কুমিল্লা ময়মামতি ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে, গোমতী নদীর বাঁধের পাশ ঘেঁষে এক ফালি পিচঢালা রাস্তা শহরকে ডানে রেখে ক্রমশ হারিয়ে গেছে সীমান্তে। গোলাবাড়ি গিয়ে তার মুক্তি মিললেও, মুক্তি পাবার আগে আগে বিভিন্ন সংযোগ সড়কগুলোয় সে একটা হাহাকার ছড়িয়ে দিয়ে গেছে। এই আঠারো কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের একটি সংযোগ সেতু হচ্ছে পালপাড়া শ্মশানঘাট লাগোয়া ব্রিজ, অনতিদূরে রেলপথ, নিচে নদীর ধারে বাঁশের আর কাঠের বেঞ্চি। 'কফি হাউজ' নামে একটা বিনোদন কেন্দ্র আছে, তাদেরই এসব বেঞ্চিতে বসে লোকজন কফি খায়, সিগারেট টানে, জড়াজড়ি করে বসে, আর নদীর পাড় ঘেঁষে অনেকেই মাছ ধরে বা মারে। আজকে এখানেই আসতে হলো, মূলত দুইটি কারণে - এক. মাঝে মাঝে কুমিল্লা আসি যখন, নদীর পাড়ে সময় কাটানোর ব্যাপার থাকে, আর দুই. নূরা পাগলাকে শেষ নাকি এখানেই দেখা গেছে। আরেকটা তথ্য দেয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। গোলাবাড়ি থেকে অল্প দূরত্বেই বিবির বাজার সীমান্ত আর প্রতিবেশী দেশের মালটানা আঠারো চাকা কিংবা ছত্রিশ চাকার যানগুলোর নগ্ন পদচারণা আমাদের কচি কচি রাস্তাগুলোর ওপর। আরো বড় রাস্তা হবে, আরো উন্নত হবে দেশ।
নূরার মা মারা যাবার পর থেকে ও এমনিতেই বিধ্বস্ত ছিল, আরও হয়ত কিছু ঘটেছে তাই ইদানিং শহর ছেড়ে গোমতী নদীর পাশে বসে কয়লা গায়ে মাখিয়ে বসে থাকে শুনেছি। লোকেদের মুখে শুনেছি নূরা পাগলা এখন কয়লা খায়। সারাগায়ে কয়লা মাখিয়ে, কিম্ভুতকিমাকার হয়ে নদীর ধারে দুহাত ছড়িয়ে দৌড়ে বেড়ায় আর বলতে থাকে "কয়লারানী, কয়লারানী, কয়লারানী - কি জয় হো"! নূরার পাগলামির চূড়ান্ত রুপ দেখছে সবাই। শহরে নিয়মিত চায়ের দোকানে খোঁজ নিয়ে যখন জানতে পারলাম, তখন ছুটে এলাম এখানে। খানিকক্ষণ খুঁজে পেতে নূরাকে পেলাম নদীর মধ্যে কি জানি খুঁজছে! দাঁড়িয়ে মিনিট পাঁচেক দেখলাম, কিছুই বুঝলাম না। দুর্বাঘাসের উপর বসে পড়লাম, উঠুক আগে, তারপর ওর পাগলামির খবর নেয়া যাবে ভেবে মৌজ করে একটা সিগারেট ধরালাম।
নিকোটিনের পোড়া গন্ধে নূরা পাগলা একবার ফিরে তাকালো যেন, নদীর ওপাড়ে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলে উঠে এসে সুবোধ বালকের মতো আমার পাশে এসে বসলো। আমি কথা না বলে ওকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিলাম, বিনিময়ে সে আমাকে একটা কয়লার টুকরো হাতে দিয়ে আনমনে সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলো। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করে বললাম, "কি রে কি খবর! বাসায় যাস না কতদিন?" আমার দিকে ফিরে না তাকিয়ে বললো, "দেশে বিদ্যুৎ নাই, যতদিন কবরেও বিদ্যুৎ না আসবে, আমি বাড়ি ফিরব না ভাই"।
বুঝলাম পাগলামি বলতে মানুষ যা বোঝাচ্ছে এসব আসলে নূরা পাগলার ইচ্ছাকৃত। এবার আমার মেজাজটা খারাপ হতে শুরু করলো। জিজ্ঞেস করলাম, "এইগুলা কি শুরু করেছিস?"
