আগেও একদিন বলেছিলাম আমার নূপুর-প্রীতির কথা, একজোড়া রূপার নূপুর পেতে আমার মনটা যে কেমন আনচান করে সে কথা বলেছিলাম। নিজে কিনতে পারলেও এখনো কিনিনি এই আশায় যে কেউ আমাকে একজোড়া নূপুর উপহার দেবে।
বলেছিলাম কেউ রূপার নূপুর উপহার না দিলে হয়তো আর কিনবোই না। কারণ নিজে কেনা আর উপহার পাওয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। কিন্তু পরিচিত একজনের কথায় মনে হলো এটা ঠিক না। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘কেউ দেবে না বলে কি তুমি তোমার শখ পূরণ করবে না?! জীবনে এতো আশা করতে হয় না। জীবনের প্রতি, অন্যের প্রতি যত বেশি আশা রাখবে, তত বেশি কষ্ট পেতে হবে তোমাকে।’
আমি ভেবে দেখলাম, ঠিকই তো। অন্যরা আমার ছোট ছোট শখের কথা ভাববে না বলে কি আমি আমি নিজেও ভাববো না?? নিজের চেয়ে ভালো বন্ধু নিজের আর কে আছে? কেউ না দিলে আমি নিজেই নিজেকে নূপুর কিনে উপহার দেবো।
আম্মু-আব্বুকে বললাম, আমি রূপার নূপুর কিনবো। তারা বললো, ‘যেও, কিনে নিয়ে এসো একদিন।’ শক্ত হয়ে বলেছিলাম ঠিকই। কিন্তু মনে মনে ঠিকই ভেবেছিলাম, হয়তো আমার মুখ থেকে নূপুর কেনার কথা শুনে তারাই বলবে, ‘তুমি কিনবে কেনো? আমরা কিনে দেবো। সাথে চলো মার্কেটে একদিন।’ কিন্তু কীসের কী?! একই সঙ্গে তাজ্জব এবং হতাশ হলাম!
তাই এবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলাম, যেভাবেই হোক, নূপুর এবার আমি কিনবোই! নিজেই কিনে নিজেই পরবো! লাগে না কাউকে আমার! লাগে না কারো গিফট!
কিন্তু বিধিবাম! কপালদোষে বিনাকারণে প্রচণ্ড পা ব্যথা নিয়ে হঠাৎ করেই বিছানায় পড়লাম। ডাক্তার পরীক্ষা করে, ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট দেখে কোনো কারণই খুঁজে পেলো না। তাই আমাকে গিনিপিগ বানিয়ে হাই পাওয়ারের পেইনকিলার আর স্টেরয়েড দিয়ে পরীক্ষা চালালো। পুরো দু’সপ্তাহ বিছানা ছেড়ে প্রায় নড়তেই পারলাম না।
এরপর ব্যথা একটু কমার পর যখন ক্রাচ নিয়ে হাঁটার একটু একটু চেষ্টা করতাম আর ব্যথায় কাঁদতাম, তখন একসময় মনে হতে লাগলো, আমি হয়তো আর কখনোই ঠিকভাবে হাঁটতে পারবো না। এটা ভেবে আরো কান্না পেতো। এমনিতেই ছিলাম তখন ভীষণ মানসিক যন্ত্রণায়। তার ওপর এহেন শারীরিক যন্ত্রণা আর তার থেকে উৎপন্ন আরেক দফা মানসিক যন্ত্রণা - সব মিলিয়ে পুরো কাবু হয়ে গেলাম।
তখন বার বার মনে হতো, হাঁটতেই যদি না পারি, নূপুর কিনবো কীভাবে? আর কিনেই বা কী হবে? কখনো কি আর সেই নূপুর পরে ঝুনঝুন করে হাঁটা হবে? বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নাচা হবে? পরের অপেক্ষায় থাকতে গিয়ে সারাজীবনের জন্যই আমার সাধ অপূর্ণ রয়ে গেলো!
