প্রত্যেকটা মানুষেরই নিজের প্রশংসা শুনতে ভালো লাগে। আমারও লাগে। আমার বাবা-মা, আপ্পি, কেউই আমার প্রশংসা করতো না কখনও। আরও কেউ ছিল, যার মুখ থেকে বিশেষ কোন সময় বা উপলক্ষে আমি একটু প্রশংসা শোনার জন্য মুখিয়ে থাকতাম। কিন্তু তার কাছ থেকে প্রশংসা নামক ‘প্রসাদ’টা কদাচিৎ পাওয়ার ভাগ্য হত আমার। তার বদলে বরং তিরস্কার আর উপহাসই জুটতো বেশি। ভীষণ খারাপ লাগলেও মুখ বুজে হজম করতাম সেগুলো।
এভাবে প্রতিনিয়ত বিশেষ মানুষের কাছ থেকে তিরস্কার পেতে পেতে একসময় নিজেকে সে সব তিরস্কার আর উপহাসের দৃষ্টিতেই দেখতে লাগলাম। নিজের প্রতি দৃষ্টি আরও ছোট হয়ে এলো। আমি কুৎসিত, কথাটা তার কাছ থেকে ঘুরে ফিরে শুনতে শুনতে মনে হতে লাগলো আমি আসলেই বোধহয় কুৎসিত। নইলে সে বলবে কেন? ভুলে গেলাম এক সময় এই ‘কুৎসিত’ রূপ দেখেই সে আমার প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছিল। ভুলে গিয়েছিলাম, এখন আমার যে সব বৈশিষ্ট্যের দিকে সে আঙ্গুল তুলছে, একসময় সে সব বৈশিষ্ট্যই আমার প্রেমে পড়ার জন্য তার কাছে যথেষ্ট ছিল। ভুলে গিয়েছিলাম তার সাথে সম্পর্কে জড়ানোর আগে আমি কতজনের প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছি; এমনকি তার সাথে সম্পর্ক হওয়ার পরও!
মনে পড়লো আমাকে সে তিরস্কার আর অবিশ্বাসের শেষ মিলিত আঘাতটা দেয়ার পর, আমার বিশ্বস্ততাকে বারবার কিছু কিছু করে ছিঁড়তে ছিঁড়তে শেষ পর্যন্ত ময়লা কাগজের মত ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলার পর। ততদিনে বোধহয় আমার আত্মবিশ্বাসটা প্রায় পুরোটাই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তবুও যতটুকু বাকি ছিল তা নিয়েই ঘুরে দাঁড়ালাম, নিজের আর নিজের পরিবারের মান-সম্মান বাঁচানোর জন্য। তখন আমার পাশে এসে দাঁড়ালো আমার পরিবার আর হাতে গোনা দু’এক জন বন্ধু। তাদের দেয়া সাহস আর ভরসা আমাকে হতাশার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে সর্বোচ্চ সাহা্য্য করলো। তারা যখন শুনতে পেলো আমাকে করা তিরস্কার আর উপহাসের কথা, তখন তাদের খেয়াল হলো, আমি আসলে সেই নোংরা আর ফালতু কথাগুলোর যোগ্য নই। তারা নিজের সম্পর্কে আমার ভুল ধারণাগুলো ধরিয়ে দিতে থাকে। বহু বছর পর আমি আবার ভালোবাসতে শুরু করি নিজেকে, নিজেকে মূল্য দিতে থাকি। এতদিন যাকে ভালোবাসতে গিয়ে নিজেকে ভালোবাসতে ভুলে গিয়েছিলাম, সেই যখন আমার ভালোবাসাকে, আমার অন্ধবিশ্বাসকে গুরুত্ব দিলো না, তখন আর আমি কেন নিজেকে অবহেলা করবো?
(ছবি: http://writetribe.com/)
না। আর না। এখন আমি নিজেকে ভালোবাসি, আমার পরিবারকে ভালোবাসি। আর ভালোবাসি তাকে, যে আমাকে আমার জন্য ভালোবাসে, আমার বিশ্বাসকে গুরুত্ব দেয়, আমার পরিবারকে, আমার মাকে সম্মান করে। যে আমার ছোট ছোট বিষয়গুলো খেয়াল করে -- আমি চোখে কাজল দিলাম কিনা, পায়ে কোন পায়েলটা পড়লাম, আমার হাতে কোন রঙের চুড়ি কেমন রূপে ধরা দেয়.......তার প্রশংসার জন্য আমার অপেক্ষা করা লাগে না; সে আমার প্রশংসা করতে কোন উপলক্ষ খোঁজে না। যখন একেবারেই অপ্রত্যাশিত, তখনও হুট করে সে এমন কিছু বলে ফেলে, যা শুনে অবাক না হয়ে পারা যায় না। হয়তো প্রশংসাটা খুবই সামান্য, তবুও হঠাৎ করে পেয়ে মনের মাঝে অন্যরকম একটা সুখের উর্দ্রেক হয়।
মানুষের শারীরিক বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টি দরকার হয়। আর মানসিক বৃদ্ধির জন্য দরকার হয় ভালোবাসা, উৎসাহ ও প্রশংসা। শারীরিক বৃদ্ধি একসময় থেমে গেলেও মানসিক বৃদ্ধি আমৃত্যু হতে থাকে। তাই উৎসাহ, ভালোবাসা আর প্রশংসা সারাটা জীবনই খুব দরকার।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০১৫ সকাল ১০:১৮