বাংলাদেশের কাছে ভারতের সব চাওয়াই পূরণ হয়েছে। দিল্লিতে গত সোমবার মনমোহন-হাসিনা শীর্ষ বৈঠকের পর মঙ্গলবার প্রকাশিত দু’দেশের যুক্ত ইশতেহার বা ঘোষণায় এর প্রতিফলন ঘটেছে। দু’দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত নিরাপত্তা সংক্রান্ত তিনটি চুক্তি ও দুটি সম্মত কার্যবিবরণীতেও ভারতের ইচ্ছার বাস্তবায়ন হয়েছে। বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতকে অনেকটা একতরফাভাবেই রেল, সড়ক ও নৌ ট্রানজিট এবং এসব সুবিধা কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানির সুবিধাও দিয়েছেন। অপরাধ সংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদান, আইনি সহায়তা ও সাজাপ্রাপ্ত বন্দিবিনিময় চুক্তি নিয়েও দেশবাসী উদ্বেগের মধ্যে আছেন। কারণ, এসব চুক্তির সুযোগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। ভারতীয় সেভেন সিস্টারের বিচ্ছিন্নতাবাদী বা স্বাধীনতাকামী অথবা ভারতীয় জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের ধরার নামে আমাদের সীমানায় ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষীদের প্রবেশের কোনো সুযোগ এসব চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্টি হবে কিনা তাও স্পষ্ট হওয়া দরকার।তবে তিন চুক্তিতে যে ভারতের স্বার্থই যে রক্ষিত হয়েছে ভারতীয় মিডিয়ার উল্লাসেই তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। সরকারিভাবে এসব চুক্তির বিস্তারিত এখনও জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি, সংসদেও উত্থাপন বা আলোচনা হয়নি।
দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মত হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মহাসমারোহে সংবর্ধনা ও শান্তিপদক ইত্যাদি দিয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের মাথায় ঘোল ঢেলেছে ভারত। একটি শক্তিশালী দেশের সঙ্গে একটি দুর্বল দেশের চুক্তির যে অবস্থা হয়, দিল্লিতে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সে ধরনেরই অসম চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতকে অনেক কিছু দিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করে চুক্তি করতে তিনি চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। অপরদিকে ভারত যা চেয়েছে তার সবগুলোই পেয়েছে। এ চুক্তিতে বাংলাদেশ যা পেয়েছে, দিতে হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। দুই দেশের মধ্যে যে কয়েকটি চুক্তি হয়েছে, তার সবগুলোই ভারতের দাবি বা প্রত্যাশার ভিত্তিতে হয়েছে। বাংলাদেশের যে কয়েকটি সমস্যা সমাধান হওয়ার কথা ছিল তার কিছুই হয়নি। বাংলাদেশের সব বিষয়ই ভবিষ্যতের জন্য ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
বিশিষ্টজনরা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরে নিরাপত্তা সংক্রান্ত চুক্তি এ অঞ্চলে ভারতকে কর্তৃত্ব করার সুযোগ করে দিয়েছে। ভারতের ট্রানজিট সুবিধা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ১০০ কোটি ডলারের ঋণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মতামত হচ্ছে, দ্বিপাক্ষিক ঋণচুক্তি হতে পারে, তবে তা নিজের স্বার্থ বিলিয়ে নয়। এই ঋণের টাকা বাংলাদেশকে সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হবে। অর্থাত্ এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের টাকায় ভারত সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর, বিশেষ করে গত এক-দেড় দশক থেকে ভারত নানাভাবে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে রেল ও সড়ক ট্রানজিট, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুবিধা চেয়ে আসছিল। সাম্প্রতিক সময়ে আশুগঞ্জ দিয়ে ত্রিপুরায় বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের ভারি সরঞ্জাম নেয়ার ট্রানজিট চাচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে তাদের এসব চাহিদা পূরণ হয়েছে। কিন্তু সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারার উজানে বরাক নদীতে টিপাইমুখে ভারতের বাঁধ নির্মাণ নিয়ে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের জনগণের উত্কণ্ঠার সুরাহা শীর্ষ বৈঠকে হয়নি। বরং বাংলাদেশের জন্য ‘অ্যাডভার্স অ্যাফেক্ট’ বা মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়, এমন কিছু টিপাইমুখে ভারত করবে না—যৌথ ঘোষণায় দু’দেশের এ সম্মতির কথা বলে দিয়ে প্রকারান্তরে টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের বৈধতাই দিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কারণ ‘মারাত্মক’ ক্ষতির বিষয়টি আপেক্ষিক। এখন এ বাঁধে বাংলাদেশের ক্ষতি হলেও ভারত বলতে পারবে মারাত্মক কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। টিপাইমুখ বাঁধ হলে কি ক্ষতি হবে এটা কে নির্ধারণ করবে। ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগেও ভারত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা এ বাঁধের মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্ষতি হতে দেবে না। টিপাইমুখ নিয়ে মনমোহন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা স্রেফ দৈববাণী হয়ে ইতিহাসে রেকর্ড হয়ে থাকবে। আর এ বাঁধের প্রভাবে সিলেটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ভয়াবহ মরুকরণ শুরু হবে।
