দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পায়।গাজী যোদ্ধরা ঘরে ফিরে আসে।আর অপারেশনে যাওয়ার তাড়া নেই, বাড়ীতে রেখে আসা মা বোনের কথা, শশুর বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া বৌ সন্তানের চিন্তায় সারা দিন মন খারাপ করে কাটানোর প্রয়োজন নেই, রাজাকারদের চোখ ফাকি দিয়ে স্বজনদের সাথে দেখা করার সুযোগের অপেক্ষায় থাকারও প্রয়োজন নেই। মায়ের ছেলে মায়ের কোলে ফিরে এসেছে।বোনের ভাই বোনের কাছে ফিরে এসেছে,নববধূটির স্বামী নববধূর পাশে ফিরে এসেছে।
আপামর জনসাধারনও এখন নিশ্চিন্ত। মূহুর্তে মুহুর্তে আশ্রয় হারানোর ভয় নেই ও আশ্রয় খোজার তাড়া নেই। কারন যুদ্ধ শেষ।দীর্ঘ নয় মাস পর মানুষ একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে।কারন যুদ্ধ শেষ হয়েছে।
যে মেয়েগুলো হায়নাদের পাশিবকতার শিকার হয়েছিলো,ক্যাম্পে বন্দী ছিলো,অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেছে।তারাও ঐ মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে এলো।কিন্তু সহায় সম্ভ্রম হারানো নারীগুলো এই স্বাধীন বাংলার মাটিতে পা রেখেই তারা আবিষ্কার করলো স্বাধীন বাংলার এই সমাজে তারা যেন বোঝা।এই সমাজ তাদের মেনে নিতে অনিচ্ছুক।ঘরে ফেরা যোদ্ধা ভাইটিকে মা আচলে মুছিয়ে দুধ দিয়ে গোসল করিয়ে বুকে জড়িয়ে ঘরে তুললেও সম্ভ্রম হারানো মেয়েটিকে যেন ছুতেও লজ্জা পায়।যোদ্ধা ছেলেটিকে নিয়ে বাবা টি-স্টলে বসে চা খেতে খেতে গর্বিত ভরাট কন্ঠে ছেলের গল্প করলেও লাঞ্চিত মেয়েটির কথা উঠলেই অর্ধেক চা সহ কাপ রেখেই মাথা নিচু করে উঠে আসে।বাড়ি ফিরে দুসঃহ স্মৃতি তাড়া করে বেড়ানো চুপচাপ বসে থাকা মেয়েটির দিকে বিরক্তি মাখা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেয়েটিকে খোদার অভিশাপ মেনে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেন। মেয়েটি তখন আরো অসহায় বোধ করে নিজেকে।খাদের অতলে তলিয়ে যেতে থাকে।আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী যখন তাকে অসূচি ভেবে এড়িয়ে চলে,আড়ালে কুলটা বলে,তার সমবয়সীদের তার সাথে মিশতে বারন করে, মেয়েটি তখন উপলব্ধি করে স্বাধীকার আদায়ের যুদ্ধ শেষ হলেও তার যুদ্ধ শেষ হয়নি।সে উপলব্ধি করে এই স্বাধীনভূমি তার জন্য নয়।এই স্বাধীন দেশের মুক্ত বাতাস তার জন্য নয়। এক মৃত্যুকূপ থেকে আরেক মৃত্যুকূপে প্রবেশ করেছে সে।দীর্ঘ নায় মাসের স্বাধীকার আদায়ের যুদ্ধ শেষ হলেও তাদের যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি।নয় মাস যুদ্ধের মতোই বিভৎস রুপ নিতে থাকে যুদ্ধ পরবর্তী যুদ্ধ।সেই যুদ্ধে কেউ হারায় পিতার ঘর,কেউ হারায় স্বামীর ঘর, কারও ঠাই হয় পতিতাপল্লীতে আর কেউ কেউ এই দূর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি পেতে বেছে নেয় আত্মহননের পথ।
পরিশেষে কি দাড়ালো?স্বাধীন রাষ্ট্রের সমাজ স্বাধীনতার জন্য স্বর্বস্ব ত্যাগ স্বীকার করা নারীটির সাথেও করেছে পুরুষতান্ত্রিক আচরন।আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ঘরে ফেরা পুরুষ যোদ্ধাদের মাথার মুকুট করে নিলেও সব হারানো নারীদের রেখেছিলো উঠোনের কোনায় ঝাট দিয়ে জড়ো করে রাখা ময়লার মতো তুচ্ছ করে।রাষ্ট্র তাদের বীরঙ্গনা উপাধি দিলেও আমাদের সমাজ দিয়েছে তাকে অসতী উপাধি।এ সমাজ তাদের দিকে ঐ চোখেই তাকিয়েছে,যে চোখে তাকাতো পাক হায়নারা।এ সমাজ তাদের সাথে ঐ আচরনই করেছে, যে আচরন করেছিলো হায়নারা।
তার সবচেয়ে বড় প্রমান সদ্যপ্রয়াত বীরঙ্গনা ভাস্কর প্রিয়ভাষীনি।যিনি দুই লাখ মা বোনকে নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন ৭১ তাদের জন্য লজ্জা না,৭১ তাদের গর্ব।তিনি এ সমাজের চোখে খোচা দিয়ে দেখিয়েছেন আমাদের লাল সবুজের ঐ পতাকাটি রক্তের পাশাপাশি সম্ভ্রম বিনিময়েও কেনা হয়েছে। দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে। তিনি বলে গেছেন এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের তার সাথে করা তৎকালীন পাশিবক আচরনের কথা।
সব হারিয়ে ঘরে ফেরা প্রিয়ভাষিনীকে এই সমাজ হাত ধরে টেনে তোলার বদলে উল্টো ঠেলে দিয়েছিলো খাদে। এ সমাজ তার পাশে তখন দাড়ায়নি বরং আত্মহত্যার প্ররোচনা জুগিয়েছে।এই সমাজের কামড়ে দিশেহারা হয়ে ভাষিনী নিজের শক্তিতে খাদে থেকে উঠে এসে পায়ের নিচে গড়েছেন শক্ত ভিত। নিজে আলোয় নিজের অন্ধকার দূর করে আলোকিত করেছেন এই সমাজকে।কিন্তু তাতে কি সমাজটার অনুশুচোনা হয়েছে?
বিন্দুমাত্র হয়নি।যার ফলশ্রুতিতে আমৃত্যু যোদ্ধা হতে হয়েছে তাকে।আমৃত্যু যুদ্ধ করে যেতে হয়েছে তাকে।
পরিশেষে বলা যায় স্বাধীন দেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পুরুষ যোদ্ধাদের মাথার মুকুটু করলেও বীরঙ্গনাদের দেয়নি বিন্দুমাত্র সম্মান।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০১৮ দুপুর ১:১৪