somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক হিরোশিমা কন্যার অসাধারণ হয়ে উঠার গল্প

০৭ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ছোটবেলায় বাবা-মা আর ভাই-বোনদের সাথে আমি থাকতাম হিরোশিমার কাছের ছোট্ট একটা মফস্বল শহর সাক্কাতে। আমাদের বাড়িটা ছিলো সমুদ্রের একেবারে কাছে। সৈকতে বসে সূর্যাস্ত দেখতে আমার ভীষণ ভালো লাগতো। ভালো লাগতো বাগান থেকে ফুল তুলতে আর গ্রামময় ঘুরে বেড়াতে। কখনো আবার আমি উঠে যেতাম গাছের মগডালে, যেন সাগরের পানিতে রোদের ঝিকিমিকি মন ভরে দেখতে পারি।

হিতোশি, আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, গাছের নিচে আমার জন্য অপেক্ষা করতো। সেখানে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে গল্প করতাম, ভাবতাম বড় হয়ে আমরা কে কী করবো, কী হবো।

হিতোশিকে আমার খুব ভালো লাগতো। তাই হিতোশি যখন বললো বড় হয়ে ও লেখক হতে চায়, আমি বললাম, 'আমি তাহলে কবি হবো'।

৬ অাগস্ট। সেদিনের সকালটা ছিলো আর দশটা সকালের মতোই। স্পষ্ট মনে আছে, মা ঘরে ছিলো; আর আমি নাস্তা করে তৈরি হচ্ছিলাম কাজে যাওয়ার জন্য। হিরোশিমায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে কাজ করতাম আমি। বয়স মাত্র চোদ্দ, তবুও চাকরি করতাম। বেশিরভাগ ছেলেই তখন যুদ্ধে গিয়েছে, সবখানে লোকবলের অভাব। তাই আমার মতো ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ করে বিভিন্ন জায়গায় কাজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিলো।

আমি চারতলার একটা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক সেই মুহূর্তে তীব্র এক আলোর ঝলকানিতে আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। মনে হলো যেন আমার চোখের সামনে সূর্যটা আকাশ থেকে খসে পড়েছে! সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশ জুড়ে চারদিকে শুধু রংধনু খেলা করতে দেখলাম। সেটা আর কিছু ছিলো না, ছিলো এক পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ।



নিশ্চয়ই আমার জ্ঞান ছিলো না। কারণ এরপর যখন চোখ মেললাম, দেখলাম আমি আর জানালার কাছে নেই। টের পেলাম আমার মাথায় আঘাত লেগেছে। কীভাবে জানি না, আমি উঠলাম, নিজেকে টেনে নিয়ে গেলাম বাইরে। একজন মহিলা আমাকে হাসপাতালে যেতে সাহায্য করলেন। আশপাশে তাকিয়ে আমার সেই চিরচেনা শহরকে দেখতে পেলাম না। শহর আর শহর নেই। কোন বিল্ডিং নেই, নেই একটা কুকুর বা বিড়ালও। আকাশে উড়ছে না কোন পাখি বা প্রজাপতি। সব শেষ হয়ে গেছে। শুধু আছে কিছু মানুষ, আহত, গায়ে ছাই আর কালিঝুলি মাখা। এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।

পরদিন সকাল। ঘুম থেকে উঠেই মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়লো। হাঁটতে হাঁটতে ফিরে এলাম আমার শহরে। তখনও সবখানে শুধু আগুন আর আগুন। সাবধানে এগিয়ে গেলাম আমার বাড়ির দিকে, বা যেখানে আমার বাড়িটা ছিলো। কাছাকাছি গিয়ে দেখতে পেলাম তিনজন মানুষ আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। 'এটা কি সত্যিই তুমি??' প্রশ্ন করলো একজন। মানুষটি আমার মা। তার সাথে ছিলো আমার বড় বোন আর আমার ফুপু। আমার ভাইটাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। বিস্ফোরণের আঘাতে সে চলে গেছে না ফেরার দেশে। সবকিছু মনে হচ্ছিলো এক বিশাল দুঃস্বপ্নের অংশ। বুঝতেই পারছিলাম না ঠিক কী হচ্ছে।



বিশ বছর বয়সে আমি হিরোশিমা ছেড়ে চলে আসি। বহু বছর আমি হিরোশিমার ঘটনা নিয়ে কিছু বলতেই পারতাম না। কিন্তু আমার পরিবার আমাকে বোঝালো, যেন আমি আমার কাহিনী সবাইকে বলি। একসময় আমি কবিতা লিখতে শুরু করলাম। ছোটবেলায় হিতোশিকে বলেছিলাম আমি কবি হবো। কখনো ভাবিনি তা বাস্তবে রূপ নেবে।

পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তায় তীব্র মাথাব্যাথা, ক্লান্তিসহ আমার নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিতে থাকে। তবে টোকিওর ডাক্তাররা নিয়মিত আমার চিকিৎসা করতেন। একসময় আমি বিয়ে করলাম। আমার তিনটা ছেলে হলো। এখন আমার চারজন নাতি-নাতনিও আছে। আমি তাদের কাছে আমার জীবনের কাহিনী সবসময় বলি।

এতকিছুর পরও যারা আমাদের শহরে বোমা ফেলেছিলো, তাদের আমি ঘৃণা করি না। তাদের কারণেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, সব হারানোর পর মানুষ কতোটা অসাধারণ হয়ে ওঠে। কিন্তু আমি কখনো এটাও ভুলবো না যে, মানুষই মানুষের ওপর পারমাণবিক বোমা ফেলেছিলো।"



এই ছিলো ৮৪ বছর বয়সী বুন হাশিজুমে’র আত্মকথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা ‘লিটল বয়’ বিস্ফোরিত হয়। তখন বুনের বয়স ছিলো মাত্র ১৪ বছর। নিজের অসাধারণ সেই অভিজ্ঞতা এক সাক্ষাৎকারে এভাবেই তিনি তুলে ধরেছেন বিবিসি’র কাছে।

(লেখাটি গত ৬ আগস্ট হিরোশিমা দিবস উপলক্ষে বিবিসি’র একটি বিশেষ ইন্টারভিউ। চ্যানেল আই অনলাইনের জন্য ইন্টারভিউটি অনুবাদ করেছিলাম। সাইটের আসল লিংকটা সামু’তে দেওয়ার পর কাজ না করায় অনেকদিন পুরো লেখাটা এখানে দেবো দেবো করেও দেওয়া হচ্ছিলো না। তাই আজ দিয়েই দিলাম। হাশিজুমে’র কাহিনীটা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিলো। এ কারণেই এখানে শেয়ার করা...)
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১:০৩
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×