somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মিষ্টি

১৯ শে জুলাই, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



হ্যালো, তুই কোথায় আছিস?

- হ্যালো, মেয়েকে স্কুলে দিতে আসছি। কিছু বলবি?

না থাক, শেষ হলে ফোন দিস। দরকার আছে।

আবির কিছুটা উৎকণ্ঠা নিয়ে ফোন রেখে পকেট হাতড়ে সিগারেট বের করে জ্বালায়। উদ্বিগ্ন হলে সিগারেট টানা আবিরের ইচ্ছাবিশেষ। দিনকাল ভাল যাচ্ছে না। একেতো বেকার, তার উপর গরীবের ঘোড়ারোগ হিসেবে সাহিত্য চর্চা আবিরকে ক্রমান্বয়ে বাস্তবতা থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। একবার ভেবেছিল এই জগত ছেড়ে দেবে, কিন্তু বানিয়ে বানিয়ে গল্প কবিতা লেখার যে সুখ, সেই সুখ তো আর কোথাও পাওয়া যাবে না। সিগারেটে আরো দুটো টান দেয় আবির। একটা লাইন মাথায় ঘুরঘুর করছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কবিতা লেখার মজাই আলাদা। আবিরের মুখে অসহায় একটা হাসি ফুটে ওঠে।



- মা, কে ফোন দিয়েছিল?

- ওহ্, আবির, আমার বন্ধু। ওই যে একবার কফিশপে দেখা হয়েছিল তোমার স্কুলের পাশে, সেই।

- আবির চাচ্চু ভাল আছে?

- তাইতো! এই কথা তো জিজ্ঞেস করিনি। আচ্ছা তোমাকে ক্লাশে দিয়ে তারপর ফোন দিয়ে জেনে নেবো।

- আচ্ছা মা, তুমি কী এখন হেঁটে বাসায় যাবে না রিক্সা নেবে?

- কেনো রে! রিক্সা নিয়েই চলে যাবো!

- এমনিতেই মা। আচ্ছা আজ কিন্তু আধাঘণ্টা আগে ছুটি হবে। তোমার আসতে দেরি হবে?

- না দেরি হবে না মা। আমি আগেই এসে থাকবো।

- আচ্ছা মা, আমি ক্লাসে যাই।

- ঠিক আছে মা।



মেয়েকে স্কুলে দিয়ে বেরোতেই কল্পনার ফোন। কল্পনা ওর স্কুলের বন্ধু। সাধারণ মেয়ে। সবাই ভাল জানে। টুকটাক লেখালেখিও করে। কিন্তু কেমন শান্ত সমাহিত চেহারা, দেখলেই না মায়া লাগে।

- হ্যারে জল্পনাকল্পনা, বল কেমন আছিস?

- এই শোন তুই আজ ছায়ানটে আসছিস তো?

- কেনো? আজ কেনো?

- কী বলিস, তুই কিছু জানিস না নাকি? আবির বলে নি কিছু?

- ওরে। আবির তো ফোন করেছিল। আমি বলেছি পরে ফোন করব। তোর সাথে শেষ করেই ফোন দিচ্ছি।

- আমার সাথে পরে বললেও চলবে। এক্ষুনি একটা ফোন দে ওকে।

- আচ্ছা দিচ্ছি এখুনি।



অভ্যাসে হাতের কব্জিতে চোখ যায় আবিরের। সময় দেখার হাজারো যন্ত্র আর জানার মাধ্যম তৈরি হবার পরে কবে কখন যে ঘড়ি পরা ছেড়েছে, আবিরের আজ মনে নেই। মুঠোফোন বের করে দেখে, প্রায় পনেরো মিনিট হয়ে গেছে। এখনও ফোন করেনি। আরেকটু অপেক্ষা করবে না আবার ফোন করবে, এই দোটানায় থেকে আবির ডায়াল লিস্টে চোখ বোলাতে থাকে।

কাঙ্ক্ষিত ফোন আসতে দেরি হয় না। একবার রিং হতেই আবির ফোন ধরে। হ্যালো বলে থেমে যায়, কারণ অপর প্রান্তে প্রায় গোষ্ঠী উদ্ধার করে কেউ।

- এই তুই আমাকে বললি না যে আজ ছায়ানটে যেতে হবে সন্ধ্যায়। হারামি, কোন কাজের কথা তো তোর মুখে শুনি না। তখন ফোন দিয়েছিলি কেনো?