- কই ভাই, কি শুরু করলাম! এই যে সুন্দর নদী, কি বাতাস! এইখানে সময় কাটাই, কারো তো কোন ক্ষতি করিনা!
- বাসায় যাস না কেন?
- ভাই কার বাসায় যাবো?
- তোর বাসায়, আবার কার বাসায়!
- বাসায় বিদ্যুৎ নাই ভাই আজ একমাস। দেড়হাজার টাকা বিল আসে। বউ পোলাপান শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। তিনজন মানুষের যদি এত টাকা বিল আসে তাহলে ভাই বাড়িতে থাকার কি দরকার? আবার শুনলাম, বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়াবে! আচ্ছা ভাই ছয় দফা, সাত দফা, নয় দফা, তেরো দফা, দফারফা এইগুলা আসলে কেন করে ভাই?
- তুই তো প্রশ্ন করিস নি, আমার দফারফা করে দিছিস হারামি!
- ভাই, বলেন না বিদ্যুৎ নিয়া কি শুরু করলেন আপনারা?
- আরে আমি কি আর এতসব বুঝি নাকি! তবে দেশের উন্নতি করতে হলে বিদ্যুতের বিকল্প নাইরে পাগলা!
- বুঝি নাই ভাই! একটু খোলাসা করে বলেন?
- দেখ, একটা দেশের দুই ধরণের উন্নতি সম্ভব। একটা হচ্ছে বড় বড় দালান কোঠা, হোটেল মোটেল, রাস্তাঘাট, বাণিজ্যিক ভবন বানানো।
- জয় মহারানী কি জয়! জয় কয়লারানী কি জয়!
- দেখ নূরা, আবার যদি কথার মাঝে বিরক্ত করিস, তো তোর একদিন কি আমার একদিন!
- থুক্কু ভাই! আরেকটা সিগারেট দেন, আর কিছু বলব না।
নূরাকে আরেকটা সিগারেট দিয়ে, আমিও একটা ধরালাম। একবার ভাবলাম কাকে কি বলছি! এসব তো আলোচনা হবে শিক্ষিত লোকের মাঝে, গোলটেবিল বৈঠকে, দেশের সুশীল নাগরিকদের মাঝে! আর আমি কিনা একটা পাগলের সাথে বসে এসব আলাপ করছি। "কই ভাই, দেশের দুই ধরণের উন্নতি বলেন, শুনি" - নূরা পাগলা নাছোড়বান্দার মত বলে। আমি ওকে আসলে বুঝিয়ে বলি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন প্রয়োজন, তেমন প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী টেকসই উন্নয়ন, যাতে করে স্বল্প পুঁজিতে উদ্যোক্তারা ছোট ছোট ব্যবসা করবে, যার যার গ্রামে কিছু না কিছু উৎপাদন করবে, সেগুলোর বাজারজাতকরণ করা সহজতর হবে আর স্থানীয়ভাবে অসংখ্য কাজের সুযোগ তৈরি করা এবং চিকিৎসা ও শিক্ষাসেবা প্রদান করা যাবে; তাহলে একই মানের উন্নয়ন অর্জন করতে অনেক কম পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে।
- ভাই রাখেন রাখেন! নূরা পাগলা দুই হাত নেড়ে আমাকে থামায়।
- কিরে কি হলো? আমি জিজ্ঞেস করি।
- মাথা ঘুরায় ভাই! এইসব তো পেপার-পত্রিকায় দেখি ভাই। সহজ করে কিছু বলেন না!
- আরো সহজ করে বলতে হবে! আচ্ছা ধর বাচ্চাদের হিসু যাতে ফ্লোরে না পড়ে, মা-বাবার সময় যেন নষ্ট না হয়, সেইজন্য একধরণের ডায়াপার পরায়।
- প্যাম্পাস, প্যাম্পাস ভাই, আমি জানি। কয়লারানী কি জয় হো!
