বরফ দেখে সবাই উত্তেজিত, আমরা ডাঙার মানুষ, বাংলাদেশের মানুষের বরফ দেখে উৎফুল্ল হওয়ার যথেষ্ট কারন আছে, এমন কি আমরা আসার পথে জমে যাওয়া পানির স্রোটে হাত বুলিয়ে আনন্দ পেয়েছি সকালে রাস্তায় জমে থাকা পানি দেখেও আনন্দ লেগেছে ,ফ্রিজের বাইরেও যে বরফ পাওয়া যায় এটাই বড় আবিস্কার। তবে তাপমাত্রা শুন্যের নীচে নামলেই তুষার পড়ে না, তুষার পড়ার জন্য বাতাসে সেই পরিমান জলীয়বাষ্প থাকতে হয় এবং তুষারাংক বলে একটা বিষয় আছে ওটার নীচে গেলেই তুষারপাত ঘটে, মানালিতে সে রাতে তুষারাংকের অনেক উপরে ছিলো তাপমাত্রা, তাই আকাশ থেকে বরফ না পড়লেও মাটিতে জমে থাকা পানি জমে বরফ হয়েছিলো।
সবাই এস্কিমো সেজে ঘুরছে, আমার মতো গুটিকয় নির্বোধ যারা ভাড়ায় জ্যাকেল, লাঠি আনে নি তারা ব্যাতিত, এবং তারা বরফে লাঠি ঠুকে ঠুকে হাঁটছে, আমি খটখটে দুপুরে কনকনে ঠান্ডা আঙ্গু ল নিয়ে তাদের দেখছি, লিটু ভাই এবং আমাদের শ্রদ্ধেয় হলগ্রুপ তখন মাঝ রাস্তায় আটকে পড়েছিলো। সমস্যা হলো সুমো জীপ 2 হুইল ড্রাইভ, পেছনের 2 চাকা নিয়ন্ত্রিত হয় ইঞ্জিন দিয়ে( অথবা সামনের 2 চাকা) তবে বরফে, বিরুপ পরিবেশে এবং পাহাড়ে ফোর হুইল ড্রাইভ আদর্শ বাহন, সমস্যা হয়েছে বরফাচ্ছাদিত একটা পানির ধারা যেটা আমরাও অতিক্রম করে এসেছি, সেখানে তাদের চাকা আটকে গেলো, এবং 2 হুইলার সেই আটকানো চাকা ছাড়াতে পারে নি, অনেকক্ষন বরফবন্দি থাকার পর তারা অবশেষে পৌঁছাতে পেরেছে এখানে, এবং তখন সানি দেওলের একটা হিন্দি ছবির গান সুপারডুপার হিট।
সেই গানে সানি ভাই স্যান্ডো গেঞ্জি পড়ে বরফে শুয়ে নায়িকার সাথে গান গেয়েছিলো, বড় চমৎকার গান, নায়িকা স্কার্ট পড়ে দৌড়েছে, সানি ভাই স্যান্ডো গেঞ্জি আর জিন্স পড়ে তার পেছনে পেছনে, বাঙালি অনুকরন প্রিয় তাই তারাও বরফ দেখে একই কাজ করতে চাইলো, একটানা ফটোসেশন চললো, টিপু, সঞ্জয়,মানিক, পলাশ, সবাই স্যান্ডোগেঞ্জি পড়ে বরফে শুয়ে ছবি তুললো, একজন খালি গায়ে ছবি তোলার পর সবার মানসম্মানে ঘাঁ লেগেছে, তাই তারাও স্যান্ডো গেঞ্জি ছেড়ে ছবি তোলার জন্য বরফে শুয়েছে, সমস্যা হলো এর মধ্যে একজনের মাংশপেশী জমে গেলো, সে স্ট্যাচুর মতো শক্ত হয়ে গেছে, পরে তাকে তুলে নিয়ে আলাদা করে জীপের হিটিং ছেড়ে গরম করতে হয়েছে, এর পরও সবাই আনন্দিত।