প্রধানমন্ত্রীর তার ভারত সফরে অন্তত ৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের সময়ে করা তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে এমওইউ ও ৮৩ সালে করা চুক্তির নবায়ন কিংবা নতুন করে তিস্তা চুক্তি করতে পারবেন বলে আশা ছিল, কিন্তু তা হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারেরই করা গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী ফারাক্কায় বাংলাদেশ যে পানি পাচ্ছে না, সে কথাটি পর্যন্ত যৌথ বিবরণীতে স্থান পায়নি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শীর্ষ বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপনই করেননি। তিস্তা চুক্তি নিয়ে দুই প্রধানমন্ত্রী তাদের পানিসম্পদমন্ত্রীদের এ বছর মার্চের মধ্যে যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠক করার নির্দেশ দিয়েছেন মাত্র।
ভারতের চাওয়া পূরণের বিনিময়ে বাংলাদেশ উল্লেখ করার মতো কিছু পায়নি। যৌথ ঘোষণা অনুযায়ী মূলত বাংলাদেশে ভারতের জন্য ট্রানজিট সুবিধা নিশ্চিত করতে রেল ও সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নে ১০০ কোটি ডলার ঋণ, ত্রিপুরায় বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণের সরঞ্জাম যাওয়ার সুযোগ দেয়ার বিনিময়ে ওই কেন্দ্রের উদ্বৃত্ত ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ কেনার সুবিধা পাবে বলে বাংলাদেশ আশ্বাস পেয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মালামাল আনা-নেয়া সহজতর করতে আখাউড়া থেকে ভারতের আগরতলা পর্যন্ত রেললাইন সংস্কার ও উন্নত করতে ভারতের ঋণের টাকা ব্যয় হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকে যখন ১০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল রিজার্ভ পড়ে আছে তখন এক বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারত থেকে ৩ দশমিক ২৭৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ ভারতে রফতানি করেছে ৩৫৮ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। এই ঘাটতি কমিয়ে আনতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার অনুরোধ করা হলেও ভারত কান দিচ্ছে না। বাংলাদেশী অর্ধসহস্রাধিক পণ্যের বিশাল নেগেটিভ লিস্ট রয়েছে ভারতের। বাংলাদেশী প্রায় অর্ধসহস্রাধিক পণ্য ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে ভারত তাদের দেশে ঢুকতে দেয় না। প্রাথমিকভাবে ৪৭টি পণ্য নেগেটিভ লিস্ট থেকে বাদ দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু যৌথ ইশতেহারে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আরও কিছু পণ্যকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে প্রবেশের অনুমতি দিতে সম্মত হয়েছে ভারত। এসব পণ্যের তালিকা জানা যায়নি। এছাড়া বহু আগেই ভারত নেগেটিভ লিস্ট থেকে কিছু পণ্যের নাম বাদ দিলেও নন-ট্যারিফ বাধা দিয়ে পণ্যগুলো সেদেশে প্রবেশে বাধা দিয়ে আসছে।
এছাড়া ভারতের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কাছে অতীতের অভিজ্ঞতাও খুব সুখকর নয়। জরুরি সরকারের আমলে সিডর আক্রান্ত একটি গ্রাম নতুন করে গড়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি ভারতের বর্তমান অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফরে এসে দিয়েছিলেন। তখন চালের সঙ্কট নিরসনে ৫ লাখ টন চাল সুলভমূল্যে ভারত বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করবে বলে অঙ্গীকার ছিল। কিন্তু ভারত এ নিয়ে গড়িমসি করে। বাংলাদেশে চালের উচ্চমূল্য ও সঙ্কট তীব্র হলেও ভারত ঘোষণা অনুযায়ী নগদ টাকা দিয়েও চাল দিতে গড়িমসির সমালোচনার জবাবে তত্কালীন ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী প্রকাশ্যে বলেছিলেন, আমরা না খেয়ে আপনাদের কাছে চাল বিক্রি করব, এমনটা আশা করবেন না। পরে চালের সঙ্কট কেটে গেলে ভারত স্থানীয় বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে চাল কিনতে বাংলাদেশকে বাধ্য করেছিল। সিডর বিধ্বস্ত গ্রাম পুনর্বাসনের কাজ এখনও সম্পন্ন হয়নি।