আমার বাবা-মায়ের চোখেমুখেও দেখতাম আমায় নিয়ে কষ্ট আর দুশ্চিন্তার ছাপ। মাঝে মাঝে শুনতে পেতাম তাদের ফিসফিসে কথা, ‘কী হলো মেয়েটার পায়ে? কেনো ধরতে পারে না ডাক্তার?’ ‘সুস্থ মানুষ ঘুমাতে গেলো, জেগে দেখে হাঁটতে পারে না!’ ‘ঘুমের মধ্যে এমন কী হলো যে ব্যথায় আর পা ফেলতে পারে না ও??’ ‘ও কি আর কখনো পুরোপুরি সুস্থ হবে না?’ তাদের মন খারাপ করা দুশ্চিন্তাভরা কথাগুলো শুনে আমার মন আরো খারাপ হয়ে যেতো।
একসময় ক্রাচ নিয়েই অফিসে যাওয়া শুরু করলাম। কী করবো? কতদিন আর বাসায় পড়ে থাকা যায়? অফিস থেকে কিছু না বলুক, আমার তো আর ভালো লাগছে না একা বাসায় পড়ে থাকতে। একা থেকে থেকে পাগলা থেকে আরো পাগলা হয়ে যাচ্ছিলাম। তাছাড়া ভাবলাম হুট করে দু’সপ্তাহ আমি নাই। অফিসে নিশ্চয়ই কমবেশি অসুবিধা হচ্ছে এজন্য। তাই ক্রাচ নিয়ে যেহেতু চলতে পারছিলাম কষ্ট করে, সেহেতু আর দেরি করলাম না।
অফিসে গিয়ে একটু হলেও ভালো লাগছিলো। বেডরেস্টে থাকার কথা; সেখানে ক্রাচে ভর করে লাফাতে লাফাতে অফিসে যেতে শুরু করলাম। পায়ের ব্যথা বেড়ে গেলো। তারপরও ভালো লাগছিলো, অন্তত বিছানায় তো পড়ে নেই আর। মাথায় আজগুবি চিন্তা এখন আর ঘোরাফেরা করার অতটা সুযোগ পাবে না।
কিন্তু একটা চিন্তা মাথা থেকে কিছুতেই সরছিলো না। মনে হচ্ছিলো, আমার পা কবে ঠিক হবে? আদৌ ঠিক হবে তো? ডাক্তার যে কিছু খুঁজে পেলো না, খুব সিরিয়াস কিছু হয়নি তো? তাহলে আমি নূপুর পরবো কী করে? যতবার হাঁটতাম, নূপুরের রুনুঝুনুর বদলে ক্রাচের খটখট শব্দ শুনতাম। মন কাঁদতো, চোখ থাকতো শুকনো। তাই কেউ বুঝতে পারতো না।
কিন্তু স্রষ্টার অশেষ রহমতে প্রায় অনেকদিন ভোগার পর এক সময় আমার পা’টা বেশ ঠিক হয়ে এলো। ব্যথা কমে সহনীয় মাত্রার নিচে নেমে এলো এক সময়। আমি ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে শুরু করলাম। ডাক্তার দেখে বললো, পা ঠিক হয়ে যাচ্ছে। আর অল্প কিছু সময় লাগবে। ক্রাচ ছাড়াই যেন হাঁটি। কিন্তু হাঁটা এবং সিঁড়িতে ওঠানামার পরিমাণ কমাতে হবে। ওষুধ কমে গেলো। ডাক্তারের কথামতো চলতে লাগলাম। মনে আবার সাহস ফিরে এলো, যাক তারমানে আমাকে আপাতত পঙ্গু হতে হচ্ছে না।
বাসায় আব্বু-আম্মুর মাথা ঠাণ্ডা হয়ে এলো। অফিসেও আমাকে ক্রাচ ছাড়া দেখে প্রায় সবাই-ই বেশ খুশি হলো, স্বস্তি পেলো।
এর মধ্যে বাসায় এলেন বিদেশ-ফেরত মামা। উদ্দেশ্য খুবই মহৎ - নিজ খরচে আত্মীয়দের নিয়ে একটা গেট টুগেদার আয়োজন, যেন সবার সাথে সবার দেখা হয়। বেশ বড় একটা পার্টির আয়োজন শুরু হলো, চাইনিজ রেস্টুরেন্ট বুক করা হলো। আমি আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলাম যেন পা-টা পুরো ঠিক হয়। ব্যথা কোনো কারণে বাড়লে আমার যাওয়া হবে না। ব্যাপারটা খারাপ দেখাবে। আর যদি যেতেও পারি, ক্রাচ সঙ্গে নিতে হবে। আমি চাই না জীবনে যে আত্মীয়রা আমাকে দেখেনি তারা আমাকে ক্রাচ নিয়ে হাঁটতে দেখুক!
