আরেকবার বাঁশের চোঙ্গায় ফুঁ ফিয়ে আগুন ধরাবার চেষ্টা করে আফিয়া। সাত বছরের ফুটফুটে মেয়েটা কাছাকাছি গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। দৃষ্টি আগুনে না, আফিয়ার চোঙ্গা ফোঁকায় না, আবার বলতে গেলে পূব দখিন আকাশে ওঠা এতো বড় চাঁদ মামার দিকেও না। ভাতের হাড়ির দিকে এক ঠায় তাকিয়ে থাকে ফেলানি।
দুপুরে 'কালাইম্যার দোকানে' একটা বাসি বনরুটি খেয়েছিলো ফেলানি, তারপর ঘরে এসে ঘুম। ঘুম থেকে উঠে দেখে ফকফকা আলোয় ঘর ভরে গেছে। বাতি জ্বালালে আফিয়া বকাবাদ্য করে। আজকে চাঁদটা এতো বড় কেন ভাবতে যেয়ে ফেলানির মনে পড়ে, সরকার বাড়ির জেয়াফতের খানায়ও এমন একটা চাঁদের মতো থালায় গোশ দিয়ে, সবজি দিয়ে, সালুন দিয়ে মাখিয়ে খেয়েছিলো। ইশ! আবার জানি কবে এমন খাওয়া যাবে, ভাবে ফেলানি।
ফেলানি এইবার সাত বছরে পড়ছে। আফিয়ার সাথে সাথেই থাকে। আফিয়া বাঁজা মেয়ে। স্বামী ছেড়ে গেছে কবে এখন আর মনে পড়ে না। খোরশেদেকে খুনের মামলায় পুলিশ যখন নিয়ে গেলো সে সময় মেয়েটার দায়িত্ব নিয়েছিলো শুধু নিজের একটা সন্তান থাকলে কেমন হতো তা ভেবে। ছেলে হলে নিতো না আফিয়া। মেয়ে বাচ্চা হলে সুবিধা আছে, বাসায় কাজে কামে লাগিয়ে দেয়া যাবে। ফেলানির মা যেহেতু এই দুনিয়ার পাট চুকিয়ে দিয়েছে, সেখানে আছিয়ার হাতে ফেলানিকে দিয়ে যেতে দ্বিতীয়বার আর ভাবতে হয়নি খোরশেদকে। তাছাড়া পুলিশ যখন কাউকে খুনের মামলায় গ্রেফতার করে, তখন সে ধরণের খুনি 'পশু'দের পুলিশ এতটুকু ছাড় দেবে না বলাই বাহুল্য, খোরশেদ তাই ডাণ্ডাবেড়ি পরতে পরতেই আফিয়ার কাছে ফেলানিকে দিয়ে যায়।
আর খোরশেদ যা কিছু টাকা রেখে গিয়েছিলো, তাই দিয়ে দিয়াবাড়ি ঘাটের কাছে একটা ঘর ভাড়া করে থাকে এখন আফিয়া। টুকটাক যা লাগে 'কালাইম্যার দোকান' থেকে আনতে পারে। এমনিতে এঘরে ওঘরে কাজ করে বাসি ঝুটা খাবার যা পায় তা দিয়ে আফিয়া আর ফেলানির দিন চলে যায়। কালাইম্যার, আছিয়া আর ফেলানির জন্য এই অহেতুক সুবিধা প্রধান হতে পারে গরীবের কষ্ট গরীবে বুঝে এই কারণে, কিংবা আছিয়া আর ফেলানিকে আত্মীয় ভেবে, অথবা খোরশেদের সাথে অনেকদিন অনেক কাজের সঙ্গী ছিল, সেই কৃতজ্ঞতায়। যদিও এই এলাকার কেউই এই ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করেনি কখনও। এমনকি যেদিন খোরশেদকে পুলিশে ধরে নিয়ে যায়, সেদিনও লোকজন অনেক হাসাহাসি করেছিল এবং নিজের বউকে খুন করা একটা লোককে সেদিন তারা একহাত দেখে নিয়েছিল। কিন্তু খোরশেদ বারবার কেন যেন ঘরের