দিন যাচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে বয়স। তবুও মনের বয়স যেন বাড়তে গিয়েও বাড়ে না। কোথায় যেন আটকে যায়। ধীরে ধীরে মানসিকভাবে ‘ম্যাচিউর’ হওয়ার চেষ্টা করছি। আগে যে ছিলাম না, তা না। নিজের দায়িত্ব, মেয়ে হিসেবে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অনেক কিছু বুঝেশুনে চলা, কাছের মানুষগুলোর ভালো ভাবা, তাদের মন বোঝা, সব সম্পর্ক একসঙ্গে রক্ষা করে চলা...সবগুলোরই চেষ্টা চালিয়ে গেছি। কতোটা পেরেছি জানি না। কিন্তু মনে উপলব্ধি আসার পর থেকে চেষ্টার খুব একটা কমতি করেছি বলে মনে পড়ে না।
কিন্তু তারপরও মন থেকে নিজেকে ‘বড়’ ভাবতে পারিনি কখনও। ‘বয়স বাড়ছে, পরিবারে এবং সমাজে আমার ভূমিকা পাল্টে যাচ্ছে’, এসব চিন্তা মাথায় ধরাতে পারিনি ঠিকমতো। নিজের বয়সটাই অঙ্কের হিসেবে নিজের জন্য বড্ড বেশি ঠেকে!
বড় হওয়া মানেই মাথায় জটিল চিন্তার বাসা। আমার মাথায় তো ছোটবেলা থেকেই অনেক জটিল চিন্তা কাজ করতো। কিন্তু এতোটাও জটিলভাবে সেগুলো ধরে রাখতে পারিনি যেন বাস্তব জীবনে তা প্রয়োগ করা যায়। তাই বন্ধু-শত্রু নির্বিশেষে সবার সঙ্গে হেসেছি, আন্তরিক হওয়ার চেষ্টা করেছি। কেউ আমাকে অপছন্দ করে জেনেও একটু ভালোভাবে কথা বললেই মনে মনে কনফিউজ হয়ে ভেবেছি, ‘এটা কি সত্যিই অভিনয়? নাকি সে এখন আর আমাকে অপছন্দ করে না?’
এ কারণেই হয়তো মানুষ কষ্ট দেয়ার সুযোগও পেয়েছে খুব বেশি।
আমি মানুষকে খুব জলদিই বিশ্বাস করে ফেলি। আমাদের সমাজে এটা অনেক বড় একটা দোষ। কারণ সব মানুষ বিশ্বাসের যোগ্য হয় না। অনেকেই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে চরম অবিশ্বাস আর বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করে। তখন আর চোখ ভরে কান্না আর মন ভাঙ্গা যন্ত্রণা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। আমারও মন ভেঙ্গেছে। বার বার। বিভিন্ন সম্পর্কে, বিভিন্ন সময়ে, জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে। আমিও কেঁদেছি। দিনে, রাতে, চোখ ফুলিয়ে। কখনও কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছি, আবার কখনও ঘুম হারাম করে কেঁদেছি। কখনও আবার কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে যেতো। হয়তো অশ্রুর টেম্পোরারি স্টক শেষ হয়ে যেতো, তাই ভেতরে কষ্ট থাকলেও সেগুলো কান্না হয়ে বেরিয়ে আসতে পারতো না।
এসবের মধ্য দিয়ে আমি ছোট থেকে বড় হয়েছি; বড় থেকে আরও বড় হয়েছি, হচ্ছি। তবুও মনটা যেন বড় হতে চায় না। কষ্ট পেয়েও, ধোকা খেয়েও, অপমানিত হয়েও শিক্ষা হয় না। ন্যাড়া নাকি একবারই বেলতলায় যায়। আমার এক উপকারি বন্ধুর মতে এই প্রবাদবাক্যটি ভুল - ন্যাড়া বার বার বেলতলায় যায়। আমিও তার সঙ্গে একমত। কারণ হিসেবে আমার মনে হয়, ওই ন্যাড়া ব্যক্তি আমার মতোই কঠিন বিশ্বাসের অধিকারী। তাই একবার মাথায় বেল পড়ে মাথা ফাটলেও পরের বার যায় এই আশায়, হয়তো এবার বেল মাথায় পড়বে না। পড়লে হাতে বা নিচে পড়বে, আর সে সুস্থ দেহে আস্ত মাথায় পাকা বেল হাতে বাড়ি ফিরতে পারবে। পরে মজা করে বেলের শরবত বানিয়ে খাবে!