অনুষ্ঠানের দু’দিন আগে আম্মু হঠাৎ বলে বসলো তার পক্ষে যাওয়া অসম্ভব। কেনো? কারণ তার একমাত্র পার্টি জুতো জোড়ার একপাটি আহত; হিল এমনভাবে ভেঙ্গেছে, যা ঠিক করা সম্ভব না কোনোভাবেই। সুতরাং নতুন জুতা কেনা না হলে আম্মু যাবে না।
কিন্তু সমস্যা তো সেটা না। জুতা লাগলে জুতা কিনবে। সমস্যা হলো আম্মু আমাকে ছাড়া মার্কেটে যাবে না। আব্বুকে নিয়ে যেতে বললাম। ভয় একটাই, হাঁটলে যদি পা ব্যথা বেড়ে যায়? কিন্তু আম্মুকে সে কথা বোঝায় কে?! তার যুক্তি হলো, আব্বুর মাথা গরম। জুতার দোকানে গিয়ে দোকানদারের সাথে ঝগড়া লাগিয়ে দেবে। তাই আব্বুকে নিয়ে গেলেও আমাকে সাথে থাকতে হবে!
কী আর করবো! শত কান্নাকাটিতে কাজ না হওয়ায় অবশেষে মার্কেটে যেতে রাজি হলাম। ভাগ্য ভালো, প্রথম দোকানে ঢুকেই আম্মুর জুতা পছন্দ হয়ে গেলো, দামও মিলে গেলো, কেনাও হয়ে গেলো। আল্লাহর অশেষ রহমত, আমার পায়ের কথা ভেবেই হয়তো আমাকে বেশি হাঁটায়নি।
আমার কাজলও শেষ হয়ে গিয়েছিলো। একটা অনুষ্ঠানে যাবো, চোখে যদি একটু কাজলও দিতে না পারি, আমার সাজই তো অপূর্ণ রয়ে যাবে। তাই আম্মুকে বললাম বের হওয়ার সময় মুখের দোকানটা থেকে কাজল কিনে বেরিয়ে যাবো। আব্বু বললো, ‘চলো ডান দিক দিয়ে বের হই, আমার একটা দোকান খোঁজা দরকার ছিলো। ওদিক দিয়ে যাওয়ার পথে পেয়ে গেলে ভালো, নইলে একবারে বেরিয়ে গেলাম।’ আমিও রাজি হলাম।
ডান দিকের গলিতে একটু এগিয়েই আব্বুর আরাধ্য সেই দোকান পাওয়া গেলো, রূপার গয়নার দোকান! আমি তো অবাক! এখানে কেনো হঠাৎ? আব্বু আম্মুর দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। দেখি আব্বু মুচকি হাসছে। আম্মু বললো, ‘তোর যখন পায়ে সমস্যা হলো, আমরা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম হয়তো সহজে আর স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারবি না। আগে কত নূপুর নূপুর করেছিস। কিনে দেয়া হয়নি। এখন হয়তো আর পরতেই পারবি না।’
‘কিন্তু আল্লাহর রহমতে তোর পা আবার ঠিক হয়ে আসছে। তাই আজকে তোর এতোদিনের ইচ্ছাটা পূরণ করে দেবো। বল, কেমন নূপুর পছন্দ তোর?’
নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না... সত্যিই? আমার নূপুর হবে? আমার নিজের রূপার নূপুর?? যখন নানা ডিজাইনের নূপুর থেকে সবচেয়ে কম শব্দওয়ালা কিন্তু পা ভরে থাকবে এমন নূপুরজোড়া বেছে নিলাম, পায়ে পরলাম, তখনো মনে হচ্ছিলো যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছি আমি, নয়তো স্বপ্ন দেখছি!
কিন্তু এটা স্বপ্ন না। এটা বাস্তব। আমার ছোট্ট একটা স্বপ্নের ভীষণ কাঙ্ক্ষিত এবং সুন্দর বাস্তব রূপ। মানুষের হাজারো অপূর্ণ ইচ্ছার মধ্যে পূর্ণ হওয়া ছোট্ট একটা টুকরো, যা বস্তুগতভাবে হলেও আরেকবার প্রমাণ করে দিলো বাবা-মায়েরা সন্তানকে কতটা ভালোবাসেন, সন্তানের বিপদে তারা কতটা ভয় পান। সন্তানকে খুশি করতে তারা সবই করতে পারেন। ক্ষমতা থাকতে সন্তানের ন্যায্য বা নিরপরাধ চাওয়া তারা কখনো অপূর্ণ রাখেন না। পৃথিবীতে আর কেউ আমাদের তাদের মতো ভালোবাসতে পারেন না। উপযুক্ত একজন জীবনসঙ্গী হয়তো তার ধারে কাছে ঘোরাফেরা করতে পারে। কিন্তু সেটা তো ভিন্নরকম, বিশেষ এক সম্পর্ক। কিন্তু বাবা-মায়ের সঙ্গে সে সম্পর্কের কখনোই তুলনা চলে না...কখনোই না!
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:২১