ভেতরে যেতে চেয়েছিল, সেই কথা কেউ আর আলোচনা করে না। একজন খুনি, সেতো খুনিই, তার জন্য আবার কিসের মানবিকতা। আর আমাদের আশেপাশের সমাজ এখন সত্যকে সত্য বলেই অভ্যস্ত, সুতরাং সরকার যখন বাদী হয়ে মামলা করল, তখন সবাই ন্যায়বিচারের ব্যাপারেও আশাবাদী হলো। যদিও ফেলানি ছোট বলে কাজের মেয়ে হিসেবে নেয়ার কথা আপাতত ভাবল না সমাজের কেউ। আর আফিয়া যেহেতু খোরশেদকে আগেথেকেই চিনেজানে, খোরশেদের বউয়ের সাথেও পান খেয়ে গল্প করেছে, আর যেহেতু তার সন্তান হয়না, সবকিছু মিলিয়ে আছিয়া ফেলানিকে নিজের কাছে রেখে দিতে সম্মত হয়েছে। আরো বলতে গেলে খোরশেদের পুরানো সাঙ্গপাঙ্গরা কচিত কদাচিৎ আসে যায় লুকিয়ে চুরিয়ে, কিছু টাকা পয়সা দিয়ে যায়, কাপড় চোপড় দিয়ে যায়, আর মাঝেমধ্যে কেউ কেউ থেকেও যায়, সেদিন ফেলানি মাটিতে মাদুর পেতে শুয়ে থাকে আর বড় থালার মত চাঁদ না উঠলে সে দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়ে।
আফিয়ার যেহেতু স্বজনেরা কেউ নেই বা থাকলেও সে মনে করতে পারে না আবার সে হয়তো জানে কোথায় কে আছে, কিন্তু নতুন করে আর ভিড়তে চায় না - তাই এই এতোবড় ইদের বন্ধের সময়ও এখানেই রয়ে গেছে। লোকজন বাড়ি না ফিরলে খাওয়া দাওয়া এই কটা দিন কমতির দিকেই যাবে। এইসব ভাবতে ভাবতে হুশ করে চুলোয় আগুন জ্বলে ওঠে।
মুসুরের ডাল এক মুঠ, দুই মুঠ চাল আর কটা আলুর টুকরো দিয়ে খিচুড়ি সিদ্ধ করে খেয়ে নেবে দুইজনে। ফেলানির মুখে আগুনের আভা দেখে আফিয়ার মনটা মুচড়ে ওঠে। এই মেয়ে রাজকন্যা হতো আর কি না এইভাবে পড়ে আছে বস্তির ঘরে। মাঝে মধ্যে মনদিল ভালো না লাগলে ফেলানির উপর চোটপাট যায় বেশ। কিন্তু ফেলানি টু শব্দও করে না। মানুষের বাচ্চারা আর কিছু না বুঝলেও এটা বোঝে যে কখন কোথায় তাকে থামতে হবে। তবে আফিয়া মেয়েটারে আবার আদরও করে।
কয়দিন মাথায় খুব উঁকুন হয়েছিলো, আফিয়া দোকান থেকে দুই টাকার ছোট এক প্যাকেট শ্যাম্পু এনে দিয়েছিলো ফেলানিকে। কি সুন্দর বাস। ফেলানি পুরোটা দেয় নি, আধেকটা রেখে দিয়েছে বালিশের কাভারের ভেতর। আবার পরে একদিন দিবে। শ্যাম্পু দিলে ফেলানির চুলগুলো কি সুন্দর ফুলে ফুলে উড়ে যায়।
বাবার কথা খুব বেশি মনে পড়ে না ফেলানির। আফিয়া একবারও নিতে পারে নাই কারাগারে। বাবার কথা মনে আসলেই, ফেলানি এক দৌড়ে নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকে। খোরশেদ এই কথা শুনে খালি কাঁদে। একবার মেয়েটাকে দেখতে তার খুব ইচ্ছে হয়। তার ফাঁসির খুব বেশি বাকি নেই। কালকে আবার জেলর স্যারের সাথে দেখা করতে হবে, তওবা করাবে মনে হয়।