আমিও মনে হয় এমনই এক জাতের ‘ন্যাড়া’।
এতো বিশ্বাসঘাতকতা, কষ্ট, যন্ত্রণা আর অপমানের পরও আমি চোখ বন্ধ করে সেগুলো ভুলে থাকতে চাই। ছোট্ট বাচ্চারা যেমন ভয় পেলে চোখ বন্ধ করে ভাবে ভয়ের কারণ উবে গেছে। বড় হতে চাই না আমি। কিন্তু তাই কি আর হয়? না চাইলেও চোখের সামনে সব দেখতে হয়, সব সইতে হয়।
ছোট থেকে বড় হতে হতে আশপাশের মানুষ আর পরিবেশে অনেক পরিবর্তন দেখেছি। কাছের মানুষগুলোর চোখে যেমন দেখেছি, তেমনি দূরের মানুষের চোখেও। বাবা-মায়ের চোখে কখনও দেখেছি আমায় নিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন, দায়িত্ববোধের আকাঙ্ক্ষা, কখনও দেখেছি আমায় নিয়ে গর্ব, কখনও আবার দুশ্চিন্তার ছায়া। পরিচিত-অপরিচিতদের চোখে কখনও দেখেছি মুগ্ধতা, কখনও সন্তুষ্টি, কখনও প্রশংসা, কখনও প্রশান্তি, ভালোবাসা, আবার কখনও বিরক্তি, কখনও কষ্ট, ঘৃণা, অভিনয়, তিরস্কার, এমনকি কখনও ভিন্ন কিছুর তীব্র আকাঙ্ক্ষা। তাদের চোখের দৃষ্টি কখনও আমাকে সাহস জুগিয়েছে, সুখ দিয়েছে, মনে এনেছে আত্মবিশ্বাস; কখনও আবার অস্বস্তি, বিরক্তি, অপমান আর ঘৃণায় কুঁকড়ে দিয়েছে চেতনাকে।
এসব দৃষ্টি প্রতিক্ষণে আমাকে ভাবতে বাধ্য করেছে, আমি আর সেই ছোটটি নেই। যতোই এখনও কার্টুন দেখি, রোমান্টিক গল্পের বদলে সায়েন্স ফিকশন আর ভৌতিক উপন্যাস নিয়ে পড়ে থাকি, যতোই মনে হোক না কেনো, এই তো সেদিন মাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম, খুব বেশিদিন তো হয়নি; ফার্স্ট বেঞ্চে বসা নিয়ে কতো ঝামেলা করতাম!
যতোই ভাবি আমি ছোট, যতোই যাকে তাকে ‘ভাই’-এর বদলে ‘আঙ্কেল’ ডেকে বসি, সত্যি কিন্তু এই-ই: মানুষগুলোর দৃষ্টি পাল্টে গেছে আমার প্রতি। ওই মানুষগুলোকে আর কী দোষ দেবো? আমার নিজের দৃষ্টিও যেন নিজের প্রতি পাল্টে গেছে। প্রায়ই নিজেকে ভিন্ন চোখে দেখি। ভিন্ন ভিন্ন মানুষকে দেখি ভিন্ন চোখে, ভিন্ন রঙে। এখনও বোকার মতো, ছোট শিশুদের মতোই সাতপাঁচ না ভেবে মানুষকে বিশ্বাস করে ফেলি। কিন্তু নিজেকে থামাতে না পারলেও এখন অন্তত বুঝতে পারি এভাবে বিশ্বাস করা ঠিক না। এগুলোই মনে হয় ছোট থেকে বড় হওয়ার লক্ষণ।
আমি বড় হয়ে গেছি। অন্যদের কাছে পুরোপুরি। নিজের কাছেও বেশ কিছুটা।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:০৯