অনেক দিন পর কার্জন হলে গিয়ে জাহাঙ্গির ভাইয়ের সাথে দেখা হলো। আমাদের অতীত বিশ্ববিদ্যালয় জীবনযাপনের অপরিহার্য অংশের মতো, যার দোকানের সামনে বসে কিংবা পেছনে বসে আমাদের অনেক সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়েছে, অতীতের চোখ দিয়ে বর্তমানকে দেখার মতো অনেক দিন পর ফিরে যাওয়ার পর বস্তুগত ভারসাম্য অনুমান করার একটা ক্ষীন প্রচেষ্টা থাকেই।
কি ছিলো, কি আছে, কোনখানে ঠিক কি পরিবর্তন হলো, এইসব দৃষ্টিপাতের সাথে আশে পাশের মুখগুলোকে পুনরায় দেখা, কোনো পরিচিত মানুষ চোখে পড়ে না, আশাও করি নি আসলে আমাদের পরিচিত-পরিচিতারা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরিয়ে অনেক দুর হেঁটে চলে গেছে, আমরা দিন দিন বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছি হয়তো।
দেখা হলো শাহজাহানের সাথে, বৃদ্ধ ভাবটা তার ভেতরে প্রকট, চোখের নীচে ঘন কালি পড়েছে, যতদুর জানি বিয়েও করেছে সে, আমি তাকে নাম ধরে ডাকার পর সে বেশ সংশয়ী চোখে তাকালো আমার দিকে, শিক্ষক হয়ে যাওয়ার পর যে সমস্যা হয় মানুষের, সামান্য সম্মান অবচেতনে আশা করতে থাকে আর এই অবসরে তারা ছাত্রবিচ্ছিন্ন হতে থাকে নিয়মিত ভাবে। তারা ছাত্রের কাছ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যায়, ক্লাশের সামনের মঞ্চ ছাড়া অন্য কোথাও ছাত্রের সাথে যোগাযোগ করাটা শালীনতার লঙ্ঘন এমনটাই অলিখিত নিয়ম এখনও।
আমার ডাকে তার সংশয়ী হওয়ার যথেষ্ট কারনও আছে, আমার ছেঁড়া জিন্স, ছেঁড়া টি শার্ট এবং না কামানো গাল, এইসব এখনও নিদারুন ছাত্রত্বের পরিচায়ক, তাকে অবজ্ঞা করে এমন নাম ধরে ডাকা হলো কি না, এই সংশয় এড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। এত রসের সময় ছিলো না তাই কোনো রকম ভূমিকা ছাড়াই কিছু তথ্য জানতে চাইলাম, এই তথ্য জানতে চাওয়ার পরই সে নিশ্চিত হলো তাকে অপমানের কোনো চেষ্টা আমি করি নি, দেখতে ছাত্র মনে হলেও তার সাথে আমার সম্পর্কে এমন উপাদান আছে যার ভিত্তিতে আমি তাকে তুমি বলতেই পারি।
জাহাঙ্গির ভাইয়ের কাছেও শুনলাম আমাদের বন্ধুরা যারা শিক্ষক হয়েছে তারা আর এখন এই পাশে আসে না, তারা মিলন ভাইয়ের ক্যান্টিন থেকে চা নিয়ে যায় ঘরে, সামান্য অবস্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে কি কি বিপর্যয় ঘটে যায়, এখনও বাংলাদেশের সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা মানুষের পদবি ও অবস্থান নির্নয় করে সম্বোধন নির্দিষ্ট করে, এবং সেই একই রকম সামন্ততান্ত্রিকতা তাকে পদ-সচেতন করে তোলে, কার সাথে সম্পর্কিত হওয়া যাবে এই বিষয়গুলো নির্দিষ্ট করে ফেলে তারা। অবাক হলাম না, আমরা ঐতিহ্য অনুসরন করে যাই, আমাদের দুর্বল মনঃস্তত্বে ভেঙে ফেলার সাহসটাই অনুপস্থিত। আমরা প্রথাকে মেনে চলতে চাই, প্রথাগত জীবনযাপন করতে চাই, সামাজিক নিয়মাবদ্ধ থেকে, আমাদের সমাজ পরিবর্তনের ইউটোপিয়া থাকে হয়তো, যেভাবে কৈশোরে মানুষ বামপন্থার দিকে সামান্য ঝুঁকে যায়, সেই একই রকম শুভবোধ থেকে মানুষ জামায়াতে যোগ দেয়, একই রকম ভাবে তার স্বার্থ সচেতন হয়ে উঠে, আমাদের পরিচিত অনেক বখে যাওয়া বামের মতো অবশেষে পুঁজিবাদের শেকড়ে জল ঢালে, কেউ কেরানী হয়, কেউ ব্যাঙ্কের টাকা গুনে, কেউ অফিসের কাগজ ঠিকঠাক রাখে, আমাদের শোষনমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখা মানুষের অবশেষে শোষনের মঞ্চ প্রস্তুত করে, একটু মানবিক হয়ে মশা হয়, ফোঁটা ফোঁটা রক্ত খায় ড্রাকুলার মতো একচোটে একবাগ সাঁটিয়ে নেয় না।
জাহাঙ্গির ভাইয়ের দোকানের ছেলেরা যারা চাঁদপুর থেকে জীবিকার অন্বেষণে আসে এখানে , আমাদের চা-সিগারেট- বন-কলা এনে দেয় তাদের কপাল ভালো থাকলে স্নেহ পায় কপাল খারাপ থাকলে থাপ্পর জুটে কপালে সেইসব ছেলেদের কাউকেই দেখলাম না। তবে পুরস্কার দিতে আমরা কুণ্ঠিত থাকি তাই তিরস্কারের পরিমান সবসময়ই বেশী হয়, আমাদের সুখের দিনের গল্প হয়, আমরা অতীতচারি হয়ে উঠি, জাহাঙ্গির ভাইয়ের মন্তব্য শুনি আপনারা যারা চলে গেছেন তারাই ভালো আছেন, এখনের ছেলেরা তেমন ভালো না, হবে হয়তো, আমাদের সময়ে পুঁজিবাদ এতটা সক্রিয় উপাদান ছিলো না, তখনও বাঙ্গালি সাম্যবাদি মানসিকতা ছিলো সবল, আমাদের কর্পোরেট হয়ে উঠার প্রক্রিয়াটা 90 এর দশকে শুরু হলেও ওটার সম্পুর্ন প্রভাবটা এসেছে এক বিংশ শতাব্দিতে, আমাদের একবিংশ শতাব্দির কর্পোরেট বাংলাদেশ মানবিকতা খুন করে ফেলেছে।
সবার কথাই ঘুরে ফিরে আসে, লিটু ভাই, রাজীব, অতনু, লিপি, ইফতেখার, টানভীর, তন্ময়, আমরা যারাই সেখানে বসে আড্ডা দিয়েছি জাহাঙ্গির ভাই তাদের সবাইকেই কোনো না কোনো ভাবে চিনে রাখে, সবারই ভালো চায়, সবাই ভালো থাকুক এ মঙ্গল প্রার্থনা আমাদের সঙ্গি হয়ে থাকুক অনন্ত কাল।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



