীম সিংহ এর কন্যা ষোড়শী রূপবতী কন্যা কৃষ্ণকুমারীকে বিয়ে করার জন্য রেডি মানসিংহ ও জগৎসিংহের । কৃষ্ণকুমারী রূপে গুণে অনন্য। তার একটি চিত্রপট দেখে জগৎসিংহ তাকে বিবাহ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। ধনদাসের মাধ্যমে ভীমসিংহের কাছে রাজা জগৎসিংহ কৃষ্ণার বিবাহের পয়গাম পাঠান। নাটকের মূল বিষয়বস্তু হল কৃষ্ণকুমারীর নিজের জীবন বিসর্জন । অর্থনীতিক চাপ , সামাজিক চাপ , দেশ ও পিতার সম্মান এসব বাচাতে কৃষ্ণকুমারী আত্মহত্যা করেন । নারীর প্রতি ধনলােভী কপট পুরুষের প্রতিহিংসা এবং তার ফলে নিরপরাধ তরুণীর আত্মাহুতি কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের মূল বিষয়।
৩। তপস্বী ও তরঙ্গিনী - বুদ্ধদেব বসু

তপস্বী ও তরঙ্গিনী এই নাটকটি একটি কাব্য নাটক ও পৌরাণিক কাহিনীমূলক নাটক। নাট্যকার এই নাটকে পৌরনিক কাহিনীর সাথে সমসাময়িক লাইফ তিনি তুলে ধরেছেন। ‘তরঙ্গিনী’ অসাধারণ সুন্দরী এক বারবণিতা যে তার পেশাগত দক্ষতা, ছল-কলায় শীর্ষে। এই নাটকের দুই উল্লেখযোগ্য চরিত্র ঋষ্যশৃঙ্গ ও তরঙ্গিণী ছাড়াও রয়েছে লোলাপাঙ্গী, চন্দ্রকেতু, বিভাজক, রাজমন্ত্রী, অংশুমান ও রাজকুমারী শান্তা যারা প্রত্যেকেই তাদের জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, পাপ-পূণ্য, লাভ- লোকসানের হিসাবে ষোলআনা পাকা; ঠিক তাদের উল্টো চরিত্র ঋষ্যশৃঙ্গ ও তরঙ্গিণী, যারা আপন সত্তার উদ্বোধনের সাধনায় আপনাকে জানতে ও খুঁজতে ব্যাকুল। বৈষয়িক লাভ-ক্ষতির ঊর্ধ্বে কেবল মানবিক দিকের প্রকাশ, স্বতন্ত্র ব্যক্তি ও সত্তা হিসেবে মানবমূল্য খোঁজা ও বোঝার চেষ্টায় যারা রত।
প্রেম, বেদনা ও রোমান্টিক আবেগ, যা সাধারণ মানুষেরা ‘কাম’ নাম দিয়ে অপলাপ করে থাকে, তারই পথ ধরে দু’জন মানুষের পূর্ণের পথে উত্তরণের অসাধারণ প্রকাশনা। নারী ও পুরুষের আপন সত্তা ও স্বাতন্ত্র্যের স্বকীয়তার মূল্য ও একে অপরের পরিপূরকতার বিশিষ্ট কার্যকারণ।
৪। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় - সৈয়দ শামসুল হক

পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটক টি মুক্তিযুদ্ধের উপর মঞ্চ নাটক । ১৯৭৬ সালে মুক্তি পায় এই কাব্য নাটক । মূল কাহিনী মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকের । বিজয় যখন আসন্ন, মুক্তি বাহিনী চলে এসে দখন নেয় একটি গ্রামে। মুক্তিবাহিনীর আসার যে শব্দ, তাদের এই পায়ের শব্দ, এই বিজিয়ের শব্দই মূলক এই নাটকের নামকরণে ব্যবহার করা হয়েছে, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়।
গ্রামে মুক্তিবাহিনী আসার খবরে সবাই খুশি হলেও, কেবল একজন খুব অখুশি হয়। তিনি আর কেউ নন, তিনি এই গ্রামের মাতুব্বর ও রাজাকার। মুক্তি বাহিনী আসার এই খবরের গ্রামের মাতব্বর ভয় পায় কাড়ন সে ছিল পাকি দের দালাল এবং তার চেষ্টা ছিল পাক বাহিনীকে সাহায্য ও খুশি করা। এমনকি সে পাক বাহিনীকে খুশি করতে সে তার নিজের কন্যাকেও পাক দেনাদের কাছে তুলে দেয়। পরে মাতবরের কন্যা পিতার সামনেই আত্মহত্যা করেন । এই নাটকে স্বাধীনতা প্রাপ্তির কথা বলা হয়নি, কিন্তু স্বাধীনতার ইংগিত দেয়া হয়।
এই নাটকটি মূলত, যুদ্ধ চলাকালে একটি খণ্ড ঘটনা। এই ঘটনায় স্বাধীনতা প্রাপ্তির কথা বলা হয়নি তবে জাতীয় পতাকা দিয়ে স্বাধীনতা প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করে পরিসমাপ্তি টানা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে জীবনদান করা বা জীবন বাঁচানোর কৌশল এই নাটকে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
৫/ কিত্তনখোলা - সেলিম আল দীন

সেলিম আল দীন সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। বাংলা নাটক সম্পর্কে যারা খোঁজ রাখেন তারা উনার নাম জানেন। কিত্তনখোলা একটি ভিন্ন ধরনের নাটক। মুল নাটক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০০০ সালে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যনারে মুক্তি পায় চলচ্চিত্র কিত্তনখোলা।
সময় ৮০ দশক। এর সময়ের বাংলা সংস্কৃতি কেমন ছিল। নাটকটি শুরু হয় একটি বন্দনার মাধ্যমে । ফসল মাড়াই শেষ হলে নদীতীরে মেলা আয়োজন করা হয়। কিত্তনখোলার মেলা।
মেলার প্রধান আকর্ষণ "আদি মহুয়া অপেরা" যাত্রাদল। যাত্রাদলের প্রধান সুবল দাস তার দলবল নিয়ে মেলায় পৌঁছে । ঠিকাদার ইদু কন্ট্রাক্টর মেলার ইজারা নিয়েছে। গ্রামের যুবক সোনাই মেলায় ঘুরার সময় ইদুর লোক তাকে তার জমি নিয়ে ইদুর সাথে কথা বলতে এলে সে পালিয়ে যায়। ডালিমনের দেওয়া তাবিজে সোনাইয়ের মৃগী রোগ থেকে নিস্তার পায়। সে ভালোবেসে ফেলে ডালিমনকে।
এই নাটকে আমরা মূলত আশি দশকে গ্রামের সামাজিক অবস্থা, ভালোবাসা, প্রেম, ক্রোধ, বিনোদন ব্যবস্থা কেমন ছিল তার একটা পূর্নাঙ্গ ধারনা পাই।
ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০২৪ সকাল ৯:৪০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