বাংলাদেশ সীমান্তে প্রতিদিন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) নিরীহ বাংলাদেশী কৃষক ও গরু ব্যবসায়ীদের হত্যা করছে। আওয়ামী লীগ সরকারের গত এক বছরে কমপক্ষে ৯৬ বাংলাদেশীকে বিএসএফ হত্যা করেছে। নিরস্ত্র বাংলাদেশীদের হত্যার মতো মানবাধিকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদও করার সাহস দেখাননি প্রধানমন্ত্রী। যৌথ ঘোষণায় এ ব্যাপারে দায়সারা গোছের বক্তব্য এসেছে। বলা হয়েছে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে দু’দেশের সীমান্তরক্ষীদের সংযতভাবে দায়িত্ব পালনের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সীমান্তে প্রাণহানি রোধ এবং অবৈধ তত্পরতা বন্ধে নিয়মিত দু’দেশের সীমান্তরক্ষীদের বৈঠকে বসার ওপরও জোর দেয়া হয়েছে।
যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদে ভারতের প্রার্থিতাকে নীতিগত সমর্থন জানিয়েছেন। এরকম প্রকাশ্য অবস্থান নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ পেতে আগ্রহী বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় দাতা জাপান এবং ভারতের সদস্যপদ লাভের বিরোধিতাকারী চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের নতজানু পররাষ্ট্রনীতিরও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
বদরুদ্দীন উমর : প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট কলাম লেখক বদরুদ্দীন উমর আমার দেশকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মহাসমারোহে সংবর্ধনা, মেডেল ও শান্তিপদক ইত্যাদি দিয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের মাথায় ঘোল ঢেলেছে ভারত। একটি শক্তিশালী দেশের সঙ্গে একটি দুর্বল দেশের চুক্তির যে অবস্থা হয়, গত ১২ জানুয়ারি দিল্লিতে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সে ধরনেরই একটি অসম চুক্তি হয়েছে। এ চুক্তিতে বাংলাদেশ যে কিছুই পায়নি, এমন নয়। কিন্তু বাংলাদেশ যা পেয়েছে, দিতে হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি।
তিনি বলেন, ভারত থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ আনার বিষয়ে চুক্তি হয়েছে। এই বিদ্যুত্ আনার জন্য বাংলাদেশকে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে, তা নিজ দেশের মাটিতে করলে বিদ্যুতের উত্পাদন ও সাশ্রয় অনেক বেশি হতো। সে চিন্তা না করে ভারতের সঙ্গে বিদ্যুত্ আমদানির এ চুক্তির যৌক্তিকতা বোঝার উপায় নেই। আমাদের এখানে বিদ্যুত্ ঘাটতির পরিমাণ যখন তিন হাজার মেগাওয়াট কিংবা তার চেয়েও বেশি হবে, তখন ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ আমাদানি করে বিরাজমান সমস্যার কোনো সমাধান হবে না।
ভারত বাংলাদেশকে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ট্রানজিট দেবে। কিন্তু বাংলাদেশও ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর এবং আশুগঞ্জ নদীবন্দর, রেলপথ ও সড়কপথ ব্যবহারের সুবিধা দেবে। এই যাতায়াত ব্যবস্থার এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য ব্যবস্থার কি হবে, তার পূর্ণ বিবরণ জনগণের অবগতির জন্য প্রকাশ করা দরকার। এই চুক্তির সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো, বাংলাদেশ কর্তৃক ভারতকে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে সম্মতি দেয়া। টিপাইমুখ বাঁধে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না—ভারত কর্তৃক এ আশ্বাস ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়। অতীতেও ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের সময় একই আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু ভারত সে অনুযায়ী কাজ না করে এই অঞ্চলকে মরুভূমি বানানোর ব্যবস্থা করেছে। টিপাইমুখ বাঁধের পরিণতিও একই হবে। এর চেয়ে ভিন্ন কিছু হওয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। এছাড়াও অনেক ঢাকঢোল পেটানো সত্ত্বেও তিস্তার পানিবণ্টন বিষয়ে কোনো চুক্তি না করে ভারত বিষয়টিকে এমনভাবে ঝুলিয়ে রেখেছে, যাতে স্পষ্টই বুঝা যায়, পানিবণ্টনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হবে। দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহলের বিষয়ে প্রবীণ এ রাজনীতিবিদ বলেন, ওই ছিটমহলের অধিবাসীরা যাতে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সার্বক্ষণিক ও সহজ যাতায়াত সুবিধা পায়, এ বিষয়ে আলোচনা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে এ বিষয়ে কিছুই হয়নি। শুধু বিদ্যুত্ সরবরাহের বিষয়ে কথা হয়েছে। মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মহাসমারোহে সংবর্ধনা ও মেডেল ইত্যাদি দিয়ে এভাবেই দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের মাথায় ঘোল ঢালার ব্যবস্থা করেছে ভারত।
ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান : প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর নিয়ে আমি বেশ আশাবাদী ছিলাম। তিনি ভারত সফর শেষে দেশে শুধু খালি হাতেই ফেরেননি, বাংলাদেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতকে অনেক কিছু দিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করে চুক্তি করতে তিনি চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। অপরদিকে ভারত যা চেয়েছে তার সবই পেয়েছে। এই যে ধরুন, বাংলাদেশের পানি সমস্যা। এটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য জীবন-মরণ সমস্যা। এ বিষয়ে আশ্বাস ছাড়া আমরা ভারতের কাছ থেকে কিছুই পাইনি। বলা হয়েছে, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তির স্পিরিট অনুযায়ী হবে। যদি এটিই হয় তাহলে তো সর্বনাশ। কেননা গঙ্গা চুক্তির মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশকে গঙ্গা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করার লাইসেন্স পেয়ে গেছে। আপনারা দেখবেন, চুক্তির আগে বাংলাদেশ যে পরিমাণ পানি পেত, চুক্তির পর তা অনেক কমে গেছে। চুক্তির দুর্বলতার সুযোগে গঙ্গার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত। কাজেই ওই ধরনের চুক্তি হলে বাংলাদেশ পানি পাবে না। তিনি বলেন, টিপাইমুখ বাঁধের বিষয়ে বলা হয়েছে, ভারত বাংলাদেশের জন্য খুব ক্ষতিকর কিছুই করবে না। অতীতেও ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগে একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি ভারত। বাংলাদেশের বিশাল এলাকা এখন মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। টিপাইমুখ বাঁধের মাধ্যমেও বাংলাদেশ ফারাক্কার ভাগ্য বরণ করবে।
চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ভারত ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলীয় ৭টি রাজ্যে বাংলাদেশের একটি বিশাল বাজার ছিল। এটি এখন হাতছাড়া হবে। তাছাড়া ওই সমুদ্রবন্দর দুটি ব্যবহারের জন্য তারা সড়ক ও রেলপথে ট্রানজিট সুবিধাও পাবে। এটাই বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও বিপজ্জক। এতে বাংলাদেশের নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত রয়েছে। ভারতকে কোনো ধরনের শর্ত ছাড়াই একতরফাভাবে ট্রানজিট সুবিধাসহ এ দুটি বন্দর ব্যবহার করতে দেয়ার অর্থই হচ্ছে ব্যবসায়িকভাবে সেই সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবেও বাংলাদেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়া। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে দুই দেশের মধ্যে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার ব্যাপারে কোনো আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি।
ড. মনিরুজ্জামান আরও বলেন, ভারত কিন্তু চুক্তি করে বাংলাদেশের কাছ থেকে বেরুবাড়ি নিয়ে গেছে। বিনিময়ে বাংলাদেশকে তিন বিঘা করিডোর আজও দেয়নি। এতে বাংলাদেশের মূল ভূ-খণ্ড থেকে দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা বিচ্ছিন্নই থেকে যাচ্ছে। সীমান্তে ভারতীয় বাহিনী বিএসএফ প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের কৃষকদের গুলি করে হত্যা করছে। প্রধানমন্ত্রী ভারতে থাকা অবস্থায়ও বিএসএফ বাংলাদেশের কৃষক হত্যা করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, এ বিষয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। সব মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এ সফরের বিষয়ে আমি চরমভাবে হতাশ হয়েছি।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বন্দর-বিদ্যুত্ রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ৫০ দফা সমঝোতা স্মারক এবং এর অধীনে চুক্তিতে ভারত যথেষ্ট লাভবান হয়েছে। ট্রানজিট ও বন্দর ব্যবহার ইত্যাদি ভারতের যেসব দাবি অনেকদিন ঝুলে ছিল, তা পূরণ হয়েছে।
সূত্রঃ আমার দেশ, ১৪ জানুয়ারি, ২০১০
১০০ কোটি ডলারের ভিক্ষা পেয়ে আমরা খুব খুশি।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন
মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)
ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)
০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন
টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন
আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।
ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।