দিব্যেন্দু মানে দেবুর আজ আর সময় মতো অফিসে যাওয়া যে হবে না, সেটা মনে হয় সকালেই টের পেয়েছিল। ঘুম থেকে উঠেই চোখ ফোলা দেখে বুজেছিল কপালে আজ ভালো কিছু থাকার নয়। যদিও দেরিটা হয়েছে একটাকা মূল্যের কয়েনের জন্য, কিন্তু চোখ ফোলার ব্যাপারটা ও কিছুতেই ভুলতে পারছে না। কয়েনের ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়, রাতে ফেরার পথে সিগারেট কিনতে বারো টাকা দিয়েছিল দোকানে, ফেরত পেয়েছিল একটা একটাকার কয়েন। কয়েন দেখে দেবু সেটা বাসায় এনে টেবিলের ড্রয়ারে রেখেছিল, না ওয়ার্ড রোবের উপরে রেখেছিল - সেটা মনে করতে করতেই পাঁচ মিনিট দেরি হয়ে গিয়েছিল সকালে। যদিও সামান্য বিষয়, কিন্তু দোকানে বারো টাকা দিলে, ওরা একটাকার চকোলেট ধরিয়ে দেয় কয়েনের বদলে, সেই চকোলেট কখনও মিষ্টি কখনও টকঝালের সমষ্টি আবার কখনও বা হজমেও লাগে। দেবুর এইসব একেবারেই অপছন্দ। দেবু যদি কিছু ঘৃণা করে তা হচ্ছে এই লজেন্স চোষা। আর লজেন্সের খপ্পরে পড়বে না বলেই কয়েন খোঁজা আর সেটা খুঁজতে গিয়ে অফিসে দেরি হওয়া।
কসাইবাড়ি মোড় থেকে বিমানবন্দর বাস স্ট্যান্ড সাকুল্যে এক কিলোমিটারের বেশি নয়। তীব্র তাপদাহে এতটুকু হাঁটতেই জামাকাপড় ভিজে গিয়েছিল ঘামে। বাস স্ট্যান্ডের পিছনে একটা চায়ের দোকানে বসে জিরিয়ে নিতে নিতে একটা সিগারেট কিনে ধরিয়ে দেবু অপেক্ষা করছিল ঘাম শুকানোর। দেবু আজ আর সময়মতো অফিসে পৌঁছাতে পারবে না, এটা মেনে নিয়ে টংদোকানে বসেছে, কী করা যায় ভাবতে। একটার পর একটা বাস যায়, দেবু ভেবেই যায়। সকাল সাতটার মধ্যে বাসে উঠতে না পারলে নয়টার আগে পৌঁছানো যায় না। আজ দেরি হয়ে গেছে, হবে নাইবা কেন? রাতে দু'দুবার বিদ্যুৎ ছিল না, একেকবার একেক ঘন্টা করে, মাঝে বিরতি দিয়ে। সারারাত ঘাম মুছে, শাপ শাপান্ত করেছে মানবজাতিকে।
মনে মনে অফিসে দেরিতে যাবার, একটা একটা যুক্তি খোঁজে দেবু, পরপরই আবার নাকচ করে দেয়। একবার ভাবে সত্যি কথাই বলবে অফিসে। বলবে যে, কয়েন খুঁজতে গিয়ে দেরি হয়ে গেছে অফিসে আসতে। কিন্তু দেবুর বস যেরকম মানুষ তাতে পরের কথা কী হবে সেটাও দেবু ভাবছে। এমনিতেই শৈবাল সাহেব রগচটা মানুষ, তায় আবার ক্যাডেটের ছাত্র। হুকুম পেতে পেতে এতদিনে 'বিদ্রোহ' করতে শিখেছেন। এখন নিজেই হুকুম দেন, প্রয়োজনে হুকুম বানিয়ে নেন। এ যাত্রা পেরোতে পারলে আরেকটা চাকুরি দ্রুত দেখে নিতে হবে। প্রতিদিন এত কথা শুনতে ভালো লাগে না।
দেবু একটা ট্রেডিং হাউসে চাকুরি করে। ইন্ডেন্টিং ব্যবসা। সোজা কথায় বললে, "দালালি করা"। একজনের উদ্বৃত্ত খুঁজে, অন্যজনের অভাব মেটানো। বৈচিত্র্য আছে, কিন্তু এই শালার কমিশনের ফাঁফরে পড়ে জেরবার অবস্থা। ভাইয়ে ভাইয়ের ব্যবসায় কমিশন খাচ্ছে, বন্ধু বন্ধুকে পিঠে ছুরি মারছে, ছেলে বাপের ব্যবসা লাটে উঠাচ্ছে। এদিকে দেবুর বস আর ব্যাংক এর লোকজন মিলে হরিলুট করছে। দেবুদের ইন্ডেন্টিং মূলত ক্যাপিটাল মেশিনারি। এক একটা মেশিনের দাম সাত লাখ ইউরো, পাঁচ লাখ ইউরো। দুটো মেশিন বেঁচো, বছরজুড়ে খাও। দেবুদের আবার ইনটেনসিভ ব্যবস্থা আছে। দেড় মিলিয়নের উপরে বেঁচলে পুরোটার উপর শতকে একটাকা করে পাবে। বিশ লাখ ডলারের মতো অর্ডার পেলে পকেটে ষোল লাখ টাকা অতিরিক্ত। তাছাড়া বেতন বোনাস তো আছে। কষ্টের মাঝে শুধু এই অফিস যাওয়া, ক্লায়েন্টদের তুষ্ট রাখা আর বিক্রিত মেশিনের দেখভাল করা। সেও করে নিচ্ছিল দেবু, কিন্তু যতই ব্যবসা বাড়তে লাগল, দেবুর পরিচিতও বাড়ছিল।