রাস্তায় গাড়ির শব্দে আর ধূলোয় মাখামাখি হতে হতে আবিরের মনে পড়ে শাহবাগে বইয়ের দোকানে বই কেনার কথা। সন্দেশ থেকে হাবীব স্যারের অনুবাদে আইজাক অসিমভের বই কিনে দেখছিল আবির। এমন সময় শাড়িপরিহিতা কজন মেয়ের আগমন ঘটলে সে একপাশে সরে পাতা উল্টিয়ে দেখতে থাকে। ইচ্ছা ছিল আরো দুয়েকটা বই কেনার। কিন্তু শাড়িপরিহিতা মেয়েদের কথার তুবড়িতে বেশ বিরক্ত হয়ে ভাবছিল বেরিয়ে যাবে। ঠিক এমন সময় তাদের মধ্যে একজন কোন একটা বই খুঁজে না পেয়ে দোকানিকে বলছিল, "ভাইয়া, আইজাক অসিমভের ফাউন্ডেশানটা কি এসেছে?" দোকানি ইতস্তত করে বলেছিল, শেষ এক কপিই ছিল, একটু আগেই উনি (আবিরকে দেখিয়ে দিয়ে) নিয়ে নিলো। যিনি বইয়ের খোঁজ করছিলেন, তিনি মুখ ফস্কে বলে ফেললেন, "শালা, আমার মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে গেলো!"

আবির দোকানে দাঁড়িয়ে সবই শুনছিল। কতইবা তার বয়স তখন। মাত্রই বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় পা রেখেছে। একসাথে বইয়ের দোকানে শাড়িপরিহিতা মেয়েদের দেখে যে আগ্রহ ফুলে ফেঁপে উঠেছিল, তা চুপসে যেতে দেরি হয়নি ওকথার পরে। বদলে কী একটা চাপা রাগ মাথায় বনবন করা শুরু করে দিয়েছিল। একবার ভেবেছিল দু একটা কথা সেও মুখের উপর বলবে। কিন্তু সে সুযোগও সে পেলো না। তার আগেই সেই গালি দেয়া মেয়েটি, সে পর্যন্ত আবিরের জীবনে দেখা সেরা হাসিটা হেসে এগিয়ে এসে বলেছিল, "আপনি কী অসিমভের ভক্ত। আমার দারুণ লাগে। জানেন গত সপ্তাহে একবার এসেছিলাম, ফিরে গেছি না পেয়ে। আজও পেলাম না।"
আবির - এই প্রথম তাকে কেউ এভাবে বলল বলে, নাকি একই লেখার ভক্ত বলে, অথবা শাড়িপরিহিতা মেয়েটির হাসি তাকে দুর্বল করে দিলো বলেই কী না প্যাকেটে নেয়া বইটি তার হাতে দিয়ে বলেছিল, "ভাল থাকবেন"। তারপর চোখকানমুখ লাল করে দোকান থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। বাকি মেয়েদের হাসি নাকি সেদিন কাঁটাবন পর্যন্ত শোনা গিয়েছিল।

তারপর বিষয়টা একেবারে দক্ষতার সাথে সারা হয়েছিল। মেয়েটি দোকানে নাম, বাসার ঠিকানা, ল্যান্ডফোনের নাম্বার রেখে এসেছিল, আর বলে দিয়েছিল - আবার যদি ছেলেটা (আবির) আসে, যেন যোগাযোগ করতে বলে। আবির এসেওছিল, সেই নাম্বারে ফোন করে তার বইও নিয়ে এসেছিল। আর এমনি করেই একদিন আবির আর সেই মেয়েটির দারুণ একটা বন্ধুত্বেরও শুরু হয়েছিল। তবে যেদিন সেই মেয়েটি আবিরকে দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেস করেছিল আবির অসিমভের লেখা পছন্দ কেন করে, আর উত্তরে আবির বলেছিল, "আরে ধ্যাত। আমি হাবীব স্যারের ছাত্র, উনার সব অনুবাদ আমার সংগ্রহে আছে, সেইজন্যেই আমি ওই বইটি কিনেছিলাম" - সেটা শুনে দুম করে একটা কিল উপহার পেয়েছিল মেয়েটির কাছ হতে।

- এই আবির কথা বলছিস না যে! কী হয়েছে, তুই কোথায়?