খোরশেদের এখন আর কোন কিছুই ভালো লাগে না। তবে গত দুই বছরে সে নামাজ রোজা করেছে, গাছে পানি দিয়েছে, শরীরে কুলালে বাকি সব কাজেও হাত লাগিয়েছে। ধীরে ধীরে জেলর সাহেবের নজরে পড়েছে আর নানান রকম কাজে তাকে লাগিয়েও দিয়েছিলেন জেলর সাহেব। খুব মন দিয়ে কাজ করতো খোরশেদ। এইবার দেখা হলে মেয়েটাকে একবার দেখতে বলবে জেলর সাহেবকে। উনি বড় মানুষ যদি কিছু করে দিতে পারে। সাহস নিয়ে এইবার বলতেই হবে ভাবে খোরশেদ।
খোরশেদ যখন এসব ভাবছে তখন এশা'র আযান পড়ে গেছে। নামায পড়ার জন্য প্রস্তুতি নেয় সে, আজ মেয়ের জন্যে প্রাণ ভরে দোয়া করবে খোরশেদ। একই সময় ফেলানি আর আফিয়া আধা সিদ্ধ হযবরল খেয়ে খাটে শুয়ে শুয়ে একথা সেকথা নানা কথায় ব্যস্ত রাখে নিজেদের। আফিয়া আবার ভাত খেয়ে সিগারেট টানে। এই অভ্যাস সে শিখেছে তার প্রাক্তন স্বামীর কাছে। সিগারেটের টান দিতে দিতে ফেলানিকে ডাকে আবার আফিয়া। ফেলানি তখন গভীর ঘুমে। একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে আফিয়া।
রাতে খুব করে বৃষ্টি হয়েছিলো। সকালবেলা জেলর চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। কাল রাতে আবার সেই ইন্সপেক্টরের সাথে কথা হয়েছিলো, যিনি খোরশেদের কেইসটা ডিল করেছিলেন। একটা অদ্ভূত অনুরোধ তিনি করেছেন। একজন লোক উনার সাথে দেখা করতে চায় আর আলোচনার বিষয়বস্তু 'খোরশেদ'। জেলর সাহেব বারবার জিজ্ঞেস করে নিয়েছেন পত্রিকাওয়ালা না কি, কিন্তু পুলিশ অফিসার নিশ্চিত করেছেন যে তা নয়। তবে তিনি সময় দিলে হয়তো উনার জানার পরিধি বাড়বে খোরশেদের ব্যাপারে।
রাতের বৃষ্টিতে বেশ ঠান্ডা নেমেছিলো, ফেলানির ঘুম থেকে উঠতে উঠতে অনেক দেরি হয়ে গেলো। ভ্যাপসা গরম লাগছে এখন, আফিয়াও হাত পা ছাড়িয়ে শুয়ে আছে। কতক্ষণ ডেকেডুকে না তুলতে পেরে ঘর থেকে বেরোয় ফেলানি। গতকালের ছাই গুড়ো হাতে নিয়ে আচ্ছা করে দাঁত মেজে নেয় সে। আজকে দুপুরে একটা দাওয়াত আছে। হাতমুখ ধুয়ে এসে আফিয়ার গায়ে ধরে নাড়া দেয় ফেলানি। দুতিনবার ঝাঁকানোর পর আফিয়া গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে। আরো কতক্ষণ ঝাঁকিয়ে ডেকেও যখন ফেলানি আফিয়াকে তুলতে পারে না, তখন সে কেঁদে ওঠে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ নুরুল চৌধুরী
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1740425142873622&id=1706022202980583
#oporadhi2_15102016_JK