যেখানে আগে বসকে নিয়ে যেতে হয়েছে, সেখানে দেবুই ডিল করছিল। কিন্তু এই কমিশন কমিশন খেলায় দেবু কিছুতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিল না। কোটেশান থেকে একলাখ কমিয়ে রাখো, সেইটাকা ক্যাশ পৌঁছে যাবে হাতে হাতে, কিংবা ব্যাংক লোন দিয়ে মেশিন কিনেছে, দরদাম বাড়িয়ে দেখাও। প্রজেক্ট চলুক বা না চলুক, টাকা তো চলে এসেছে হাতে। ব্যাংকের তো আর সমস্যা নেই, মেশিন নিলামে উঠাবে, নয়ত পুরো প্রজেক্ট। কিছু হোক বা না হোক, তাতে কার কী! ফাঁকতালে চাকুরি হারিয়ে কারো কারো সংসার ভাঙ্গে, কেউ কেউ আত্মহত্যা করে, অনেকেই জায়গা জমি বেঁচে মধ্যপ্রাচ্য, নয়ত পালিয়ে ইটালি, গ্রিস, সাইপ্রাস আর নয়ত পড়াশোনার নাম দিয়ে যুক্তরাজ্যে আসন গাড়ে। অত্যুৎসাহী কেউ কেউ আবার জিহাদি যোশে ইরাক, আফগানিস্তানে যুদ্ধ করে। দেশে থাকা মানেই পদেপদে মানিয়ে নেয়া, অন্যায়কে নিয়ে প্রতিদিন ফেরি করা, স্বার্থসিদ্ধির জন্য যখন যাকে সম্ভব ব্যবহার করা।
দিব্যেন্দু এমন এক দেশে থাকে, যেখানে নিজের আখের নিজেকেই গোছাতে হয়। যার যত সহায় সম্পত্তি তার সম্মান তত বেশি। পার্থক্যের মধ্যে দেবুদের নিজের কাজ নিজে করতে হয়, আর ধনীদের একই কাজ করতে দেবুর মত লোক লাগে। এক একটা ব্যবসায়ী যেন পাকা রাজনীতিবিদ, এক একটা রাজনীতিবিদ যেন পোড় খাওয়া অর্থনীতিবিদ, এক একটা অর্থনীতিবিদ যেন এক একটা জোঁক। রক্ত শুষে নেবার কত রকম তরিকা যে ওরা জানে সে ভগবান বলতে পারে। এদের সম্মান যেন দেবতাদের চাইতে কম নয়। গ্যাট হয়ে বসে আছে সমাজের উঁচুতলায়। হুকুম দেয় শুধু, সেই হুকুম পালন করার জন্য বসে আছে বিরাট এক বাহিনী, দলিল দস্তাবেজ নিয়ে। এরা শিক্ষিত, এতই শিক্ষিত যে এরা রাতকে দিন, পুকুরকে নদী, নদীকে প্রয়োজনে সমুদ্র বানিয়ে ফেলে। এরা মূলত দেশের সবকিছুর দেখভাল করে। এই যে দেবু শুধু এক টাকা মূল্যের কয়েনের জন্য অফিসে দেরি করেছে, এসবেও তাদের অবদান আছে।
আরো একটা বাস দেখে দিব্যেন্দু। নাহ্ কোন সিট নেই। কোটার সিট ভরা। দেশে এত মানুষ কোটায় চলে দিব্যেন্দু ভাবতে পারেনা। চাকুরিতে কোটা, টিকেটে কোটা, মন্ত্রী কোটা, এমপি কোটা, পার্টি কোটা, পরিচিত কোটা, ক্ষমতার কোটা, মাস্তান কোটা, ব্যবসায়ী কোটা - কোটায় কোটায় ভরপুর দেশ। দেবু হিন্দু ধর্মের, এখন ওর জন্যে যদি বাসে বিধর্মী কোটা বা সংখ্যালঘু কোটা থাকত তবে বেশ হতো। অন্তত বাসের ধকল সামলাতে হতো না। গতকাল বাসে উঠে সিট না পেয়ে মগবাজার পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যেতে হয়েছিল। বাসের বেয়াল্লিশ সিটের নয়টাই মহিলা আর প্রতিবন্ধী কোটা। কিছু আছে ছাত্র কোটা। বাসে উঠেই এমন সব আলাপ করতে থাকবে, আপনাকে নিতান্তই বধিরের মত কিছুই না শোনার ভাণ করে