উত্তরের মৃদুবাতাসেও কাঁপন ধরিয়ে দেয়। সেই কাঁপনে ঠোঙ্গায় কেনা বাদাম হাত থেকে ছুটে পড়ে রাস্তায়। বাদামগুলো যেন মুক্তির অপেক্ষায় ছিলো, রাস্তায় পড়েই এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে থাকে। গুণে গুণে তুলবে নাকি আবার নতুন করে কিনবে ভেবে পায় না শুভ। একটা টোকাই, বস্তা হাত থেকে নামিয়ে একটা একটা করে বাদাম তুলে নিতে থাকে। আর শুভ তখনই অযথা চেঁচিয়ে উঠে "ওই তোরে কইছি টোকাইতে!"
টোকাইটা ভাবলেশহীন চোখে একবার দেখে শুভকে। দুই মুঠোভরা বাদাম দোকানদারকে দিয়ে বস্তা টেনে হাঁটা ধরে। শুভ যেন অপমানিত বোধ করে। আবার হাঁক দেয় -
- এই 'মাঙ্গির পোলা'।
টোকাইটা আবার শুভ'র দিকে তাকায়। এবারও কিছু বলে না। আবার হাঁটা ধরে ডানহাতে বস্তা কাঁধে। শুভ এই অবজ্ঞা মেনে নিতে পারে না। সে টোকাইটার পিছে দৌড়ে যায় আর এক ঝটকায় মাটিতে ফেলে দেয়। তারপর শুকতলা ক্ষয়ে যাওয়া বুট দিয়ে লাথি মারে টোকাইটার পায়ে। হঠাৎ এমন আক্রোশ পেয়ে বসে শুভকে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না যেন। আক্রোশ হবে নাইবা কেনো? কিছুক্ষণ আগেই চাকুরি থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে ওকে।
শুভ'র কাজের সুনাম আছে। কিন্তু কোম্পানির অবস্থাও করুণ হয়ে পড়েছে। কোনমতে ঠেলেঠুলে দিন চলছে। শুভ একটা বেকারি আইটেম কারখানার বাজার ব্যবস্থাপনায় ছিল। বিস্কিট, কেক, পেস্ট্রি, পাউরুটি, চানাচুর - এ জাতীয় পণ্য বাজারে চালু করে দিয়ে সেগুলোর দেখভাল করা, নতুন বাজার ধরা আর দিনশেষে হিসাব মিলিয়ে পরেরদিনের স্টক ব্যবস্থা করাই ছিল শুভ'র কাজ। একটা দুইটা নয়, ক্রমে ক্রমে বাহান্নটা আইটেম নিয়ে বাজারে দৌঁড়েছে। রাত নেই দিন নেই খেটেছে। ইদের সময় ছুটি নেয়নি। সব দিয়ে থুয়ে, সবাইকে বিদেয় করে তবেই বাড়ি গিয়েছে। একদিন থেকে আবার ফিরেও এসেছে। মানুষ একদিন কাপড় ছাড়া থাকতে পারে, গান শোনা ছাড়া বাঁচতে পারে, নামাজ রোজা কাযা কাফফারা দিতে পারে, কিন্তু বিস্কিট, চা, চানাচুর ছাড়া চলতে পারে না।
কিন্তু আজ চলে আসার সময় শুধু মনে পড়ছিল, কাল থেকে কেউ ফোন করে যখন দশ প্যাকেট সেমাইয়ের কথা বলবে, অল্প দামের মচমচা টোস্ট বিস্কিটের কথা বলবে, তখন তাদের কী বলবে! এসব ভাবতে ভাবতেই দশ টাকার বাদাম কিনেছিল শুভ। আর উত্তরের বাতাস এসে সব বাদাম ফেলে দিল, তারপর টোকাই আর এখন তার পা লেগে আছে টোকাইটার গায়ে। যেন মানবতা অপেক্ষা করছে, মানুষের মৃত্যুর।
টোকাইটা হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। গা থেকে ধুলো ঝেড়ে বস্তা কাঁধে ফেলে পা বাড়ায় সামনে। আশেপাশের মানুষ কিছুটা বিরক্ত হয়, ভেবেছিল আরো কিছুক্ষণ মারপিট চলবে। কেউ কেউ আবার এসব নাটক বলে ভ্রুকুঞ্চন করে অন্য আলাপে মনোযোগ দেয়। শাকিব-অপু আর তাদের বাচ্চা নিয়ে ওদের আলাপ জমে উঠে। শুভ টোকাইটার হাত ধরে রাস্তার পাশে দাঁড়ায়। অপরাধবোধ অনুতপ্ততায় মোড় নেয়, টোকাইটাকে নিয়ে আবার বাদাম বিক্রেতার কাছে ফিরে আসে। আরো দশটাকার বাদাম কিনে পাশেই ফুটপাথের পেভমেন্টে বসে পড়ে দুজন।
শুভ জিজ্ঞাস করে, 'তোর নাম কী রে?"
- আমার নাম ভাই মোতালেব মিঞা। মায়ে ডাকে ময়না।
- মাথা আউলা ছিল রে, কিছু মনে নিস না।
- মনে করুম ক্যা! সকাল বিকাল কেউ না কেউ তো মারে। মসজিদে তবারক চাইতে গেলে দৌড়ান দেয়, দোকানে পুরাণ সিংগারা চাইলে মা বাপ তুইলা গালি দেয়, কারো কাছে হাত পাতলে হেরা বিরক্ত হয়। আর বোতল টোগাই যখন তখন দোকানদাররা খেদায়া দেয়।
- তোর ঘরে কে আছে রে?
- খালি মায়ে আছে।
- তোর মা কিতা করে?
- বাড়ি বাড়ি কাম করে, আর বাজারে গরুর নাড়িভুঁড়ি পরিস্কার কইরা দিলে পঞ্চাশ ট্যাকা পায়।
- ক্যান, গার্মেন্টসে কাম করবার পারে না?
- গেছিল, আমাগ বস্তির একটা ব্যাডা কাম করে। মায়ে গেছিল হের কাছে। হেয় কয় বিয়া করতে অইব, এর লাইগা মায়ে আর গেছে না।
- আহারে!
- তুই লেহাপড়া করছ না?
- বস্তিত ইস্কুল আছিল একটা। হেইডা ভাইঙ্গা দিছে। বস্তি যে চালায় হেরা অইহানে আড্ডা দেয়। আফনে কিতা করেন?
- আমি, আমিও আইজ থিকা তোর মত টোকাই। আগের সব ভুইলা গেছি।
- আফনে দেহি জামা জুতা পরেন। আফনে চাকরি করুইন?
- করতাম রে! আইজ থাইকা বাদ দিয়া দিছে!
- কিতা করছিলেন? মারছিলেন নি কাউরে?
- নারে! মালিকের ট্যাকা পয়সা কইমা গেছে। দেনা হইয়া গেছে সরকারের কাছে। ব্যবসা চালাইতে পারে না। দোকানিরা মাল চাইলে দিবার পারে না।
- আহারে!
শুভ আর টোকাই দুজনেই হেসে ওঠে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০১৭ দুপুর ১:১৯