- এর মধ্যে আবার কয়লারানী আসলো কেন! হ্যা, প্যাম্পাস বাণিজ্যিক ব্র্যান্ড, এরকম আরো আছে, চুচু, হাগিস, বেবেম আরো কত কি! যাইহোক অনেক তরুণ ছেলেরা এগুলো বিপণনের কাজ শুরু করেছিল। বেশ ভালোই চলছিল। তারপর আমাদের দেশের বেশ কিছু বড় কোম্পানি দেশেই উৎপাদন শুরু করল একই জিনিসের, আরো কম দামে।
- বাহ্, ভাই ভালো তো!
- অবশ্যই ভালো। কিন্তু এখানে মজার একটা ব্যাপার ঘটলো, যেসব ব্র্যান্ড'র নাম বললাম এরা কিন্তু সেইসব তরুণদের স্বল্প সময়ের জন্য বাকি দিত। খুচরো দোকানকদারেরা সপ্তাহে সপ্তাহে আবার বিক্রিলব্ধ অর্থ ফিরিয়েও দিত। বেশ ভালোই চলছিল।
- তারপর?
- তারপর রাতারাতি দেশের অনেকগুলো কোম্পানি যখন তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ড'র বাজারজাত করা শুরু করলো, তারা ডিলারশীপ দিলো না, সরাসরি বিক্রেতাদের কাছে পৌঁছে গেলো, এক মাসের বাকিতে মালপত্র দিলো।
- দারুণ দারুণ!
- দারুণের কিছু নেই পাগলা। এই একটা কাজেই প্রায় চারহাজার তরুণ হুট করে বেকার হয়ে পড়ল, তাদের সাপ্তাহিক বাকি আর উদ্ধার হলো না। আর অনেকেই নামে মাত্র পাওয়া ডিলারশীপের জামানত খুঁইয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে লাগলো।
- এটা কেমন কথা! ওরা তো দেশের কোম্পানিগুলোর সাথে একসাথেই কাজ করতে পারত!
- কাজ করতে পারত কি পারত না, সেটা জন্য কয়লা বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন, কিন্তু একেবারে শূন্য থেকে কিছু লোক বা প্রায় চারহাজার পরিবার পথে বসে পড়লো। আর যেসব ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠলো তাদের মান যে খুব আহামারি তা না, কিন্তু তাদের বিশাল ব্যবসায়ীক মনোবৃত্তির কাছে হেরে গেল, স্বপ্ন দেখা চারহাজার পরিবার। আর এসবই সম্ভব হয়েছে বিদ্যুত সরবরাহের কারণে।
- ভাই বিদ্যুতের দোষের ব্যাপারটা বুঝি নাই!
- হুম! ধর সরকার যদি এই তরুণ উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতো, যার যার এলাকা ভিত্তিক উৎপাদন ও সরবরাহ করতে নির্দেশ দিতো, অথবা সেইসব দেশি কোম্পানি যদি ওদের সাথে বসে একটা পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোত, তবে এরাও বেকার হতো না, আবার দেশি কোম্পানিগুলো বাকি না রেখেই তাদের ব্যবসা অল্প সময়ে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতো।
- আপনি বলতে চান যে, মিলেমিশে কাজ করতে! কয়লারানী কি জয় হো!
- আসলে কি ঘটেছে শোন! দেশি কোম্পানিগুলো এইসব নতুন প্রোজেক্ট দেখিয়ে জমি লিজ নিল, ব্যাংক থেকে চড়া সুদে হাজার কোটি টাকা লোন নিল, সরকার ওদের বিদ্যুৎ ও গ্যাস দিল, কিন্তু উৎপাদনে এরা গড়িমসি করা শুরু করল। যার ফলে লোকজন আবার সেসব বিদেশি ব্রাণ্ডে ফিরে গেল, কিন্তু ফাঁকে সেইসব ছোট ছোট উদ্যোক্তারা ছিটকে পড়ল। আর সেই জায়গা এই বড় কোম্পানিগুলো ধরে নিয়ে এখন নিজেরাই ব্যবসা শুরু করল। আবার আগের বিদেশি কোম্পানিগুলোর মাল এসে ভরে গেল দেশীয় বাজারে, কিন্তু বড় ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। বাজারে তুই এইসব ভুড়িভুড়ি পাবি এখন, কিন্তু সেগুলোতে যেন সেসব তরুণ উদ্যোক্তাদের করুণ চেহারা দেখতে পাই।
- তাহলে এত বিদ্যুৎ দিয়ে আমাদের কি হবে? সুন্দরবন, চুক্তি, আরো কত কী ভাই?