স্মৃতির পাতা থেকে একলাফেই বেরিয়ে এলো আবির।

- এই কিছু না। ছায়ানটে যাবার জন্য ফোন দিয়েছিলাম। স্কুলে যাচ্ছিস তাই আর ঝামেলা করিনি। পারবি যেতে?

- পারা কী যায়! স্কুল, সংসার, রান্নাবান্না এসব করে আবার ছায়ানট!

- হুম। তা ঠিক। তবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে দোষ কী? মধ্যবিত্তের অহংকারের জায়গাটাই তো এখানে।

- আর পারি না রে! একটু নিজের জন্য সময় করে উঠতে পারি না।

- পারবি পারবি আজ চল। গেলেই দেখবি ভাল লাগবে।

- আচ্ছা একটু দেরি হবে, ঠিক আছে।

- হ্যা ঠিক আছে। তাহলে সন্ধ্যায় দেখা হচ্ছে।

ফোন রেখে দিয়ে আবির আরেকটা সিগারেট ধরায়। সংসারী একটা মানুষ যখন তার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠে নিজেকে মেলে ধরে চারপাশে সে সৌন্দর্য অসহনীয়। রাস্তার ধূলো, ধোঁয়া, আর গাড়ির তীব্র ভেঁপুকে একপাশে মুড়ে রেখে আবির চায়ের দোকানে গিয়ে বসে। আরেক কাপ চা দিতে বলে সিগারেটে জোরে টান দেয় সে। আজ স্বপ্ন পূরণের দিন। আজ তাদের লেখা যৌথ কবিতার বইয়ের অডিও প্রকাশের সফলতার চূড়ান্ত দিন। ছায়ানটে আজ সেই চুক্তি হবে। মিষ্টির জন্মদিনে এর চাইতে আর বড় উপহার আর কী হতে পারে! মনে মনে 'শুভ জন্মদিন' বলে আবির চায়ের কাপে আয়েসি চুমুক দেয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:১১
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৫:৫৭

একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।

কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।

ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

Grameen Phone স্পষ্ট ভাবেই ভারত প্রেমী হয়ে উঠেছে

লিখেছেন অপলক , ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৯



গত কয়েক মাসে GP বহু বাংলাদেশী অভিজ্ঞ কর্মীদের ছাটায় করেছে। GP র মেইন ব্রাঞ্চে প্রায় ১১৮০জন কর্মচারী আছেন যার ভেতরে ৭১৯ জন ভারতীয়। বলা যায়, GP এখন পুরোদস্তুর ভারতীয়।

কারনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কম্বলটা যেনো উষ্ণ হায়

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭


এখন কবিতার সময় কঠিন মুহূর্ত-
এতো কবিতা এসে ছুঁয়ে যায় যায় ভাব
তবু কবির অনুরাগ বড়- কঠিন চোখ;
কলম খাতাতে আলিঙ্গন শোকাহত-
জল শূন্য উঠন বরাবর স্মৃতির রাস্তায়
বাঁধ ভেঙ্গে হেসে ওঠে, আলোকিত সূর্য;
অথচ শীতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পশ্চিমা ইসলামবিদ্বেষ থেকে বাংলাদেশের ইসলামপন্থি রাজনীতি

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৪৬


আমি যখন কানাডায় বসে পাশ্চাত্যের সংবাদগুলো দেখি, আর তার পরপরই বাংলাদেশের খবর পড়ি, তখন মনে হয় - পশ্চিমা রাজনীতির চলমান দৃশ্যগুলো বহু পথ পেরিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে আলো-ছায়ায় প্রতীয়মান... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×