আমার অপেক্ষার অবসান হলো, আমরা ফিরতি রাস্তা ধরলাম, সেই আগের মতোই, আমি একেবারে জীপের বাইরের দিকে বসেছি,ভেতরের অনেক মানুষের বদলে এই সীটের বড় সুবিধা হলো এখান থেকে জীপের খোলা পেছন দিক দিয়ে অনেক কিছু দেখা যায়। জীপগুলো সেই হিন্দি ছবির ফরেস্ট অফিসারদের জীপের মতো, পেছনের দিকটা খোলা, অবশ্য ফেরার পথে সমস্যা হলো কম। গতি সেই 60 কিমি তবে উপমাহাদের রাইটহ্যান্ড সিস্টেমে ড্রাইভ করতে হয় বলে আমরা এবার পাহাড়ের পাশ দিয়ে আসছি, গায়ে কাঁটা দেওয়া খাদ দেখা যাচ্ছে, তবে খাদে গিয়ে পড়বো এমন আশংকা কম এ বারে। সেই বাসের কাছে ফেরত আসলাম, সবাই জীপের ভাড়া দিয়ে বাসে গিয়ে অপেক্ষা করলাম কখন লিটু ভাইরা ফেরত আসবে। এবং সবাই মিলে ফিরলাম সেই জায়গায় যেখানে পরিধেয় ভাড়া নেওয়া হয়েছিলো। অতঃপর হোটেলে। হোটেলে আসার আগেই একটা সমস্যা, একটা বিস্ফোরন দানা বাধছিলো, এই যে আমরা নিজের টাকায় জীপ ভাড়া করলাম এই টাকাটা কে ফেরত দিবে আমাদের। হিসাব মতে এই টাকা দেওয়ার করা ট্রাভেল এজেন্সির, তাদের সাথে আমাদের কথাই ছিলো তারা আমাদের রোটাংপাস নিয়ে আসবে, রোটাংপাসের নীচের কোনো এক জায়গায় এসে থেকে যাওয়ার জন্য আমরা আসি নি এতটা দুর।
সেই ঢালের কাছে আমরা পেয়েছিলাম এক শিখ ফ্যামিলি, খুবই উৎসবমুখর ফ্যামিলি, ভাঙরা ছেড়ে নাচছিলো, এবং সেই সাথে বোতল ছিলো, তারা সবাইকে বোতল দিয়ে আপ্যায়িত করৈলো, কেউ কেউ সেই বোতল থেকে মদ ঢেলে খেয়েছে, তবে আমাদের হলবাসী ভাইয়েরা সুবোধ তারা মদ খেলেও প্রকাশ্যে খায় না। এই আমাদের টাকা ফিরিয়ে দাও দিতে হবে দিতে হবে মিছিলের মতো করে আমরা হোটেলে ঢুকার পর বিষয়টা গোলমেলে হয়ে গেলো। আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকেরা মিটিং ডাকলেন, আমাদের অভব্যতা, অশোভনতা, অছাত্রসুলভ ব্যাবহেেরর বিরুদ্ধে একটা কারনদর্শাও নোটিশ টাইপ আলোচনা হবে। আমি এত সব বিষয় জানতাম না তবে আমাদের ট্রাভেল এজিন্সির মালিক বলেছে বাস রোটাং পাস যায় নি কারন ওটা ঝুঁকিপূর্ন ছিলো, আমি ইন্ডিয়ান পর্যটনের বাস দেখেছি ওখানে, ওটা যখন পৌঁছাতে পেরেছে তখন এই বাস কেনো পৌঁছাবে না তা বুঝি নি। এসব বাদ প্রতিবাদের ভেতরে এই ঝুঁকি র বিষয়টাই সামনে চলে আসলো। শিক্ষক সাহেব বললেন আমরা তোমাদের অভিভাবক, বাসের ড্রাইভার যখন বলেছিলো ওটা ঝুঁকিপূর্ন তখন তোমরা কেনো ড্রাইভারকে গালাগালি করলে, োাভিযোগ 2- কোনো রকম নির্দেশনা ছাড়া, অর্থ্যাৎ বাস যতদুর যাবে তোমরা ততদুর যাবে এই নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে কেনো তোমরা জীপ ভাড়া করে গেলে ওখানে। আমরা 42 জন মানুষ এক সাথে প্রতিবাদ করছি, পরবর্তি অভিযোগের তীর গেলো লিটু ভাইয়ের দিকে, ওরা না হয় নিজেদের সিদ্ধান্তে গিয়েছে, তুমি গেলে কেনো লিটু?