সিট ছেড়ে দিতে হবে। আর কিছু লোক আছে যাদের দেখলে দেবুর হিংসে হয়। কী লম্বা চওড়া মানুষ, এক একজন যেন প্রাগৈতিহাসিক কালের মানুষ। এরা জানালার পাশের সিটের কোটায় জায়গা করে নেবে। আপনাকে করিডোরের পাশের সিটে বসে যাত্রী আর চেকারদের নিয়ত ঘষাঘষি মেনে নিতে হবে। তাও ভাগ্য যে ইদানিং আর মুক্তিযুদ্ধ কোটায় বাসে কেউ উঠে না। মুক্তিযোদ্ধারা আর যাইহোক, দেবুদের কষ্ট খানিকটা হলেও বুঝে। আর সবশেষে খেলোয়াড় কোটা তো আছেই। নাহ্ ফেসবুকে একটা জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে ভাবে দেবু। সংখ্যালঘু কোটা না হিন্দু কোটা - কোনটা লোকে খাবে সেটা নিশ্চিত হলে একটা স্ট্যাটাস দিয়ে রাখবে। কারো না কারো তো চোখে পড়বেই। আর একবার যদি নজরে পড়ে, কেল্লাফতে। দেবুর আইডিয়ার স্বত্ব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। শুধু অফিসে যেতে পারলেই বাঁচে।
আরো কতক্ষণ বসে জগত জীবনের নানা হিসাবে ব্যস্ত থাকে দেবু। একটা বাস আসে, কিছুটা ফাঁকা দেখে চট করে উঠে পড়ে। সামনে কোটা ফিলাপ হয়ে গেছে, পেছনেও নেই। না, একটা সিট আছে অবশ্য, কিন্তু একটা মেয়ে বসে আছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হবে। জানালার পাশের সিটটা ফাঁকা রেখে বসেছে, করিডোরে। বসতে হলে মেয়েটাকে উঠিয়ে বসতে হবে ভেবে দেবু, অস্বস্তি বোধ করে। দুনিয়ার আরো অনেক বিষয়ের মত নারী বিষয়ে দেবুর একটা অযাচিত সংকোচ কাজ করে। দোনোমনা করে আস্তে আস্তে এ সিট ও সিট আঁকড়ে ধরে বাসের শেষভাগে এগোয় দেবু। কাছাকাছি যেতেই মেয়েটি সিট ছেড়ে জানালার ধারে গিয়ে বসে। দেবু বিগলিত হাসি দিয়ে বসে পড়ে ফাঁকা সিটে। 'ধন্যবাদ' শব্দটা যেভাবে বেরোয় তার মুখ দিয়ে, নেড়ি কুকুরের কুঁইকুঁই এর মতো শোনায়। বাস ছেড়ে দিলে খোলা জানালা দিয়ে আসা হাওয়ায় মেয়েটার চুল উড়ে আসে, তীব্র একটা গন্ধ দেবুর নাকে ধাক্কা মারে। চোখ বন্ধ করে দেবু যেন দেখতে পায় বাড়ির কোন পুরানো দৃশ্য। কী একটা ফুলের সুবাস ভেসে আসে যেন! ফুলের নাম মনে করতে না করতেই, চেকার এসে জিজ্ঞেস করে, "এয়ারপোর্ট থেকে কেডা উঠছেন, ভাড়া দেন মামারা"। দেবু মানিব্যাগ বের করে পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট আর খুঁজে পেতে না পেয়ে দুটো দুই টাকার নোট ধরিয়ে দেয় চেকারকে। চেকার আবার জিজ্ঞেস করে, "কই নামবেন মামা"? দেবু ঢোক গিলে মগবাজার বলে সামনের সিটে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। চেকার সোজাসাপ্টা বলে ফেলে, "মামা, পনেরো টাকা ভাড়া, একটাকাও কম হইব না, এই লন আপ্নের চৌদ্দ টাকা"।
দেবু আবারও একটাকার কয়েনের কথা ভেবে আফসোস করে। সিগারেট কিনতে গিয়ে একটাকা মূল্যের কয়েনটা বিসর্জন দেয়া ঠিক হয়নি। এক টাকার কয়েনের জন্য নিজের জীবনের ভাললাগার অধিকারটুকু হারাতে চায় না দেবু। একটাকা মূল্যের কয়েনের কাছে ভবিষ্যত কবে থেকে বাঁধা পড়লো ভাবতে ভাবতে দেবু আনমনা হতে থাকে। জানালা দিয়ে বেশ জোরে বাতাসেরা এলোপাথাড়ি আসা যাওয়া করে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০১৭ দুপুর ১:২৪