১.
কথা প্রসঙ্গে রাজন বলল," ব্যর্থ হয়ে থাকে যদি প্রণয়ের এত আয়োজন আগামী মিছিলে এসো স্লোগানে স্লোগানে হবে কথোপকথন।"
'তুই সারাটা দিন শুধু কবিতা আর তত্ত্ব নিয়েই পড়ে থাকলি, এ গন্ডি থেকে বের হয়ে বাইরের পৃথিবীটা একবার দেখ।সাধারন মানুষ এত তত্ত্বজ্ঞানের ধার ধারে না, বাঁচা-মরার রড়াইয়ে টিকে থাকতে চায়'-বলল শাওন।
'আমি তোর কথার সাথে এতমত না।আমাদের স্বাধীনতা-যুদ্ধের দিকেই তাকিয়ে দেখ জনগণের কাছে যদি স্বাধীনতার অর্থ পরিস্কার না হত তবে কখনোই এত মানুষ একসাথে স্বাধিকার আন্দোলনে যোগ দিতে নামত না।মানুষ জানত, বুঝতে পেরেছিল তাদের কাছে তখন লড়াই করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ খোলা নেই ।আর সেটা সম্ভব হয়েছিল মানুষের কাছে নিজেদের অধিকার আদায়ের প্রয়োজনটা তুলে ধরতে পারার কারণেই'-বলল নিলয়।
'যে কৃষক ভাই সারাজীবন সবুজ বৃত্তের মাঠের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল,যে শ্রমিক ভাই দিনমান জীবনযাপনে একটু উত্তরণের চিন্তায় অস্থির, তাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ কোন তত্ত্বজ্ঞানের ফলাফল ছিল না; শুধুমাত্র মুক্তির আকাঙ্খায় তাদের কাম্য ছিল'-যোগ করল শাওন।
মু...........ক্তি (হেসে); তুই কি মনে করিস ৭১-এ মানুষ প্রকৃত মুক্তির স্বাদ পেয়েছে? মুক্তি বহু দূরের পথ রে ভাই, সে আকাঙ্খার স্বাদ বাংলাদেশ এখনো পায়নি। যে সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে মানুষ যুদ্ধে গিয়েছিল স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ কি তাদের সেটা দিতে পেরেছে? একদল পিশাচের হাত থেকে আরেকদল শোষকের হাতে ক্ষমতার পালাবদল।এটাকে যদি তুই মুক্তিযুদ্ধ বলিস আমি মানি না।৩০ লক্ষ শহীদের রক্তস্রোতে বয়ে চলা বাংলাদেশে এখনো শ্রমিককে তার ন্যায্য- পাওনা বেতনের দাবিতে আন্দোলন করতে হয়,এখনো কৃষকের মুখে নিজের হাতে ফলানো ধানের অন্ন উঠে না; ধর্মের নামে রাজনীতি যেখানে গা বাঁচানোর হাতিয়ার তাকে আর যাই হোক মুক্ত বাংলাদেশ বলা যায় না।৭১-এর শহীদদের এত ত্যাগ তিতিক্ষার ফল কি এই বাংলাদেশ ???
২.
পলাশীর মোড়, রাত ২.৩০টা।বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তিন যুবকের ক্রমাগত তর্ক-বিতর্ক কনকনে শীতের রাতেও কেমন যেন একটা উত্তাপের আভা ছড়ায়। রাজন,শাওন,নিলয় -গতানুগতিক জীবনধারায় চলার পক্ষপাতী নয় কিছুতেই; তারপরেও প্রচলিত সমাজব্যবস্থা আর বাস্তব্তার স্বার্থে তারা নিজেদেরকে মানিয়ে নেয় তথাকথিত ডিজিটাল বাংলাদেশের সাথে।স্বাধীনতাযুদ্ধ তারা দেখেনি কিন্তু তাদের চিন্তায়,চেতনায়,মননজগতে মুক্তির আকাঙ্খা প্রবল।সে আকাঙ্খা তৈরির প্রেরণা শুধু ৭১-ই নয়,শ্রেণীচরিত্রের নিদারুণ বৈষম্যও বটে।
৩.
বাড়ির পেছনের যেদিকটায় পুকুরঘাট তারই এককোণায় বটগাছের নিচে বসে আছে দুলাল মিঞা।আজকের দিনটা আসলেই তাঁর সারা শরীরে কাঁপন ধরে যায়। পান্জাবিরা যখন তাঁকে ধরে নিয়ে ব্রীজের উপর থেকে ফেলে দিল.........আর ভাবতে পারে না সে। কেন যে বেঁচেছিল সেদিন? লাল-সবুজের কাপড়টাকে যখন মিষ্টি কথার দাঁড়িওয়ালাদের গাড়িতে পতপত করে উড়তে দেখে তখন নিজের প্রতি বড় ঘেন্না হয় দুলাল মিঞার।সাড়ে-তিন হাত মাটিতে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় তাঁর।
রাজনকে এক নজর দেখলে বড় ভাল লাগে যেন নিজের অতীতকে দেখতে পায় দুলাল মিঞা।রাজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবার পর থেকে সাড়ে-তিন হাতের ইচ্ছেটা আরো প্রবল হয়ে উঠছে। পড়ন্ত বিকেলে পুকুরঘাটে নিজের ছায়া মিলিয়ে যাবার দৃশ্যটা বড় অদ্ভুত ঠেকে তার কাছে..........
৪.
কুত্তাটার মাথার খুলি উড়িয়ে দিয়ে খুব ভাল লাগল নিলয়ের। মা'র মুখ থেকে শোনা বাবার শেষ ভাল লাগাটা মাঝে মধ্যেই নিজের করে নিতে ইচ্ছে হয় নিলয়ের। সে ভাবতে থাকে আর হারিয়ে যায় ৭১-এর রণাঙ্গনে.....
"কিরে কী ভাবছিস? মুক্তি না স্বাধীনতা ?"-প্রশ্ন করে শাওন।
'ঘুণে ধরা সমাজের পালে ৭১ হয়তো আমাদের কিছুই দেয়নি, আবার অনেক কিছুই হয়ত দিয়েছে। বীর বাঙালি দেখিয়ে দিয়েছে শোষিতের আস্ফালন,হারিয়ে দিয়েছে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনীকে; হারাতে পারেনি শুধু সমাজের শোষকদের।শহীদের রক্ত অনেকখানি পথ আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে... আমরা সে পথে মানুষের মুক্তির পথ খুঁজে পেতে চাই।' বলল নিলয়
৫.
ভোরের সূর্য জানান দিচ্ছে প্রাত্যহিক নিয়মে ফেরার তাড়া। পলাশীর মোড়ে নিশিরাতের তর্কযুদ্ধ তাদের তিনজনকে নতুন করে ভাবায়।স্বাধীনতার পথকে মুক্তির পথে নিয়ে যাবার চিন্তায় তারা অস্থির হয়ে ওঠে।মুক্তিপথের তাড়নায় স্বাধীনপথে হাঁটতে থাকে তারা আর চিৎকার করে বলতে থাকে..............
"এখন যৌবন যার
মুক্তির পথ খোঁজার শ্রেষ্ঠ সময় তার" ।
(সমস্বরে..)
(কবিতাস্তবক কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত
সংগ্রহ : হেলাল হাফিজ)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১০ সকাল ৭:১৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