- হাহ হাহ হা! এসবই উন্নতির নেশা, অল্প সময়ে উঁচুতে ওঠার জাতে ওঠার চেষ্টা, আর নিজেদের অন্যদের মতো করে দেখার উচ্চাভিলাষ।
- কিন্তু ভাই, মানুষেরই যদি উপকার না হলো, তাহলে এইসব উন্নতি কার জন্য, এসব করে কী লাভ?
- হুম, একটা গল্প বলি, এ নিয়ে আর কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। এতো সুন্দর পরিবেশ আর কদ্দিন থাকবে কে জানে! শেষ হবার আগে প্রাণভরে বাতাস নিয়ে নেই, মনের সাথে চোখেরও আরাম হোক।
- জ্বি ভাই বলেন গল্প শুনি, কয়লারানীর গল্প বলেন ভাই?
- খবরদার আর কয়লারানী বলবি না, গল্প শোন আগে।
বুঝলি, কদিন আগে একটা জার্নালে একটা লেখা পড়েছি, ইংরেজিতে। তোকে বাংলাটাই শোনাই। তো এক কৃষকের বেশ পয়সা হয়েছে। পরিবার, গ্রামের আত্মীয়দের চাপে সে বিয়ে করতে রাজিও হয়েছে। তাকে পছন্দের কথা জিজ্ঞাসা করাতে সে বলেছে, চেয়ারম্যান সাহেবের বউয়ের মত একজন মেয়ে তার চাই।
খোঁজ খবর নেয়া হল, দূরগ্রামে সেরকম একজন মেয়ের খোঁজও পাওয়া গেল। বিয়ের যোগাড়যন্ত্রও হল। চেয়ারম্যান সাহেব আগাগোড়া সবই শুনলেন, দাওয়াতে এলেন এবং তারও মনে হল হ্যা, কৃষক ব্যাটার বউ, তার নিজের বউয়ের মতই সুন্দর।
মাসখানেক গেলে পরে চেয়ারম্যান একদিন সেই কৃষককে বলল, আরে মিঞা - তোমার এত সুন্দর বউ, এত জমিজিরাত, এত অর্থকড়ি করেছ, তোমার সামাজিক একটা মর্যাদা দরকার। আজ থেকে আমার বাসায় তুমি যখন ইচ্ছা তখন আসবা। কৃষক চেয়ারম্যান এর মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে বলল, আপনিও আসবেন আমার বাসায়। তারপর দুজনে কোলাকুলি করে বাড়িতে ফিরল।
তারপর দিন যায়, রাত যায়, কৃষক কাজে কাজে বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা হয় রাত হয়, ফসলের উৎপাদন, বাজারজাতকরণ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এদিকে চেয়ারম্যান যখন তখন সেই কৃষকের বাড়িতে যায়, অন্দরমহলে ঢোকে, কৃষকের বউয়ের সাথে নিজের বউয়ের মত ব্যবহার করে, শাড়ি দেয়, টিপ দেয়, চুড়ি দেয়। আর কৃষক না পারে নিজের বউয়ের সৌন্দর্য দেখতে, না পারে চেয়ারম্যানের ঘরে মাঝে মাঝে যেতে। আর যখনই যাওয়ার চেষ্টা করে তখনই নানারকম অজুহাত দাঁড়া করায় চেয়ারম্যান এর লোকেরা।
গল্প শুনে নূরা পাগলা কান্না জুড়ে দিলো। বললাম কিরে, কান্না করিস কেন?
- বুঝছি ভাই! আমাদের কয়লারানী চুক্তির নামে উন্নয়নের বশবর্তী হয়ে সব শেষ করে দিছে ভাই।
আমি কিছু বললাম না, মনগড়া হয়ে যেতো। শুধু একবার বললাম, "কয়লারানী কি জয় হো!"
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৯:০৬