স্যার যদি আমি না যেতাম তাহলেও আপনি বলতেন ওরা কোনো রকম অভিভাবক ছাড়াই গেলো, তোমাকে অগ্রাহ্য করে গেলো, ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেন, আমি ওদের অভিভাবক হিসেবে এখানে এসেছি, ওদের দেখে রাখা আমার কর্তব্য, আমাকে যেতে হতোই, ওদের একা ছেড়ে দিতে পারি না আমি, যদি ওদের পথে কিছু হয় তার দায়িত্ব আমাদের উপরেই পরে। আর এরা সবাই প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে পেলে এরা আমার কথা মেনে নিবেএমনটা ভাবাটাই ভুল।
তবে ওরা এখন পর্যন্ত আমাদের কথার অবাধ্য হয় নি, বরং ওদের সাথে ট্রাভেল এজেন্সির কথাই হয়েছিলো ওরা তাদের রোটাংপাস নিয়ে যাবে, ছেলেরা সেখানে গেছে।
অশিষ্ট আমরা অবশেষে এই দাবিটা অর্জনে সফল হই, আমাদের জীপের ভাড়া ফেরত দেওয়া হবে, সেখানে আবার সার্বিক খরচের হিসাব দেখানো হয়, কোথায় কোন বাবদে কত খরচ হলো, আর কত লাগতে পারে। এইসব বিষন্ন হিসাবের ভেতরে সেই হলবাসী ভাইদের কিছু প্রাপ্তি নেই, তারা আমাদের জীপ ভাড়া দিবে না, তারা ট্রাভেল এজেন্সির খরচে গিয়েছে, আমরা কেনো বঞ্চিত হবো, এসব হিসাব মিলাতে মিলাতে আমরা অনেকটা সময় ব্যায় করে ফেললাম।
আমাদের রওনা দিতে হবে আবারও, এবার রাজস্থান, জয়পুর কিংবা যোধপুর, অবশ্য অনেক রসময় ঘটনা ঘটেছে এখানে আমাদের অনুপস্থিতিতে এসব কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে। অসুস্থ মানুষকে সেবা করায় যেনো ব্যাঘাত না ঘটে সে জন্য তারা হোটেলের রুমের দরজা বন্ধ করে ঘন সেবা করেছে। এসব ঘটবেই, সেবা করার আগ্রহ কারোই কম না, আমাকে এভাবে সেবা করার সুযোগ দিলে আমিও সেবা করতাম মনপ্রান উজার করে।
অবশ্য হলবাসীরা আর জীপে চড়তে আগ্রহী না, আমরা ব্যাগ সহ বাসে উঠবো মনস্থ করেছিলাম, তারা আমাদের জীপ ফেরত দিয়ে বললো তাদের কোনো আগ্রহ নেই এই জীপে যাওয়ার। এই সমস্যা কেটে যাওয়ার পর আসলে প্রধান সমস্যার সূচনা। সোনিয়া, রিম্পি, যুঁথি আর বাসে যাবে না, ওরা জীপে যাবে, এই জীপ থেকে 3 জনকে চলে যেতে হবে, তানভীরের আঁখিও সে গুলি মারে কার্যক্রম চরম সফল, যুঁথি জীপে চড়বে না তানভীর থাকলে, অতএব তানভীর কে জীপ থেকে যেতে হবে। সোনিয়ার সাথে আশফাকের ব্যাক্তিত্বের দন্দ্ব, সোনিয়া আশফাক থাকবে না এক সাথে, রিম্পির কারো সাথে সমস্যা নেই , তবে রিম্পি সোনিয়া এক সাথে থাকবে, লুকু জসিম জামাল শমিক মর্তুজা এরা থাকবে, থাকবে লিটু ভাই, রুবেল আসতে পারে তমাল আসতে পারে, তবে ওরা আর আসবে না, ওদের অসুস্থ বন্ধুরা বাসে।অবশ্য এই নিয়মটাতে আমাদের সবাই আপত্তি তুলেছিলো, মেয়ে আসা মানেই ওদের মাঝের সীট ছেড়ে দাও, মেয়েদের বলা যায় না তোমারা পেছনের সীটে বসে ঝুলে ঝুলে যাও। তাছাড়া আশফাক, তানভীর এদের সাথে দীর্ঘসময় ভ্রমনের ফলে আলাদা টান তৈরি হয়েছে, ওদের কি মুখে বলবো তোরা জীপ ছেড়ে চলে যা, কোনো রকম কারন ব্যাতিরকে, ওদের বাদ দিয়ে অন্য যেকোনো 2 জনও যেতে পারে, তারা কেনো যাবে না, একেবারে নির্দিষ্ট 2 জনকে যেতেই হবে এই বিষয়টার প্রতিবাদ করছে সবাই। তবে 10 জন ইন করতে পারে, এখানে 13 জনকে ঢুকানোর ব্যাবস্থা করা সম্ভব না।
কাউকে না কাউকে গিয়ে এই অপ্রিয় কথাগুলো বলতে হবে, কে এই দায়িত্ব নিবে? লুকু নিতে রাজি না, ও এই সম্পুর্ন আইডিয়াকে সমর্থন করছে না, জসিম, জামাল ভালো মানুষ ওরাও এই ঝামেলায় জড়াবে না, মর্তুজাও যাবে না,হারাধনের ছেলেরা ক্রমাগত গননা থেকে হারিয়ে যাওয়ার পর রইলো বাকি 2, আমি অথবা শমিক, অথবা 2 জনকেই এই কাজটা করতে হবে। লিটু ভাই বলবে না, ওটা শোভন হবে না তাই।
অবেশেষে পড়ন্ত বিকালে আমি আর শমিক অপরাধির মতো মাথা নীচু করে দাঁড়াই তানভীর আর আশফাকে সামনে, আমাদের জঘন্য একটা কাজ করতে হবে এই লজ্জাটা কথা দিয়ে অতিক্রম করতে হবে, শমিক প্রথমে মুখ খুললো, দোস্তরা একটা সমস্যা হইছে, সোনিয়া যুঁথি আর বাসে যাবে না ওরা জীপে যাবে ঠিক করেছে, আমাদের কাউকে না কাউকে জীপ ছেড়ে চলে যেতে হবে, আশফাক দোস্ত তুমি এখন বলো আমাদের ভেতরে কে বাসে যাবে, তুমি যদি আমাকে বলো আই হ্যাভ নো প্রব্লেম আমি বাসে চলে যাচ্ছি, রাসেলকে যদি বলিস রাসেল চলে যাবে বাসে।
ডিসিশন দাও তুমি,
আশফাক সহজ গলায় বললো না দোস্ত তোমরা জীপে যাও, আমারও ঘুমাতে সমস্যা হয়, আমি বাসের সীটে আয়েশ করে ঘুমাতে ঘুমাতে যাবো। আমরা আবার বলি, না এইটা ব্যাপার না তুই থাক আমরা বরং বাসে যাই, আশফাক ঘাড়ে হাত দিয়ে বললো আরে কোনো সমস্যা নাই, একটা জার্নির ব্যাপারই তো, আমরা তো আবার হোটেলে মিট করতেছিই।
আমার উপরে দায়িত্ব তানভীরকে বলার, অনেকক্ষন কথা সাজালাম, কি বলবো, অবশেষে সাজানো কোনো কথাই ঠিক পছন্দ হলো না, বললাম দেখো দোস্ত, তুমি যদি আমাদের সঙ্গে যাও, আমার ভালোই লাগবে, আই উইল বি গ্লাড ইফ ইউ ওয়ার উইথ আস ইন দি জীপ কিন্তু পরিস্থিতি এমন যুঁথি এবং তুই এক সাথে থাকতে পারবি না, তুই যদি বাসে যাস তাইলে যুঁথি এখানে থাকবে, আর যদি তুই জীপে যাস যুঁথি বাসে যাবে, সোনিয়া রিম্পি এখানে যাবে যুঁথি যাবে না এটাও ক্যামোন হয়।কিছু মনে করিস না দোস্ত, সামান্য সময়ের ব্যাপার, বাস থামলেই আবার দেখা হবে, তাছাড়া তুইতো শালা এমনি ঝিমাবি, জীপে ঝিমানোর চেয়ে বাসে ঝিমানো ভালো, ওখানে আয়েশ করে ঝিমাতে পারবি।
ওরা চলে যাওয়ার পর নিজেদের লজ্জা ঢাকার জন্য আমরাও সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা জীপ ছেড়ে যাবো। বিষয়টা ভীষন রকম অন্যায়। এমনটা করা ঠিক হচ্ছে না। এই সমস্যার আশু সমাধানের জন্য অবশেষে লিটু ভাই ঘোষনা দিলে আমরা বাস এবং জীপের মাঝপথ থেকে জীপের দিকে যাই, আমাদের জীপেই উঠতে হবে,সেনাপতির নির্দেশ, কোনো আপত্তি চলে না, তাই মুখগোমড়া করে আমরা সবাই উঠলাম জীপে, বাস রওনা দিলো জয়পুরের দিকে তবে আমাদের গুমোট অবস্থার অবসান হলো না। নিবিষ্ট লাশের মতো আমরা সবাই জীপে মধ্যে বসে সিগারেট জ্বালাচ্ছি একের পর এক, সোনিয়ার ভাবান্তর নেই কোনো, য্যানো এমনটাই স্বাভাবিক।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



